রণজিৎ গুহ 

প্রশ্নহীন সময়ে প্রশ্ন তুলতে শিখিয়েছেন যিনি

একজন গবেষকের প্রধান গুণ কি? বিশ্লেষণের ক্ষমতা ছাড়া, এ প্রশ্নের যুতসই কোন উত্তর নেই। ইতিহাসবেত্তার কাজও তাই। কেবল বিশ্লেষণ নয়, সেটাকে কতগুলো মাত্রায় ও কত রকমের স্তর থেকে বিশ্লেষণ করা যায় সেটাই হল প্রকৃত গুণবিচারী ক্ষমতা । যে গুণে অনন্য ছিলেন রণজিৎ গুহ। যে কোন বিষয়কে হোলিস্টিক প্রসেসে অর্থাৎ সমগ্রক রূপে দেখায় তিনি যে দৃষ্টান্ত রেখে গেলেন তা সবার জন্যই অমূল্য এক পাথেয়।

রণজিৎ গুহ যেহেতু সমগ্রক রূপে যে কোন ঘটনা বা ইতিহাসের কালপর্বকে দেখতেন, বিশ্লেষণ করতেন, সেই কারণে কোন বিষয়ের সিদ্ধান্ত প্রদানে চাপানউতোরের কোন বৈশিষ্ট্য উনার ধাতে ছিল না। আলোচনার ভাঁজে ভাঁজে তিনি সিদ্ধান্তের বীজ রোপণ করতেন। বিশ্লেষণের মধ্যেই সিদ্ধান্তের চাবিকাঠি চারিয়ে দিতেন। সেটা কখনও সরাসরি, প্রত্যক্ষে। কখনওবা অপ্রত্যক্ষে, ইশারায়, ইঙ্গিতে, প্রচ্ছন্নরূপেও জারি রাখতেন। ইতিহাসকে বিশ্লেষণ করার এই প্রবণতায় উনাকে অন্যদের থেকে স্বাতন্ত্র্য দিয়েছে। রণজিতের এই প্রবণতা একান্তই ব্যক্তিগত, নিজস্ব। যা তিনি অর্জন করেছেন, কেবল অর্জন করেননি অনেকের মধ্যে গেঁড়েও দিয়েছেন। স্বতঃস্ফূর্তভাবে সেটা রপ্ত করে তারা কীর্তিমানও হয়েছেন। নিজেদেরকে বিকশিত করে চলেছেন। দেশে-বিদেশে-আন্তর্জাতিকতায় উজ্জ্বলতম প্রতিভূ হিসেবে হাজিরও রেখেছেন।

দীপেশ চক্রবর্তী, গৌতম ভদ্র, শাহিদ আমিন, পার্থ চট্টোপাধ্যায়, জ্ঞানেন্দ্র পান্ডে, ডেভিড হার্ডিম্যানরা জ্ঞানের ও ইতিহাসচর্চার নানা শাখায় বিরাজিত হয়ে যে স্বর্ণশস্য ফলাচ্ছেন তার নেপথ্যের ইতিহাস শিক্ষায় ও ইতিহাসের ঐতিহ্য নির্মিতিতে রয়েছে রণজিৎ গুহর অবদান। যা উনারা স্বীকার করেন, মান্যতা দেন পঞ্চমুখে, কৃতজ্ঞচিত্তে।

দীপেশ চক্রবর্তী এক লেখায় উল্লেখ করেছেন, ''প্রাতিষ্ঠানিক ভাবে আমি রণজিৎদার ছাত্র ছিলাম না ঠিকই, কিন্তু তাঁকে ঘিরে ও তাঁর ভাবনাচিন্তাকে অবলম্বন করে 'নিম্নবর্গের ইতিহাস' সাধনার যে গোষ্ঠীটি গড়ে উঠেছিল, সেখানে আমরা সবাই ছিলাম তাঁর ছাত্র। ইতিহাস চিন্তা ও রচনার ক্ষেত্রে তিনি আমাদের মনে এক দশকেরও বেশি সময় ধরে যে উৎসাহ ও উদ্দীপনার সৃষ্টি করেছিলেন তার স্বাদ যে কেবল তথ্যনিষ্ঠায় শেষ হয়ে যায় না, ইতিহাসের প্রশ্নগুলি যে শেষ বিচারে মানুষের ভাবনাচিন্তারই প্রশ্ন, ভাবনাচিন্তার জন্যে যে ত্যাগ স্বীকার করতে হয়, বর্তমানের দাবিকে অস্বীকার না-করেও যে বর্তমানের অনেক আশু প্রলোভন এড়িয়ে ভাবনার কোনও অলীক সোনার হরিণের পিছনে একাগ্রমান হয়ে ছুটতে হয়- এই সব কথা রণজিৎদা আমাদের যে ভাবে বার বার বোঝাতেন, তা ছিল আমাদের প্রত্যেকের জীবনের এক অনন্য অভিজ্ঞতা।'

