স্মরণ

অকবিদের ভিড়ে আল মাহমুদ

সত্যিই কি আল মাহমুদ বাংলা সাহিত্যে মোচড়হীন কবি? এই নিয়ে রয়েছে আমাদের প্রশ্ন ও অস্বস্তি।
আল মাহমুদ (১১ জুলাই ১৯৩৬ – ১৫ ফেব্রুয়ারি ২০১৯) ছবি: স্টার

আল মাহমুদের কবি প্রতিভা নিয়ে আবদুল মান্নান সৈয়দের অভিমত হল: 'এক-ধরণের সহজ-সচ্ছল অনায়াস মোচড়হীন কবিত্বশক্তির অধিকারী। (করতলে মহাদেশ)। এই অভিমতকে মান্যতা দেওয়া দুরূহ, অবাস্তব ও অসম্ভব। 

সত্যিই কি আল মাহমুদ বাংলা সাহিত্যে মোচড়হীন কবি? এই নিয়ে রয়েছে আমাদের প্রশ্ন ও অস্বস্তি। রয়েছে নিজস্ব অনুসন্ধান, যুক্তি, ব্যাখ্যা ও বিশ্লেষণ। আমরা মনে করি, সৈয়দের এই মন্তব্য আল মাহমুদের কবিতার পরিভ্রমণ, বহুমাত্রিকতার সঙ্গে সাংঘর্ষিক, চাপানউতোর। এ কারণে এই অভিমতের উল্টো পিঠেই আমাদের পক্ষপাত, সহজাত অবস্থান।

কবির প্রথম পাঁচটা কাব্যগ্রন্থে অভিনিবেশিত হলে স্পষ্ট হয় উনার কাব্যযাত্রার মোচড় কতোটা সময় ও কালসাপেক্ষ। কীভাবে ও কেন এই সিদ্ধান্ত, আলোচনায় আমরা সেটাই উপস্থাপনের চেষ্টা করব। তার আগে জেনে নিই মোচড় শব্দের অর্থ। মান্নান সৈয়দ এখানে কোন অর্থে এর প্রয়োগ করেছেন তার শানে নযুল। মোচড়-এর বিবিধ অর্থ জারি রয়েছে। উল্লেখযোগ্য হল, আঁচড়। অর্থাৎ দাগ কাটা বা দাগ রেখে যাওয়া। মান্নান সৈয়দের সিদ্ধান্ত হল, আল মাহমুদের কবিতায় দাগ রেখে যাওয়ার মতো কিছু নেই। স্বদেশ ও সমকালকে অভিঘাত করার মতো সৃষ্টি অনুপস্থিত। তিনি মোচড়হীন কবিত্ব শক্তির অধিকারী। আল মাহমুদের সমগ্র কবিতা তো বটেই, প্রথম পাঁচটি কাব্যগ্রন্থ পাঠান্তে, এই সিদ্ধান্তকে মনে হয় ভ্রান্ত ও আরোপিত।

'কালের কলস' কাব্যগ্রন্থের শেষ প্রচ্ছদে বলা হয়েছে, ''আমাদের অগ্রজ এক কবির একটি উদ্ধৃতি-ম্লান উক্তি স্মরণ করে বলা যেতে পারে, 'সকলেই কবি নয়, কেউ কেউ কবি'। যে শক্তি একজন কবিকে অকবির ভিড়েও স্বতন্ত্র-উজ্জ্বল করে রাখে, আল মাহমুদ সেই দুর্লভ শক্তির অধিকারী। ঝাঁঝালো না করেও কবিতাকে আধুনিক পাঠকের রুচির পক্ষে গ্রহণীয় ক'রে তোলার ক্ষমতা তাঁর আয়ত্তে রয়েছে বলেই তাঁর স্থান আজ পূর্ব পাকিস্তানের জনপ্রিয় কবিদের প্রথম সারিতে।''

একজন কবির চারিত্র্যলক্ষণ ও কবিপ্রতিভা গভীরতল থেকে উৎসারিত না হলে কি ওরকম মূল্যায়ন সম্ভব? তাও আবার দ্বিতীয় কাব্যগ্রন্থের প্রকাশলগ্নেই? তখনও উনার 'সোনালী কাবিন' বেরোয়নি। শুধু প্রকাশিত হয়েছে 'লোক লোকান্তর'। প্রথম বইয়ে তিনি চিনিয়েছেন একজন প্রকৃত কবির জাত ও ঠিকুজি। কবিতাসমূহে তো বটেই বইয়ের নামকরণেও তার উপস্থিতি জানান দিয়েছে কালের দুন্দুভি বাজিয়ে।

