শ্রদ্ধা

অন্বেষণে অনন্যা বুদ্ধিজীবী রোমিলা থাপার

রোমিলা থাপার ফেসবুক থেকে ছবি।

মানবিক বিদ্যার নোবেল বলা হয়, জন ডব্লিউ ক্লুগে পুরস্কারকে। যার মান ও অর্থমূল্য নোবেলের সমান। ২০০৩ সালে প্রবর্তিত এই পুরস্কার একজনমাত্র ভারতীয় পেয়েছেন, তিনি হলেন রোমিলা থাপার। নৃতাত্ত্বিক গবেষণার অন্যতম সর্বোচ্চ সম্মান হাক্সলি স্মারক পদক পান সমাজতত্ত্ববিদ এম এন শ্রীনিবাস। ১৯৯৯ সালে অমর্ত্য সেন অর্থনীতিতে নোবেল জয় করেন। স্বাধীন ভারতে এই দু'জন ছাড়া আর কেউ বৌদ্ধিক জ্ঞানচর্চার আন্তর্জাতিক পরিসরে রোমিলা থাপারের মতো এতো বড়ো সম্মান অর্জন করতে পারেননি। তবুও তিনি ভারতের একটা বর্গের মানুষের কাছে মার্ক্সবাদী ও হিন্দুবিদ্বেষী বলে পরিচিত। ৩০ নভেম্বর পূর্ণ করলেন ৯২তম জয়ন্তী।

রোমিলা ইংরেজিতে লিখেন, অনূদিত বাংলায় প্রকাশিত হয়েছে বেশ কয়েকটি বই। সর্বশেষ প্রকাশিত বিরুদ্ধতার স্বর : বেদের সময় থেকে শাহিনবাগ', ২০১৯-এ দেয়া দুটি স্মারক বক্তৃতার সংকলন। এখানে তিনি বলেছেন 'প্রাচীন ভারতে বিরুদ্ধতার বিভিন্ন দিক নিয়ে আমি আগেও লিখেছি, কিন্তু বর্তমান সময়ের পরিস্থিতি দেখে মনে হল বিষয়টি আরও শৃঙ্খলাবদ্ধ দৃষ্টিভঙ্গি থেকে বিচারের দাবি রাখে। প্রবন্ধটির শেষাংশটির উদ্দেশ্য শুধু অতীতের সঙ্গে বর্তমানের যোগসূত্র স্থাপন নয়, বরং একথাও সেখানে বোঝানোর চেষ্টা করা হয়েছে যে, বিরুদ্ধতার বিশেষ কয়েকটি ধরন অতীতের ধারাবাহিকতারই ফসল। আমি বিষয়টিকে একটি সামগ্রিক দৃষ্টিভঙ্গি থেকে দেখার চেষ্টা করেছি। আর তা করতে গিয়ে আমি যুক্তি দিয়ে দেখাতে চেয়েছি যে, ইতিহাসবিদ হিসেবে বিরুদ্ধতার অবস্থানকে চিহ্নিত করাটাই যথেষ্ট নয়, কারণ তার পাশাপাশি এ ইঙ্গিতও দিতে হবে যে, কেন এবং কাদের কাছে অতীতে বিরুদ্ধতার ঐতিহাসিক গ্রহণযোগ্যতা ছিল। তার অর্থ, সেই ধরনের বিরুদ্ধতাগুলিকে দেখা যেগুলো জনপরিসরে সাড়া পেয়েছিল। বিশেষ বিশেষ বিরুদ্ধতা প্রকাশের ক্ষেত্রে এ জাতীয় প্রতিক্রিয়াগুলির মধ্যে মোটের উপর একইরকম ধারাবাহিকতা দেখা গিয়েছিল কি না, সে প্রশ্নই আমার মূল আলোচ্য বিষয়।'

রোমিলা থাপার মনে করেন, জ্ঞানের অগ্রগতির ক্ষেত্রে প্রশ্নের গুরুত্ব অপরিসীম। প্রশ্ন না করলে এসবের কিছুই বোঝা যাবে না। এ কারণে তিনি বিভিন্ন সভ্যতা কীভাবে বিবর্তিত হয়েছে তা উন্মোচন ও অনুসন্ধানে বিরুদ্ধতার চর্চা ও প্রশ্নের ওপর গুরুত্বারোপ করেছেন।