রণজিৎ গুহর বিড়ালপ্রীতি দেখে দীপেশ চক্রবর্তীর মনে পড়ে যায়, 'বেড়াল-কাঁধে আর এক নামী ইতিহাসবিদ ই পি টমসনের ছবির কথা। এরকম ঘটনার মধ্যেও রণজিৎ গুহ ও দীপেশ চক্রবর্তীকে চেনার কিছু বীজমন্ত্র লুকিয়ে রয়েছে। রণজিতের অস্ট্রেলিয়ার ভিয়েনাবাসের যাপিত জীবনের গল্পটাও এক্ষেত্রে প্রাসঙ্গিকতার দাবিদার। দেশটিতে 'পসাম' বলে বেশ বড় সাইজের বিড়ালের বসবাস রয়েছে। যারা বন্য এবং বাড়িতে নয় জঙ্গলেই স্থায়ীভাবে থাকে। এরকম একটা 'পসামে'র সঙ্গে উনার বেশ ভাব হয়ে যায়। ওটি প্রতিদিন সন্ধ্যার পরে আসে এবং উনাদের দেয়া ফল খেয়ে চলে যায়, এই ছিল পসাম ও রণজিৎ বাবুর প্রতিদিনের রোজনামচা। একদিন দেখা গেল পসাম তার বাচ্চাকেও পিঠে করে নিয়ে এসেছে। অভাবিত এই ঘটনায় রণজিৎ বেশ খুশি ও উৎফুল্ল হয়েছিল। যা দেখে দীপেশের মনে হয়েছে, 'এমন ভাবে বলছিলেন যেন পসামটি তার বাচ্চার সঙ্গে তার মানুষ বন্ধুদের পরিচয় করাতে নিয়ে এসেছিল! রণজিৎ কেন এই গল্প দীপেশকে বললেন আর দীপেশই কেনবা তা শুনে মনে করলেন পসামটি তার বাচ্চার সঙ্গে তার মানুষ বন্ধুদের পরিচয় করাতেনিয়ে এসেছিল। এই ঘটনা মূলত দুজনেরই হলিস্টিক মাইন্ড অর্থাৎ সমগ্রক মনেরই পরিচায়ক।

রণজিৎ গুহ'র জ্ঞানচর্চার বৈশিষ্ট্য ছিল বহুধা-বিস্তৃত। যা উনাকে বিশিষ্টতা দিয়েছিল সমকালে। ইতিহাসের পণ্ডিত তো ছিলেনই তার সঙ্গে যুক্ত হয়েছিল, সাহিত্য, সমাজ-বিজ্ঞান, দর্শন, রাষ্ট্রভাবনা, শিল্পকলা সহ প্রভূত বিষয়। একারণে জ্ঞানকাণ্ডের সকল আধারকে আধেয় করে হাজির করেছিলেন গবেষণা-ইতিহাসচর্চাসহ লেখালেখির পরিমণ্ডলে। নিম্নবর্গের ইতিহাস চর্চার যে ধারা মান্যতা পেল গত শতাব্দীর আটের দশকে, তাতে তিনি যুগিয়েছিলেন দার্শনিক সত্তার মৌলচিন্তা। নিম্নবর্গের ধারণা গ্রামসীর প্রিজন নোটস থেকে আহরিত হলেও সেই ধারণাকে বাংলা ভাষায় চর্চায় জারি রাখার কৃতিত্বের দাবিদারদের অন্যতম হলেন রণজিৎ গুহ। গৌতম ভদ্র ও পার্থ চট্টোপাধ্যায় সম্পাদিত 'নিম্নবর্গের ইতিহাস' বইয়ের 'ভূমিকা : নিম্নবর্গের ইতিহাস চর্চার ইতিহাস' প্রবন্ধে পার্থ চট্টোপাধ্যায় জানাচ্ছেন , ''সাবলটার্ন স্টাডিজ' প্রথম খণ্ডের গোড়ায় রণজিৎ গুহ রচিত একটি ক্ষুদ্র প্রবন্ধ প্রকাশিত হয় যাকে পরবর্তীকালে অনেকে নিম্নবর্গের ইতিহাস চর্চার 'ম্যানিফেস্টো' বলে উল্লেখ করেছেন। এই প্রবন্ধের প্রথম লাইনেই বলা হয়, 'ভারতীয় জাতীয়তাবাদের ইতিহাস-রচনায় দীর্ঘদিন ধরে ঔপনিবেশিক উচ্চবর্গ আর বুর্জোয়া-জাতীয়তাবাদী উচ্চবর্গের আধিপত্য চলে আসছে।' 