'লোক লোকান্তর' দুই শব্দের মধ্যে নিনাদিত হয়েছে বিবিধ ভাবনার খোরাক। 'লোক' বলতে সাধারণ অর্থে বোঝায় মানুষ বা জনসাধারণ। আবার জগতকেও বিশ^লোক বলা হয়। তিনকাল- স্বর্গ, মর্ত্য, পাতাল; যাকে একত্রে বলা হয় মর্ত্যলোক। 'লোকান্তর' বলতে বোঝায় ভিন্নজগৎ, পরলোক, বিশ^লোক। তা হলে কি একই শব্দকে নানারূপে হাজির করার আকাঙ্খায় শরণ নেয়া হয়েছে এরূপ নামকরণের?

১৯৬৩-তে বইটি যখন প্রকাশিত হয়, তখন কবির স্বদেশে স্বৈরশাসনের দাপাদাপি। অবৈধ ক্ষমতা দখলকারিরা হাসছে পিশাচের ক্রুর হাসি। পাকিস্তান রাষ্ট্রে পূর্ববঙ্গের মানুষের স্বপ্নভঙ্গের বেদনা কেবলই দীর্ঘ হচ্ছে। মাতৃভাষার ন্যায্য অধিকারকে উপেক্ষা করা, একুশে ফেব্রুয়ারিতে গুলিবর্ষণ করে মানুষ হত্যা, চুয়ান্নোর জাতীয় নির্বাচন-যুক্তফ্রন্টের বিজয় ও ক্ষমতাগ্রহণ ষড়ন্ত্রের মাধ্যমে নস্যাৎ করা। ক্ষমতায় সামরিক স্বৈরশাহীর আগমন। পশ্চিম পাকিস্তান বিশেষ করে পাঞ্জাবিদের নেতৃত্বাধীন পাক সরকারের ন্যায়হীন ও যৌক্তিকতাবর্জিত কর্মকা-ে স্বদেশের মানুষ হয়ে ওঠে বিচলিত ও দিশেহারা। সংক্ষুব্ধ হয় কবি হৃদয়।

একজন সাধারণ মানুষ আর একজন কবি, দু'জনেই রক্ত মাংসে গড়া। দেখতেও ঠিক একই রকম কিংবা কাছাকাছি। কিন্তু কবিমাত্রই সংবেদশীল, ভিন্ন ধাতুতে গড়া। তিনি অতীত জপ করেন, ভবিষ্যতের ছবি আঁকেন; বর্তমানকে সুন্দর ও অনিন্দ্য রাখার অভিপ্রায়ে। শেকড়ে বসে মেলে দেন পাখির ডানা। 'লোক লোকান্তর' এই আকাক্সক্ষার উজ্জ¦ল প্রতিভূ।

কবিতায় যার সাক্ষ্য রয়েছে হাজির : 'পাথর পাহাড় খুঁড়ে মিলেছে যে করোটি ও হাড়/বিস্ফারিত চোখে দেখি আত্মীয়ের জংধরা খুলি,/ কেমন মমতা বাড়ে, হাতে নিই ঝেড়েমুছে ধূলি,/কালোত্তীর্ণ রক্ত যেন কেঁপে ওঠে তোমার আমার।' সহজ ও সুন্দর উচ্চারণে স্পষ্ট হয় কবির অভিলাষ। মানুষ মূলত বাস করে অতীতে, এ কবিতায় অনুরণন হয় তারই প্রতিধ্বনি। অতীতের সঙ্গে কোথায় মিলতে হবে, কী প্রকারে হবে সহাবস্থান তারও বারতা উচ্চারিত হয় এখানে।

স্বদেশের স্বপ্নভঙ্গের বেদনায় কালোত্তীর্ণ রক্তের ভূমিকাও দিশা পায় কবিতার পংক্তিতে। 'করতলে' কবিতায় যা হাজির হয় অন্যরূপে, 'কী আছে এই হাতের মধ্যে/কী আছে কও ঢাকা?/বললে হেসে, কী আর হবে/মিথ্যে ঢেকে রাখা...।' নিরাভরণ কিন্তু ভাবনাসঞ্চারী। একজন প্রকৃত কবির কাজই হল ভাবনা বুনে যাওয়া। আল মাহমুদ গভীর নিষ্ঠায় ক্রমাগত পালন করে গেছেন সেই ব্রত। এ কারণেই কবি ও অকবিদের ভিড়ে ব্যতিক্রম ও দেদীপ্যমান।