রোমিলা থাপার প্রসঙ্গে একটা প্রশ্ন বেশ জোরেশোরে চাউর রয়েছে। জওহরলাল নেহরু বিশ্ববিদ্যালয়ের (জেএনইউ) এই অধ্যাপকের, (ইমেরিটাস অধ্যাপক) অলঙ্কার জেএনইউ, নাকি জেএনইউ-এর অলঙ্কার তিনি? প্রশ্নটা যত সহজ, উত্তরটা ঠিক তার বিপরীত।

রোমিলার আগ্রহের বিষয় প্রাচীন ভারত। রবীন্দ্রনাথ যে বলেছিলেন, 'হে অতীত তুমি ভুবনে ভুবনে/ কাজ করে যাও গোপনে গোপনে', এর প্রকৃত অর্থ মর্মে মর্মে উপলব্ধি করেছেন তিনি। জীবনভর সেই অতীতের সাধনা করে যাচ্ছেন। অতীতের আলোয় বর্তমানকে আলোকিত করার প্রাণান্ত চেষ্টা জারি রেখেছেন। আজকের ভারত, শুধু ভারতইবা কেন? এইসময়ের ভারতবর্ষ, দক্ষিণ এশিয়া একত্ববাদ ও  সংখ্যাগরিষ্ঠের শাসনে ও জায়মান আকাঙ্ক্ষার উল্লম্ফনে যে ভাবে রোগগ্রস্ত ও আক্রান্ত, সেসবে ইতিহাস কীভাবে বাঁচার আশ্রয় হতে পারে, তার প্রয়োজনীয় রসদ ও পাথেয় হাজির করেছেন তিনি। ইতিহাসের গভীরে গিয়ে অনুসন্ধান করেছেন এমনসব বিষয় যা জানা ছিল না কারোরই। যা পড়েছিল আড়ালে-অবহেলায়-অযত্নে, সেসবের মধ্য থেকেই তিনি মনি-মানিক্য আর হীরে-জহরত তালাশ করে এনেছেন। জনতুষ্টিবাদ আর গালগল্পে যে ইতিহাস হারিয়ে গিয়েছিল। শাসকবর্গ যে ইতিহাসকে নির্বাসনে পাঠিয়ে রেখেছিল দিনের পর দিন, নিজেদের সংকীর্ণ স্বার্থ আর ক্ষমতার মসনদ টিকে রাখতে। রোমিলা থাপারের আরাধ্য হল সেই ইতিহাস অন্বেষণ, তার ভেতর-বাইরের প্রকৃত সত্য উন্মোচন।

তিনি কেবল ইতিহাসের তথ্য তালাশ করে আনেননি। তার যৌক্তিক ব্যাখ্যাও হাজির করেছেন। দেখিয়েছেন প্রকৃত সত্য কি, আর স্বার্থ সিদ্ধির কারিগররা কী বলছেন। এসব অন্বেষণ করতে গিয়ে তিনি শাসকগোষ্ঠীর চোখে বিরুদ্ধবাদী হয়েছেন। তারপরও বলেছেন- ৯২ বছর বয়সেও বলে যাচ্ছেন বিরুদ্ধতার স্বর ভারত আত্মার গভীরেই নিহিত আছে, সেই বেদ-এর সময় থেকেই যা ছিল, দিল্লীর শাহীনবাগে এসে তাই-ই ধ্বনিত হচ্ছে। এখানেই একজন রোমিলা থাপারের ইতিহাস চর্চার গুরুত্ব। যুক্তিনিষ্ঠ ইতিহাস তালাশ করার পাশাপাশি নিজেও হেঁটে চলেছেন ইতিহাসের পথ ধরেই। ইতিহাসের শক্তিকে উন্মোচন ও ধারণ করতে গিয়ে নানামুখী চ্যালেঞ্জ ও ঝুঁকিতেও পড়েছেন। পেয়েছেন রাষ্ট্রদ্রোহীর তকমা। কিন্তু কখনোই সত্য অন্বেষণ থেকে পিছু হটেননি, আজও হেঁটে চলেছেন ইতিহাসের অলি-গলি থেকে শুরু করে আলপথ-রাজপথের সর্বত্র, নির্ভীক চিত্তে-ইতিহাসের ঝাণ্ডা হাতে।