নিম্নবর্গের ইতিহাস-চর্চার উদ্দেশ্য হল এই দুই ধরনের উচ্চবর্গীয় আধিপত্যের বিরোধীতা করা। স্মরণ করা যেতে পারে, ভারতে জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের ইতিহাস নিয়ে দুটি বিবদমান গোষ্ঠীর ঝগড়া এই সময় তুঙ্গে। এক দিকে কিছু ব্রিটিশ ও মার্কিন ঐতিহাসিক দেখাবার চেষ্টা করছিলেন, ভারতীয় জাতীয়তাবাদ আসলে মুষ্টিমেয় কিছু উচ্চবর্গের নীতিহীন আদর্শহীন ক্ষমতা দখলের কৌশল মাত্র। চিরাচরিত জাতি-ধর্ম-সাম্প্রদায়িক আনুগত্যের বন্ধনকে কাজে লাগিয়ে বৃহত্তর জনগোষ্ঠীকে বৃহত্তর জনগোষ্ঠীকে সেখানে শুধুমাত্র ব্যবহার করা হয়েছিল। অন্যদিকে জাতীয়তাবাদী ঐতিহাসিকেরা এর তুমুল প্রতিবাদ করে বলেছিলেন জাতীয়তাবাদী আদর্শের কথা, জাতীয়তাবাদী নেতাদের নিঃস্বার্থ আত্মত্যাগের কথা , জাতীয়তাবাদী আন্দোলনে ব্যাপক জনসাধারণের অংশগ্রহণের কথা। রণজিৎ গুহ-র প্রবন্ধে ঘোষণা করা হল, এই দুটি ইতিহাস আসলে উচ্চবর্গীয় দৃষ্টিভঙ্গি-প্রসূত, কারণ দুটি ইতিহাসই ধরে নিয়েছে যে জাতীয়তাবাদ হল  উচ্চবর্গের ক্রিয়াকলাপের ফসল।  বিবাদ শুধু সেই ক্রিয়াকলাপের নৈতিক চরিত্র নিয়ে- তা সংকীর্ণ ব্যক্তি বা শ্রেণীস্বার্থের সাময়িক যোগফল, নাকি আদর্শ আর স্বার্থত্যাগের জাদুকাঠির স্পর্শে ব্যাপক জনসাধারণের চেতনার উন্মেষ। এই দুটি ইতিহাসের কোনটাতেই জনগণের নিজস্ব রাজনীতির কোনও স্থান নেই। ''

রণজিৎ গুহর এই অনুসন্ধান ও বয়ান ভাবনার মধ্যে দিয়ে সাবলটার্ন পেল দাঁড়াবার জায়গা, অঙ্কুরিত হওয়ার আবাদযোগ্য ভূমি। যা কেবল কলকাতায় থিতু হল না। উন্মেষ হল এখানে, ডানা মেলালো আন্তর্জাতিকতায়। সাবলটার্ন বা নিম্নবর্গ নানা রূপে, প্রশ্নে-উত্তরে, তর্কে-বিতর্কে, ভাবনা-আলোচনায় নানাজনের জ্ঞানচর্চায় জায়গা করে নিল, বৈশ্বিক পরিসরে। নিম্নবর্গের ইতিহাস চর্চাকে ঘিরে জ্ঞানচর্চার একটা শক্তিশালী ধারা তৈরি হল। এঁরা নানান নিরীক্ষা ও অনুসন্ধানের মধ্যে দিয়ে স্বাতন্ত্র্যধর্মী দিগন্ত খুঁজে নিল। মানববিদ্য্যর পথকেও করল বিশেষভাবে আলোকিত। রণজিৎ গুহ এসবে সলতে পাকানোর কাজটা করলেন। কিংবা সলতে পাকানোর কাজটা হয়তো তৈরি হচ্ছিল নানাজনের মাঝে নানাভাবে। তিনি সেটাকে উস্কে দিলেন। প্রমিথিউসের মতো আগুনটা জ্বালিয়ে দিলেন।

