যেভাবে লোকসানি প্রতিষ্ঠানে পরিণত হলো ন্যাশনাল ব্যাংক
ব্যাপক ঋণ অনিয়ম, সুশাসনের অভাব ও পরিচালকদের দ্বন্দ্বের কারণে দেশের প্রথম বেসরকারি ব্যাংক ন্যাশনাল ব্যাংক লিমিটেড (এনবিএল) এখন লোকসানি প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়েছে।
১৯৮৩ সালের মার্চে বাণিজ্যিক কার্যক্রম শুরু করা ব্যাংকটির আর্থিক অবস্থা ২০১৩ সাল পর্যন্ত ভালো ছিল।
২০১৩ সালের শেষে ব্যাংকটির খেলাপি ঋণের পরিমাণ দাঁড়ায় ৪৮৯ কোটি টাকা। এক বছর পর তা বেড়ে ৯১০ কোটি টাকা হয়। তখন থেকেই খেলাপির পরিমাণ বাড়তে থাকে বলে ব্যাংকের আর্থিক বিবরণীতে উঠে এসেছে।
কিন্তু, ২০২২ সালে এসে ব্যাংকটি লোকসানে পড়েছে ৩ হাজার ২০০ কোটি টাকার।
এখন এনবিএল শুধু লোকসানে থাকা প্রতিষ্ঠান নয়, এর প্রায় সব সূচকই নেতিবাচক হয়ে আছে।
গত সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ব্যাংকটির খেলাপি ঋণের পরিমাণ ছিল ১৩ হাজার ৫১৪ কোটি টাকা। এটি বেসরকারি ব্যাংকগুলোর মধ্যে সর্বোচ্চ।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুসারে, একই সময়ে ব্যাংকটির মূলধন ঘাটতি ছিল দুই হাজার ২৪ কোটি ৪০ লাখ টাকা ও প্রভিশনিং ঘাটতি ছিল ১৩ হাজার ৭৯৭ কোটি ৫০ লাখ টাকা।
'কেন্দ্রীয় ব্যাংকের চোখের সামনে এনবিএল লোকসানি প্রতিষ্ঠান হয়ে পড়ে। ব্যাংকিং নিয়ন্ত্রক সংস্থাটি কার্যকর উদ্যোগ না নিয়ে শুধু তা পর্যবেক্ষণ করেছে।'
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ব্যাংকের সাবেক এক স্বতন্ত্র পরিচালক দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'বর্তমান পরিস্থিতি গত ১৫ বছরের ধারাবাহিকতা।'
একটি প্রভাবশালী গোষ্ঠী ব্যাংকের আরও বেশি মালিকানা অর্জন করলে ব্যাংকের আর্থিক অবস্থা আরও খারাপ হতে শুরু করে।
ব্যাংক কর্মকর্তারা ডেইলি স্টারকে জানান, ২০০৯ সালে সিকদার গ্রুপ ব্যাংকটির বড় অংশীদারিত্ব অর্জন করে।
ব্যাংকটির সাবেক এই পরিচালক আরও বলেন, 'ব্যাপক ঋণ অনিয়ম, সুশাসনের অভাব, পরিচালকদের ঋণ অনিয়ম, পরিচালকদের অভ্যন্তরীণ কোন্দল ও মানসম্মত মানবসম্পদের অভাব ব্যাংকের বর্তমান বেহাল অবস্থার প্রধান কারণগুলোর অন্যতম।'
তিনি বলেন, 'ন্যাশনাল ব্যাংকের ওপর কেন্দ্রীয় ব্যাংকের দুর্বল নজরদারিও ব্যাংকটির নাজুক পরিস্থিতির আরেক কারণ।'
২০১৪ সালের অক্টোবর থেকে এনবিএল বোর্ডে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নিযুক্ত এক পর্যবেক্ষক থাকা সত্ত্বেও ব্যাংকটি ঋণ অনিয়ম ও পরিচালকদের ব্যাংকিং বিধি লঙ্ঘনের জন্য বেশ কয়েকবার গণমাধ্যমের শিরোনাম হয়।
বেশ কয়েকজন ব্যবস্থাপনা পরিচালক ব্যাংক থেকে পদত্যাগ করতে বাধ্য হন।
২০২১ সালের ফেব্রুয়ারিতে জয়নুল হক সিকদারের মৃত্যুর পর থেকেই এনবিএলের ওপর প্রভাব বিস্তার শুরু করে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। মৃত্যুর সময় জয়নুল হক সিকদার ব্যাংকটির চেয়ারম্যান ছিলেন।