১৯৫৫ সালে বারট্রান্ড রাসেলের সঙ্গে তরুণ রোমিলা থাপার। ছবি | ফেসবুক থেকে

বর্তমানে যে জাতীয়তাবাদের ধারণাকে সামনে এনে ভারতের শাসকগোষ্ঠী এর মাহাত্ম্য ও তাৎপর্যকে, সংকীর্ণ ও অনুদার করে তুলেছেন। রোমিলা সেসব নিয়েও বিস্তর কথা বলে চলেছেন, লেখালেখি করে যাচ্ছেন। জাতীয়তাবাদ যে কেবলই সংখ্যাগরিষ্ঠের কথা বলে না। প্রাচীন ভারতেও সেই রেওয়াজ ছিল না, সেটাও তিনি বারবার স্মরণ করানোর চেষ্টা করেছেন। ভারতের ইতিহাসের গভীরে রয়েছে সমন্বয়বাদী ধারণা। সেখানে সংখ্যাগরিষ্ঠ কখনোই সংখ্যালঘিষ্ঠের ওপর খড়গপাত করেনি। চোল-গুপ্ত, মৌযযুগের যে ভারত তা এইসব গালগল্পকে সমর্থন করে না।

ইদানীং কালে ভারত রাষ্ট্রে হিন্দু জাতীয়তাবাদকে যেভাবে উচ্চকিত করা হচ্ছে, নানা রংয়ে, নিজেদের আদর্শিক প্রয়োজনের স্বার্থে। এবং যে জাতীয়তাবাদের মধ্যে দিয়ে বারবার তোপ দাগানো হচ্ছে মোঘল ইতিহাসকে। যেভাবে মারাঠি আর রাজপুত ইতিহাসকে ফুলিয়ে-ফাঁপিয়ে দেখানো হচ্ছে ক্ষমতার রাজনীতির প্রযত্নে। রোমিলা তার বিপরীতে সবখানেই ইতিহাসের যুক্তিনিষ্ঠ সত্যকে সামনে এনেছেন। অড্রে টুস্কে, রামচন্দ্র গুহসহ প্রমুখ ঐতিহাসিকেরাও এ ব্যাপারে প্রকৃত ইতিহাসকে বারংবার মনে করানোর চেষ্টা করেছেন। একথাও বলা হয়েছে মুসলিম শাসন-মোঘল শাসনের সময়কালে তাদের উত্থাপিত অভিযোগগুলো যদি সত্য হত, তা হলে ভারতে কোন হিন্দুর অস্তিত্ব থাকত না। তারপরও প্রকল্পভিত্তিক ইতিহাস রচনা চলছে জোরকদমে। পাঠ্যপুস্তকেও ইতিহাসের নামে কল্পকথা, গালগল্প আর মুখরোচক বয়ানকে অন্তর্ভুক্ত করা হচ্ছে। মোঘল শাসনের সময় সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির বাস্তবতা কেমন ছিল তার প্রামাণিক উদাহরণ হাজির করেছেন রোমিলা। 

উদাহরণ হল, 'মোগলদের অর্থনীতির ভার ছিল দেওয়ান রাজা টোডরমলের হাতে। হলদিঘাটে মোগলদের সঙ্গে রাজপুতদের যুদ্ধে আকবরের সেনার নেতৃত্ব দিয়েছিলেন রাজা মান সিংহ। উল্টো দিকে মহারাণা প্রতাপের সেনাবাহিনীতে আফগান যোদ্ধাদের নেতৃত্বে ছিলেন শের শাহ সুরির বংশধর হাকিম খান সুরি। তা হলে মোগল বনাম রাজপুতদের যুদ্ধকে কী ভাবে হিন্দু বনাম মুসলমানের লড়াই বলা যায়।' বলা যায় না কোনভাবেই। কিন্তু প্রকল্পের ইতিহাস সবই বলতে পারে। সংখ্যাগরিষ্ঠের শাসনের নামে সবকিছুকেই  জায়েজ করার কসরত যখন চলে তখন এসবের বিপরীতে রোমিলার বৌদ্ধিক জ্ঞানচর্চায় আমাদের আশা-ভরসা আর আশ্রয়ের মৌলকেন্দ্র।