রণজিৎ গুহ জ্ঞানচর্চার ইতিহাসের সেই সকল বিরলপ্রজ ঐতিহাসিকদের অন্যতম, যিনি কেবল নিজেকে নির্মাণ করেননি, অন্যদেরকেও নির্মিতির সুযোগ করে দিয়েছেন। কিন্তু সেসবে সচেতনভাবেই পালন করেছেন প্রভাবক না হয়ে ওঠার ভূমিকা। গুরু-শিষ্যের চাপানউতোরে ছিলেন না কখনোই। বরং সচেতন ছিলেন শিষ্যত্ব যেন তৈরি হয়ে না-ওঠে। শিষ্যের মধ্যে তিনি হয়তো দেখতে পেতেন প্রজাতুল্য, ভৃত্যসুলভ বৃত্তি ও মানসকাঠামো। বরিশালের সিদ্ধকাঠি গ্রামের ভূমিজ সন্তানের একজন রণজিৎ গুহ হয়ে ওঠার পেছনে এই দৃষ্টিভঙ্গি সর্বান্তকরণে পালন করেছে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা। যাকে অনায়াসে ও আরও সহজ করে বলা যেতে পারে 'প্রশ্নজারি মন'ই উনার স্রষ্টা। যা তাঁকে দিয়েছে দক্ষিণ এশিয়ার অন্যতম শ্রেষ্ঠ ইতিহাসবিদের উষ্ণীষ। কীভাবে ও কেন রণজিৎ গুহ'র প্রশ্নজারি মন উনাকে অনন্য ও স্বতন্ত্রপিয়াসী করে তুললো সেই বিষয়টা খোলতাই করা যায় এভাবে। উনারা ছিলেন তালুকদার পরিবার এবং সেটা খাসতালুক। একারণে পুরো নামটা ছিল, 'রণজিৎ গুহ বকশী'। পারিবারিক পরিমণ্ডলে 'বকশী' শব্দটা ব্যবহার করা হচ্ছে কি না সেটা খেয়াল রাখা হতো কঠোরভাবে। কৈশোরের বেড়ে ওঠার কালে তিনি দেখেছেন আশেপাশের কিছু মানুষকে প্রজা হিসেবে চিহ্নিত করা হচ্ছে।

রণজিৎ গুহ লিখেছেন, 'ঘোর সাম্যবাদী সেই শিশুরাজ্যে সারাবেলা কাটিয়ে যেই বাড়ি ফিরেছি, তখনই শুনি আমার সঙ্গীদের বা তাদের পরিবারবর্গের কথা উঠলেই অভিভাবকগণ বিশেষ একটা শব্দ ব্যবহার করছেন যা আমি বলতে শিখিনি। শব্দটা হচ্ছে 'প্রজা'। কোনোদিনই আমি তা ভুলতে পারবো না। আদিম পাপবোধের মতো তা সারা জীবনই আমার চিন্তার সহচর হয়ে থাকবে।' আমাদের মনে পড়ে যায়, এরকমই একটা ঘটনা গভীরভাবে রেখাপাত করেছিল সাহিত্যিক-সাংবাদিক-রাজনীতিক আবুল মনসুর আহমদের কৈশোরবেলাতেও। অবশ্য সেটা ছিল সম্প্রদায়গত বিভাজনের দৃষ্টিকোণ থেকে, স্থান ও সময়ও ছিল ঢের আগের। আবুল মনসুর আহমদ জন্মেছিলেন ১৮৯৮ সালে তদানীন্তন পূর্ববঙ্গের ময়মনসিংহে। রণজিৎ গুহর জন্ম ১৯২৩ সালে  পূর্ববঙ্গের বরিশালে। আবুল মনসুর আহমদের স্মৃতিগ্রন্থ 'আত্মকথা'র তরফে আমরা জানতে পারি, হিন্দু জমিদারবর্গের লোকজন মুসলিম সম্প্রদায়ের ছোটবড় সকলের সঙ্গে তুইতোকারি করে কথা বলছেন। যা রেখাপাত করেছিল কিশোর মনে। দুটি ঘটনার ভূগোল ও ভগবান আলাদা হলেও ক্ষত একই জায়গা বা কেন্দ্র থেকে উদ্ভূত। বিষয়টা ক্ষমতার, মানসিকতার, দৃষ্টিভঙ্গির এবং সামাজিক বৈষম্য ও সম্মানের। দু'জায়গাতেই 'প্রজা' শব্দটি মুখ্য এবং উদ্ভূত ঘটনার নিয়ামক। রণজিৎ গুহ এই ঘটনাকে বলছেন আদিম পাপের মতো সহচর সঙ্গী। এই যে, একটা ঘটনাকে এভাবে দেখা এবং চিহ্নিত করা এটাই উনার শক্তি এবং এই শক্তি মূলত রণজিৎবাবুর প্রশ্ন জারি মনেরই শক্তি।