গত বছরের এপ্রিলে সিকদার পরিবারের ১০ সদস্য ও সিকদার গ্রুপের দুই কর্মকর্তাকে দুই বছরের জন্য আন্তর্জাতিক ক্রেডিট কার্ড ব্যবহারে নিষেধাজ্ঞা দেয় বাংলাদেশ ব্যাংক।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নির্ধারিত ক্রেডিট কার্ডের সীমা লঙ্ঘন করে ১০ দশমিক ৫৮ মিলিয়ন ডলার (প্রায় ৯১ কোটি টাকা) দিয়েছে এনবিএল।
আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) সাবেক অর্থনীতিবিদ, ব্র্যাক ব্যাংকের সাবেক চেয়ারম্যান ও পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর ডেইলি স্টারকে বলেন, 'কেন্দ্রীয় ব্যাংকের চোখের সামনে এনবিএল লোকসানি প্রতিষ্ঠান হয়ে পড়ে। ব্যাংকিং নিয়ন্ত্রক সংস্থাটি কার্যকর উদ্যোগ না নিয়ে শুধু তা পর্যবেক্ষণ করেছে।'
'ব্যাংকের দুর্বল আর্থিক পরিস্থিতির জন্য কেন্দ্রীয় ব্যাংকও দায়ী' উল্লেখ করে তিনি বলেন, 'বাংলাদেশ ব্যাংকের উচিত ছিল অনেক আগেই এনবিএলের বোর্ড পুনর্গঠন করা।'
এর আগে গত ২১ ডিসেম্বর সিকদার পরিবারের চার সদস্যের মধ্যে তিনজনকে বহিষ্কার করে এনবিএলের বোর্ড পুনর্গঠন করে কেন্দ্রীয় ব্যাংক।
হোসাফ গ্রুপের চেয়ারম্যান ও এনবিএলের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা মোয়াজ্জেম হোসেনকে বোর্ডে পুনর্বহাল করা হয়। ব্যাংকের ৩৯তম বার্ষিক সাধারণ সভায় ডিজিটাল ভোটিং পদ্ধতিতে কারচুপি করে কয়েকজন পরিচালকের মাধ্যমে মোয়াজ্জেম হোসাইন ও তার ছেলে মাবরুরকে পরিচালনা পর্ষদ থেকে বহিষ্কার করা হয়।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক মুখপাত্র সিরাজুল ইসলাম ও সাউথইস্ট ব্যাংকের সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক এম কামাল হোসেনকে এনবিএলের বোর্ডে যুক্ত করা হয়েছে।
জয়নুল হক সিকদারের স্ত্রী মনোয়ারা সিকদারের পরিবর্তে ন্যাশনাল ব্যাংকের নতুন চেয়ারম্যান হয়েছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্যবসায় প্রশাসন ইনস্টিটিউটের সাবেক অধ্যাপক সৈয়দ ফারহাত আনোয়ার।
আহসান এইচ মনসুর আরও বলেন, 'এনবিএলের বোর্ড পুনর্গঠন করে সব কিছু ঠিক করা যাবে না। ব্যাংকটিতে বিশেষ অডিটের প্রয়োজন।'
তিনি মনে করেন, বিশেষ অডিট চালু করা নতুন বোর্ডের প্রথম দায়িত্ব হওয়া উচিত।
তার মতে, 'ম্যানেজমেন্ট টিমকেও পুনর্গঠন করতে হবে। কারণ তারাও ব্যাংকের দুর্বল আর্থিক পরিস্থিতির জন্য দায়ী।'
২০২১ সালের ডিসেম্বর থেকে এনবিএলের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও প্রধান নির্বাহীর দায়িত্বে থাকা মো. মেহমুদ হুসাইন গতকাল মঙ্গলবার ডেইলি স্টারকে বলেন, 'নতুন বোর্ড প্রথম সভা করবে। ব্যাংকের সার্বিক পরিস্থিতির উন্নতির জন্য অবশ্যই কিছু উদ্যোগ নেওয়া হবে।'
(এই প্রতিবেদনটি ইংরেজি থেকে অনুবাদ করেছেন রবাব রসাঁ)
Comments