ভারতে যখন শতবর্ষী সব স্থাপনাকেও জাতীয়তাবাদের মোড়কে আবৃত করা হচ্ছে। যেমনভাবে, বাবরী মসজিদকে করা হয়েছে, আইনগত বৈধতাও দেয়া হয়েছে। এর ধারাবাহিকতায় কাশী, মথুরায় মসজিদের জায়গায় মন্দির ছিল বলে পুজো করার দাবি উঠেছে। দিল্লীর কুতুব মিনারের জায়গায় পূজোর অনুমতি চেয়ে আদালতের দ্বারস্থ হওয়া হয়েছে। রোমিলা তখন এসম্পর্কিত তথ্য-প্রমাণ হাজির করে তাদের ভ্রান্তিগুলো অপনোদনের চেষ্টা করছেন। তথ্যপ্রমাণসহ তিনি দেখিয়েছেন, চতুর্দশ শতকে বজ্রপাতে কুতুব মিনারের ক্ষতি হয়। যা মেরামত করেন হিন্দু রাজমিস্ত্রিরা। ওরা কাজ চলাকালে মিনারের গায়ে হিন্দিতে ও ভুল সংস্কৃতে নিজেদের দেবতা বিশ্বকর্মা ও গণেশের কথা খোদাই করে। যেটাকে ধরে হিন্দু জাতীয়তাবাদিরা নিজেদের স্বার্থ হাসিলে মরিয়া হয়ে উঠছেন, নানা রকমের দাবি-দাওয়া পেশ করে যাচ্ছেন। অথচ এতে কোনভাবেই প্রমাণিত হয় না রাজমিস্ত্রিদের জোর করে কাজ করানো ও ধর্মান্তর দাবির যৌক্তিকতা। অথচ সেই অক্ষর সাক্ষী করে হিন্দু সংগঠন বলছে, ওখানে মন্দির ছিল, ওটা বিষ্ণু স্তম্ভ।

এসব দাবির প্রেক্ষাপটে জাতীয়তাবাদ ও ইতিহাস নিয়ে এরিক হবসবমের মন্তব্যকে খুবই প্রাসঙ্গিক মনে হতে পারে । তিনি মনে করেন, ইতিহাসের সঙ্গে জাতীয়তাবাদের সম্পর্ক আর আফিমের সঙ্গে হেরোইন আসক্তির সম্পর্কটা একইরকম। আফিমের নেশা যখন মাথায় ওঠে মাদকাসক্ত তখন গৌরবময় অতীতের নামে রূপকথার জাল বোনে। বর্তমানের ভারতে 'বাদ', 'ইজম' বা 'চেতনা' যে মাথাচাড়া দিয়ে উঠছে, রাষ্ট্রের প্রযত্নে যে জাতীয়তাবাদের সুরত দাঁড় করানো হচ্ছে তার ভ্রান্তিকেও রোমিলা শনাক্ত করেছেন।

তিনি মনে করেন, এই জাতীয়তাবাদ আর ভারতের স্বাধীনতাকালীন জাতীয়তাবাদের ধারণা এক নয়। যে জাতীয়তাবাদকে সামনে রেখে স্বাধীন ভারতের আশা-আকাঙ্ক্ষা প্রবল ও দুর্বার হয়ে উঠেছিল। যে জাতীয়তাবাদকে লক্ষ্যভেদী জ্ঞান করে একসূত্রে গাঁথা হয়েছিল সমগ্র ভারতকে, সেটা ছিল ভারতীয় জাতীয়তাবাদ। যার মধ্যে গভীরভাবে নিহিত ছিল সমন্বিত চেতনা,সমন্বয়বাদী ধারণার সারাৎসার। হিন্দু, মুসলিমসহ সকল ধর্মের মানুষের সহাবস্থান। সেই জায়গায় এখন হিন্দু জাতীয়তাবাদকে চাপিয়ে দেয়া হচ্ছে, সংখ্যাগরিষ্ঠতার সুযোগ নিয়ে। দক্ষিণ এশিয়া এখন হিন্দু জাতীয়তাবাদ আর মুসলিম জাতীয়তাবাদের দিকে ঝুঁকে পড়েছে, দ্বিধাবিভক্ত হয়েছে দুইমেরুতে। যা ক্রমাগত সংখ্যাগরিষ্ঠের দৌরাত্ম্যকেই প্রকট করে তুলছে।