রণজিৎ গুহর কথা বললেই যেমন সাবলটার্ন বা নিম্নবর্গ এসে হাজির হয়, তেমনি চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত নিয়ে গবেষণাকর্মও প্রাসঙ্গিক ভাবে উল্লেখের দাবিদার হয়ে ওঠে। চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত নিয়ে গবেষণা কর্ম কম হয়নি, বই পত্তরও একেবারে অপ্রতুল নয়। কিন্তু রণজিৎবাবু এই গবেষণায় প্রমাণ করেছেন অনুসন্ধান মানে কেবল ঘটনা সমূহের নিছক বিবরণ নয়। ঘটনাকে দেখতে হয় অনেক উপর থেকে, ঈগলের চোখে। এ প্রসঙ্গে আবার 'সমগ্রক রূপে' দেখার প্রসঙ্গটি গুরুত্বের সঙ্গে স্মরণে রাখতে হয়। চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের সঙ্গে ওয়ারেন হেস্টিংসের নামটি ওতপ্রোতভাবে জড়িত, সবাই সেটা জানেও বটে। কিন্তু এই ঘটনার পুরো পরিভ্রমণ জুড়ে ফিলিপ ফ্রান্সিসের কী ভূমিকা সেটা জানা জরুরি ও অবশ্যম্ভাবী। রণজিৎ গুহ আমাদের সামনে সেসব হাজির করেছেন এবং এইসব হাজির করার নিমিত্তে বয়ান করে গেছেন সেই সময়ের বিশ্ব ইতিহাসের নানামুখী বাস্তবতা, যার সঙ্গে গভীরভাবে যোগসূত্রতা রয়েছে চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের। সময়টা সত্যিই বিশ্বরাজনীতির প্রেক্ষাপটে  গুরুত্ববহ। আমেরিকা স্বাধীন হচ্ছ, ফরাসী বিপ্লব তার হিস্যা পূরণ করে নিতে চাচ্ছে, ইংল্যান্ডে শিল্প বিপ্লবের সূচনা ঘটছে এবং দ্রুত গতিতে মাথাচাড়া দিয়ে উঠছে। ঠিক সেই সময়ে বাংলায় সূত্রপাত ঘটছে চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের। যার সূচনা হয়েছে আরও আগে। এইসব বিবরণ, তার নেপথ্যের কারণ ও যৌক্তিকতা অন্বেষণ করেছেন রণজিৎ গুহ। যার সর্বত্র জুড়ে হাজির রয়েছে প্রজার বেদনা অনুসন্ধানী ও সমব্যথী একজন ঐতিহাসিকের প্রশ্নজারি মন। চিরস্থায়ী বন্দোবস্তে কেন ওয়ারেন হেস্টিংস কোম্পানির স্বার্থ দেখেন আর কেন ফিলিপ ফ্রান্সিস গ্রেট ব্রিটেনের স্বার্থ সন্ধানী হন সেই বিষয়টা আমাদের কাছে যেমন পরিষ্কার হয় তেমনি  এই ঘটনার মধ্যে দিয়ে ব্যক্তি সম্পত্তি আর রাষ্ট্রের সম্পত্তি, সম্পত্তির বিবর্তনের মধ্যে দিয়ে কোন কূলে গিয়ে তরী ভেড়াল সেটা পরিষ্কারভাবে জানা যায়। জানার এ যাত্রায় যে পরিভ্রমণ হয় সেখানে রণজিৎ গুহ কেবল বিশ্লেষণে মনোযোগ দেন না, বিশ্লেষণের সঙ্গে প্রশ্নও হাজির রাখেন। বিশ্লেষণ, প্রশ্ন, সিদ্ধান্ত সব এমন ভাবে উপস্থাপন করেন সবটাই যেন একে-অন্যের অলঙ্কার রূপে প্রতিভাত হয়। তখন ইতিহাস, দর্শন এবং রাষ্ট্র, ব্যক্তি, রাজবৃত্তি, প্রজাশাসন সব একাকার হয়ে খোলতাই হতে থাকে।