'অরণ্যে ক্লান্তির দিন' কবিতায় কবি অরণ্যের যে ছবি হাজির করেন, তা প্রতীকি। আবার একইসঙ্গে আমাদেরকে এই প্রশ্নের মুখোমুখি দাঁড় করায়, যে অরণ্য চাওয়ার ছিল বনমুরগীর। বানরের চেঁচানিতে তার বাসযোগ্যতা অবলুপ্ত হচ্ছে। যৌক্তিক কারণেই বনমুরগীরা ছেড়ে এসেছে প্রিয় অরণ্য। বনমুরগীর এই দশা কি সেদিনের পাকিস্তান রাষ্ট্রে মুক্তিকামী মানুষেরও হয়েছিল? কবির উপলব্ধি, 'গভীর অরণ্য ছেড়ে উড়ে আসে বনমুরগীরা/বানরের চেঁচানিতে ভরে যায় সেগুনের শাখা/ঝুড়িতে শব্জি নিয়ে হেঁটে আসে চাকমা কিশোরী...।'

'মায়াবৃক্ষ' কবিতার প্রত্যক্ষায়নে হাজির হয়েছে আত্মজিজ্ঞাসা, 'পোকায় কেটেছে শিকড় সব;/অকালে শাখার পাতার স্তব/শুকাবে, এখন ভেবেই তল/পাইনে, বিফল করেছি কি/ কোথায় ঢেলেছি পরম জল...।' আল মাহমুদের কবিতা সম্পর্কে 'কালের কলস' এর শেষ প্রচ্ছদের লেখায় একটা বাক্য এরকম, 'ঝাঁঝালো না করেও কবিতাকে আধুনিক পাঠকের রুচির পক্ষে গ্রহণীয় ক'রে তোলার ক্ষমতা তাঁর আয়ত্তে রয়েছে'। 'মায়াবৃক্ষ' তার অনুপম, উজ্জ্বল উদাহরণ।

কবির কাছে কি তখন পাকিস্তান একটা মায়াবৃক্ষ হয়ে উঠেছিল, নিশ্চয়। এই পাকিস্তান নিয়েই কত স্বপ্ন ছিল পূর্ববঙ্গের মানুষের, কারণ পাকিস্তান প্রতিষ্ঠায় তাদের ছিল অগ্রণী ভূমিকা। কিন্তু পাকিস্তান রাষ্ট্রে, ১৯৪৭ পরবর্তী পশ্চিম পাকিস্তানিদের ষড়যন্ত্র ও রাজনৈতিক চক্রান্তে উৎপাদিত হয়েছে কেবলই হতাশা, অর্থনৈতিক দূরবস্থা আর জবরদস্তির শাসন ও শোষণ। এ কারণেই সংক্ষুব্ধ কবি হৃদয়ের আত্মজিজ্ঞাসা, 'কোথায় ঢেলেছি পরম জল'।

আল মাহমুদের প্রথম কাব্যগ্রন্থকে যদি বলা হয়, স্বদেশের স্বপ্নভঙ্গের দ্যোতনা। দ্বিতীয়টি, আত্ম অন্বেষা বা আত্মমর্যাদা অনুসন্ধানের প্রয়াস। স্বদেশের আবহমান প্রতিচ্ছবিই কবির প্রেরণা ও শক্তি। কালের খেরোখাতা থেকে তিনি সেসবকে নিয়েছেন আপনার করে, হার্দিকতা ভরে। আরাধ্য জ্ঞান করেছেন 'কালের কলস'কে। যে কলস নিত্যদিনের চেনা কলসের বাইরের কিছু। যা ধারণ করে সমগ্র জাতির ইতিহাস, ঐতিহ্য, সংস্কৃতি, ধর্মবোধ ও জীবনাচারের মানসপ্রতিমা। পরম্পরা ও প্রবহমানতার মধ্যে দিয়ে ঋদ্ধ এই সম্পদকে পৌঁছে দেয় কাল থেকে কালান্তরে। আগামীর নির্মাণে, বর্তমানের আলোকায়নে যার প্রয়োজনীয়তা প্রশ্নাতীত, অনিবার্য ও অমোঘ।