ভারত উপমহাদেশ ব্রিটিশবিরোধী সংগ্রামের চেতনাটা আজকের জাতীয়তাবাদীরা যেভাবে বলে, এমন ছিল না। এমনকি জাতীয়তাবাদের ধারণা প্রাচীন ভারতে এই প্রপঞ্চে না থাকলেও সেখানে যে চেতনা জারি ছিল তাতেও 'সমন্বয়বাদ'ই হাজির রয়েছে। এই দাবি শুধু রাজরাজড়া ও সাধারণ মানুষের ইতিহাস থেকে উদ্ভূত নয়। প্রাচীন ভারতে যে সব পর্যটক বিভিন্ন সময়ে এসেছিলেন উনাদের লেখনীতেও এসবের সত্যতা মেলে। আল বেরুনি, হিউয়েন সাং থেকে সকল পর্যটকের লেখাতেই সমন্বয়বাদ-সহাবস্থানের ধারণায় প্রাধান্য পেয়েছে। রোমিলা থাপারের অন্বেষণ সেই ভারতেরই। রবীন্দ্রনাথ যেমনটা বলেছেন কবিতায় : 'কেহ নাহি জানে কার আহ্বানে/ কত মানুষের ধারা/ দুর্বার স্রোতে এলো কোথা হতে/সমুদ্রে হল হারা/হেথায় আর্য, হেথা অনার্য/ হেথায় দ্রাবিড়. চীন--/শক-হুন-দল পাঠান মোগল/ এক দেহে হল লীন।'

রোমিলা থাপার কেবল একজন ঐতিহাসিক নন, জন পরিসরের একজন বুদ্ধিজীবীও। তিনি ইতিহাস রচনা করেন রাজ-রাজড়াদের জন্য নয়। একাডেমিকও হয়েও একাডেমিশিয়ান বা বিশেষজ্ঞদের জন্যও নন। উনি সাধারণ মানুষের ইতিহাস রচনাকার। এ লক্ষ্যে ইতিহাসের অতল হাতড়ে অন্বেষণ করেন এমনসব দলিল-দস্তাবেজ, যেখানে মূর্ত হয়েছে সাধারণ মানুষের গৌরব। সাধারণে সংঘটিত ঘটনায় কীর্তিমান হওয়া সময়ের স্বর উন্মোচনে তিনি প্রতিশ্রুতবদ্ধ। এ কারণে সাধারণ মানুষের দাঁড়াবার পরিসর-অনুসন্ধানকে দায় ও দায়িত্ব জ্ঞান করেন। এবং এই পরিসরই প্রাচীন ভারতের প্রকৃত রূপ। ইতিহাসের বহু স্বর অন্বেষণের লিপ্ততায় রোমিলার এক জীবনের সাধনা।

ভারত সরকার দু'বার ১৯৯২ ও ২০০৫-এ রোমিলাকে 'পদ্মভূষণ' দেয়ার জন্য মনোনীত করলেও গ্রহণ করেননি। কারণ তিনি সিদ্ধান্ত নিয়েছেন জ্ঞানচর্চার জগতের বাইরে কোন খেতাব তিনি কখনো গ্রহণ করবেন না। এ থেকেও বোঝা যায়, উনার ইতিহাস অন্বেষণ এবং ব্যক্তিজীবন কোনটাই কারও মুখপানে কিংবা স্বার্থগত কোন লক্ষ্যকে সামনে রেখে পরিচালিত হয় না। এরকম একজন বুদ্ধিজীবীর শত্রু থাকবে না, তাই কী হয়, রোমেলারও আছে। বিতর্কও সঙ্গ ছাড়েনি। কিন্তু তিনি এসবের কোনটার সঙ্গে আপস করেননি। বরং সব প্রতিকূলতাকে চ্যালেঞ্জ করে নিজের পথে হেঁটে চলেছেন-এই নবতিপর বয়সেও।