শুধু কি চিরস্থায়ী বন্দোবস্তে, রণজিৎ বাবুর প্রতিটি কাজই খোলতাই করে চেনা চৌহদ্দীর বাইরের ও অন্তর্জগতের যাবতীয় দিক। একারণে রামমোহনের মধ্যে তিনি 'দয়া'র উৎসারণ দেখতে পান সর্বাগ্রে। নবজাগরণের রামমোহন, সতীদাহ প্রথা বিলোপের রামমোহন, ব্রাক্ষ্ম সমাজের রামমোহনকে তিনি ধরতে চান 'দয়া'র ব্যাকরণে। এবং এই পাঠ আমাদেরকে রণজিৎ গুহ আবিষ্কৃত সত্যকে মান্যতা দিতে কুণ্ঠা না-করে বাহবা দিতে-কুর্ণিশ জানাতে আগ্রহী করে।

'কবির নাম ও সর্বনামে'ও আমরা দেখি রণজিৎ বাবুর সর্বনাম বোঝাবুঝির সুলুকসন্ধানী তত্ত্বচিন্তা। একজন ইতিহাসবিদের সাহিত্য পাঠ কতোট ঋদ্ধ হলে এরকম দর্শন ভাবনা হাজির করা যেতে পারে তার অনুপম নজির এই বই। শেলী, রবীন্দ্রনাথ, সুকুমার সেন নানা ধারা ও সত্ত্বার ব্যক্তিত্বকে তিনি হাজির করেছেন চিন্তার প্রকাশকে অর্থবোধক করতে।  অবশ্য কেবল 'কবির নাম ও সর্বনাম' বইয়ে নয় রণজিৎ বাবুর রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে লেখা পৃথক বইয়ে, সুনীল-শঙ্খ ও উৎপলকে নিয়ে লেখা বইতেও তার সাহিত্য বোঝাবুঝির উচ্চতর পাঠ ও বৈদগ্ধ্যপূর্ণ পাণ্ডিত্যের পরিচয় উন্মীলিত হয়েছে।

রণজিৎ বাবু দীর্ঘ আয়ু পেয়েছিলেন এবং সুস্বাস্থ্যের অধিকারী ছিলেন। আর কটা দিন বাঁচলেই শতায়ু পূর্ণ করে যেতেন। যেমনটা করে গেছেন নীরদচন্দ্র চৌধুরী। দীর্ঘ জীবনকে তিনি কাজে লাগিয়েছেন জ্ঞানচর্চায়, লেখালেখি ও পঠনপাঠনে। যাপন করেছেন ইতিহাস। এই যাপনে সার্বক্ষণিক সঙ্গী ছিল উনার প্রশ্নজারি মন। উনি জানতেন এবং বিশ্বাস করতেন প্রশ্নের শক্তি। উত্তর কেমন হবে তা নির্ভর করে প্রশ্নের ওপর, এই ছিল উনার ইতিহাস নির্মাণ, গবেষণা ও লেখালেখির গভীরতর প্রত্যয় ও প্রতীতি। আরও একটা বিষয় তার ভেতরে লালিত ছিল জীবনব্যাপী। সেটা হল দরদী মন, যা একই সঙ্গে প্রশ্নসত্তাকে রেখেছিল সজীব সপ্রাণ ও গতিময়। যার মধ্যে দিয়ে তিনি বুঝতে চেয়েছেন নিম্নবর্গকে, বুঝতে চেয়েছেন প্রজার বেদনাকে, দেখতে চেয়েছেন রাজার খাসলতকে। এই দেখাদেখি ও বোঝাবুঝির মধ্য দিয়েই তিনি  জাতীয়তাবাদ, সাম্রাজ্যবাদ, মার্কসবাদ, সাম্যবাদ আর মানবতাবাদকে উজ্জ্বল করে গেছেন।

Comments

The Daily Star  | English
explanations sought from banks for unusual USD rates

Explanations sought from 13 banks for higher dollar rate

BB issued letters on Dec 19 and the deadline for explanation ends today

2h ago