'কালের কলস' কাব্যগ্রন্থের 'তারেকের অভিলাষ' কবিতায় কবির উচ্চারণ, 'একবার পাখিদের ভাষাটা যদি/শেখাতেন সোলেমান পয়গম্বর/জানতাম পাতাদের আড়ালে তারা/খড় দিয়ে কেন গড়ে ঘর সুন্দর;/ ... মাঠে ঘাটে পড়ে থাকে যেই খাদ্য/ঠোঁট দিয়ে খুঁটে খুঁটে তুলবো আমি/পাখিদের বাধা দেয় কার সাধ্য/এভাবে কাটাতে চাই আমার প্রহর- /একবার পাখিদের ভাষাটা যদি/শেখাতেন সোলেমান পয়গম্বর!' 'তারেকের অভিলাষ' সেই সময়ের পূর্ববঙ্গের মানুষের সম্মিলিত অভিলাষ হয়ে দেখা দিয়েছিল।

স্মরণে নেয়া প্রয়োজন, এই গ্রন্থ প্রকাশিত হচ্ছে ১৯৬৬-তে, বাঙালি জাতির রাজনৈতিক ইতিহাসের বাঁক বদলানো ক্ষণে। ততদিনে উন্মোচিত হয়েছে, দুই অর্থনীতির সারকথা। স্বাধীনতার রং হয়ে এসেছে ফিকে ও আলেয়াসদৃশ। পাখির উপমায় সেসবের দুঃখগাথা 'তারেকের অভিলাষে' জায়গা করে নিয়েছে সময়ের দাবিরূপে। স্বাধীনতার প্রধান শর্ত হল, মানুষকে তার মতো করে বাঁচতে দিতে হবে। তা যখন ক্ষুন্ন ও বাধাগ্রস্ত হয় তখন 'তারেকের অভিলাষ' এমন হওয়ায় যুক্তিযুক্ত। আল মাহমুদ যা হাজির করেছেন কবিতার আদলে, সমগ্রর অভীপ্সায়।   

'রবীন্দ্রনাথ' কবিতায় লিখেছেন, 'বুঝিনা, রবীন্দ্রনাথ কি ভেবে যে বাংলাদেশে ফের/বৃক্ষ হয়ে জন্মাবার অসম্ভব বাসনা রাখতেন।/গাছ নেই, নদী নেই অপুষ্পক সময় বইছে/পুনর্জন্ম নেই আর, জন্মের বিরুদ্ধে সবাই।' গ্রহণলাগা সময় ভাষা পেয়েছে এই কবিতায়। রবীন্দ্রনাথকে সাক্ষী মেনে জারি করা হয়েছে স্বদেশ প্রেমের শিখা জ¦ালানোর কোশেশ। কৃষক যেমন হাল চাষ করে, যাতে মেলে মুক্তি ও পুণ্যি। স্পষ্ট হয় তার দেশপ্রেম ও সাধনা। তেমনি কবির দেশপ্রেম ও সাধনা হল কবিতা সৃষ্টি করা, যার মধ্যে দিয়ে দিশায়িত হয় সমগ্র জাতির আকাক্সক্ষা। এর জন্য কবি প্রেম, প্রকৃতি, নিসর্গ, নারী, ইতিহাস, ঐতিহ্যকে দান করেন কাব্যের জীবন। তাতে দ্রোহ থাকে, জিজ্ঞাসা থাকে, থাকে বিস্ময়। কালের কলস-এসবের সঙ্গ নিয়ে ছয় দশকের উত্তুঙ্গ মুহূর্তগুলোকে দিয়েছে আবীর ও অগ্নিমন্ত্র।

আল মাহমুদ ও সৈয়দা নাদিরা বেগম (সস্ত্রীক কবি)

'নিদ্রিতা মায়ের নাম' কবিতায় সেই চিহ্নায়ন আমাদেরকে আন্দোলিত করে। কবির উচ্চারণ, 'কে নিদ্রামগ্ন আমার মায়ের নাম উচ্চারণ করো?/... রক্তাভ ফুলের মতো আমার সঙ্গীতজ্ঞ ভাইদের মুখাবয়ব/ বাঙলা... বাঙলা.../আমার নিদ্রিতা মায়ের নাম ইতস্তত উচ্চারিত হলো ...।' এই কবিতা পাঠকালে যে কোন সচেতন পাঠকের মনে পড়তে পারে আহমদ ছফার উপন্যাস 'ওঙ্কারে'র কাহিনি। যা প্রকাশিত হয় ১৯৯৩ সালে। কবিতাটি মাতৃভাষা, মাতৃভূমি 'বাঙলা'কে আরও গভীরভাবে বোঝা ও ভালবাসার দীক্ষায়িত করে আমাদের, সবাইকে। ওই সময়ের প্রেক্ষাপটে 'নিদ্রিতা মায়ের নাম' পুরো জাতির জন্য আগুনের পরশমনিতুল্য।