জয়সোয়াল, রমেশচন্দ্র মজুমদার, যদুনাথ সরকারের ইতিহাস চর্চার যে ধারা রোমিলা এসব থেকে বেরিয়ে স্বতন্ত্র ধারার সূচনা করেছেন এবং একক চেষ্টাতেই নিজেকে যুগান্তকারী এক অবস্থানে নিয়ে গেছেন। রোমিলা আজ বিশ্বব্যাপী বন্দিত একজন ইতিহাসবিদ। যিনি ভারতীয় ইতিহাসকে ঔপনিবেশিক কাঠামো থেকে বের করে এনে স্বনির্ভরতার পথে যাত্রা করেছেন। যে যাত্রায় আমরা অশোককে পাই অন্য রূপে।

ঔপনিবেশিক সাহিত্য চর্চার মূল লক্ষ্য হল, ভারতীয় ইতিহাসকে সর্বপ্রকারেই খাটো করে দেখা, বহুস্বরকে উপেক্ষা করা। এ কারণে তারা মনে করেন প্রাচীন যুগ মানেই হিন্দু যুগ, মধ্যযুগ মানেই মুসলমান যুগ। কিন্তু ঔপনিবেশিক যুগকে খ্রিস্টান যুগ বলেন না। রোমিলার প্রশ্ন এখানেই। যে প্রশ্নের সলতে পাকাতে পাকাতে তিনি বুঝে যান, আমাদের দেশের ঐতিহাসিকেরাও একই পথে হেঁটেছেন, ঔপনিবেশিকতার ভূতে আচ্ছন্ন থেকেছেন। তাদের ঘেরাটোপে পা রেখে দেশ ও দশকে দেখার চেষ্টা করেছেন।

রোমিলা এসবের বাইরে গিয়ে ইতিহাসকে বুঝতে চেয়েছেন। এ কারণে ইতিহাসের বহু স্বর তিনি শুনতে পান। যার মধ্যে আবিস্কার করেন ভারত আত্মার মুক্তি, দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর সংখ্যাগুরুর দৌরাত্ম্য থেকে বের হওয়ার দাওয়ায় আর সমন্বয়বাদী জাতীয়তাবাদী চেতনা ও সহাবস্থানের ধারণা। এসবই রোমিলাকে নিয়ে তর্ক, বৈরিতা, রাষ্ট্রদ্রোহের তকমা সেঁটে থাকার গুঢ় রহস্য। যারা এসব বলেন, আলাপে ঘৃতাগ্নি যোগান, যুক্ত হন প্রতিবাদ ছাড়া-এঁরা কেউই যে রোমিলার বই-পত্র পড়েন না, তা স্পষ্টত। পড়লেও বোঝেন না, কিংবা বুঝলেও মানতে চান না। অথচ যে সংখ্যাগুরুর সুবিধাবাদকে পুঁজি করে শাসক ও তার সাকরেদ ও সাঙ্গ-পাঙ্গরা এসব বলেন ও চর্চা করেন, উনারা কেউই থাকবেন না, রোমিলা থাকবেন।

কেবল তো আজ নয়, নবতিপর বয়সের অভিজ্ঞতা সাক্ষ্য দেয়, কতকজনই ক্ষমতার মদমত্তে রোমিলাকে রাজদ্রোহী-রাষ্ট্রদ্রোহীর তকমায় দাগিয়ে দিয়েছেন, তাদের কেউই থাকেননি, রোমিলা থেকে গেছেন, রোমিলার বইগুলো থেকে গেছে। থেকে যাবে নিশ্চয়-আগামীর দিনগুলোতেও। দক্ষিণ এশিয়ার রাষ্ট্রগুলোর স্বাধীনতার চেতানায়, জাতীয়তাবাদের ধারণায়, গণতান্ত্রিক আকাঙ্ক্ষা পূরণে রোমিলার উন্মোচিত-অনুসন্ধানকৃত ইতিহাস বাতিঘর বিশেষ।

Comments

The Daily Star  | English

Enforced disappearances: Eight secret detention centres discovered

The commission raised concerns about "attempts to destroy evidence" linked to these secret cells

2h ago