'প্রত্যাবর্তন' কবিতায় স্বদেশ ও সময় কথা বলেছে, জয়নুলকে সাক্ষী জ্ঞানে। 'দ্যাখো, জয়নুলের ছবির মত ঘরবাড়ি, নারী/ উঠোনে ঝাড়ছে ধান, ধানের ধুলোয় ম্লান শাড়ি;/গতর উদোম করে হাতে-লেপা মাটির চত্বরে/লাঞ্ছিত নিশেন হয়ে পড়ে আছে যেন অনাদরে।' সমগ্রর বেদনা এখানে ভাষা পেয়েছে। চিত্রিত হয়েছে বিধ্বস্ত ও স্বপ্ন হন্তা সময়। যা দেখা যায়, 'বুকের কাছে' কবিতাতেও। 'রক্ত দিতে চেয়েছিলাম বলে/মোহিনী তোর এমনি ছল যে,/সোনার থালে চাইলে টুকটুকে/টুকরো করা আমার কল্জে...।' 'কালের কলস' যেন স্বাধীনতা পূর্ববর্তী সময়কে করেছে সংহত ও সংকল্পবদ্ধ। সলতে জ¦ালিয়েছে, নিজেকে জানার-দেশকে বোঝার-ভাষাকে ভালবাসার।

আল মাহমুদের তৃতীয় গ্রন্থ 'সোনালী কাবিন' বেরোয় স্বাধীন বাংলাদেশে ১৯৭৩-এ। স্বাধীনতার পর একটা দেশের নির্মাণ কীভাবে হবে? ইতিহাসের গতিপথ বেছে নেবে কোন পথ? জাতির মর্যাদায় অতীত কীভাবে ক্রিয়া করবে? নতুন স্বপ্ন বাস্তবায়নে আবহমান বাংলা কোন বৃত্তকে প্রার্থনায় নেবে। সমগ্র-র আকাক্সক্ষা মূর্ত হবে কোন্ প্রক্রিয়ায়? এসব নিয়ে আল মাহমুদের নিজস্ব ভাবনা মুদ্রিত হয়েছে 'সোনালী কাবিন'-এ। মুক্তিযুদ্ধ ফেরত একজন কবি, কবিতার ঊষর ভূমিতে কর্ষণ করেছেন দর্শন। এই অভিপ্রায় সকল কবির, আজ ও অনাদিকালের। কিন্তু সকলের সঙ্গে আল মাহমুদ খাপে খাপে ঠিক যায় না। হয়তো তিনি যেতেও চাননি, সচেতনভাবেই। আর, একথা তো সত্যি, অন্যদের সঙ্গে গেলে কি আর বাংলা সাহিত্য 'সোনালী কাবিন' পেত? কবি ও অকবির ভিড়ে আল মাহমুদের স্বাতন্ত্র্যতা তাই বিস্ময়ের।

'লোক লোকান্তর', 'কালের কলসে' যে সময়, সমকাল ও কালান্তরকে কবি প্রার্থিত জ্ঞান করেছিলেন। 'সোনালী কাবিনে' বিনির্মাণ করতে চেয়েছেন সেসব, যোদ্ধার ধর্মে। এ কারণে 'সোনালী কাবিন' কেবল দ্রোহ, প্রেম ও যৌনতার কাব্য নয়, দেশপ্রেমেরও দীপ্র উচ্চারণ। এই তিন কাব্যগ্রন্থ যেন আল মাহমুদের কবিতার 'ট্রিলজি' বিশেষ। এসব সূর্যের আলোর মতো সত্যকথন। আল মাহমুদ জীবনভর নিজস্ব একটা দর্শন, ইচ্ছা-আকাক্সক্ষাকে অনুসন্ধান করেছেন, প্রযত্ন দিয়েছেন; সমাজ-রাষ্ট্র-ধর্মবোধ-সংস্কৃতি-ইতিহাস-ঐতিহ্যকে সাপেক্ষে রেখে। তৃতীয় কাব্যগ্রন্থে সেসব শিরদাঁড়া পেয়েছে, আগের দুটোর ধারাবাহিকতায়। এ কারণে তিনটা কাব্যগন্থকে আমরা দেখেছি 'ট্রিলজি' রূপে।  'সোনার দিনার নেই, দেনমোহর চেয়ো না হরিণী/যদি নাও, দিতে পারি কাবিনবিহীন হাত দু'টি,/আত্মবিক্রয়ের স্বর্ণ কোনকালে সঞ্চয় করিনি/আহত বিক্ষত করে চারদিকে চতুর ভ্রুকুটি;/ভালবাসা দাও যদি আমি দেব আমার চুম্বন,/ছলনা জানিনা বলে আর কোন ব্যবসা শিখিনি; ...।' (সোনলী কাবিন-০১)। 

এই উচ্চারণের ভেতর দিয়ে কি একজন প্রেমিকের পবিত্র অসহায়ত্ব প্রকাশ পেয়েছে কেবল? নাকি, মুক্তিযুদ্ধ ফেরত একজন তরুণের সেই সময়ের চালচিত্রও হাজির হয়েছে? প্রেমের কবিতা হিসেবে তারুণ্যের কাছে এর আবেদন প্রশ্নাতীত। কিন্তু তার গভীরের বেদনাও যে সর্বজনীন হয়ে উঠেছিল, সেই সত্যও সামনে আসা জরুরি, জানা প্রয়োজন।

দ্বিতীয় সনেটে কবির উচ্চারণ : 'শরমিন্দা হলে তুমি ক্ষান্তিহীন সজল চুম্বনে/মুছে দেবো আদ্যক্ষর রক্তবর্ণ অনার্য প্রাচীন।/বাঙালি কৌমের কেলি কল্লোলিত কর কলাবতী/জানতো না যা বাৎসায়ন, আর যত আর্যের যুবতী।' প্রেম,কাম, যৌনতা, রতিক্রিয়া এই কবিতার মূল উপজীব্য বিষয়। এমনটাই মনে করেন অনেকে। খোন্দকার আশরাফ হোসেন লিখেছেন যেমনটা : ''সোনালী কাবিন' সাম্প্রতিক কবিতা-ইতিহাসের সর্বাপেক্ষা দ্রোহী কবিতা, কেননা আল মাহমুদ এমন একজন শক্তিশালী অর্জুন, যিনি কামনা যৌনতার ধনুতেও অনায়াসে বিপ্লবের ছিলা পরাতে পারেন, অথবা বিপ্লবের বল্লমের ফলায় খচিত করতে পারেন রতির কারুকাজ।' এই মন্তব্যে যুক্তি আছে, বিশ্লেষণও তারিফযোগ্য। কিন্তু পুরোপুরি একমত হওয়ার অবকাশ নেই।

'সোনালী কাবিন' মূলত ইতিহাস-ঐতিহ্যাশ্রয়ী কাব্য। এর মূল স্বর অতীত অন্বেষণ ও আত্মাবিস্কার। যার সাক্ষ্য মেলে এভাবে : 'যে বংশের ধারা বেয়ে শ্যাম শোভা ধরেছো, মানিনী/একদা তারাই জেনো গড়েছিল পুন্ড্রের নগর/মাটির আহার হয়ে গেছে সব, অথচ জানিনি/কাজল জাতির রক্ত পান করে বটের শিকড়।/আমারও আবাস জেনো লোহিতাভ মৃত্তিকার দেশে/পূর্ব পুরুষেরা ছিলো পাট্টীকেরা পুরীর গৌরব,/রাক্ষসী গুল্মের ঢেউ সবকিছু গ্রাস করে এসে/ঝিঁঝির চিৎকার বাজে অমিতাভ গৌতমের স্তব। অতীতে যাদের ভয়ে বিভেদের বৈদিক আগুন/করতোয়া পার হয়ে এক কঞ্চি এগোতো না আর,/তাদের ঘরের ভিতে ধরেছে কি কৌটিল্যের ঘুণ?/ললিত সাম্যের ধ্বনি ব্যর্থ হয়ে যায় বার বার : /বর্গীরা লুটছে ধান নিম খুনে ভরে জনপদ/তোমার চেয়েও বড়ো হে শ্যামাঙ্গী, শস্যের বিপদ।' (সোনালী কাবিন-০৯)। কবিতাটা খুব একটা বড় নয়, সনেট বলে নেই সেই সুযোগও। অথচ একটা জাতির ইতিহাসের প্রার্থিত স্বর ও সুর ধরা পড়েছে এই ক্ষুদ্রায়তনে। যার মধ্যে দিয়ে কবি বর্তমানের ইতিহাসকে কীভাবে রাঙায়িত করতে চান তার বাসনাও জারি রয়েছে।

একটা কল্যাণ রাষ্ট্রে, জনগণ বান্ধব দেশে, দেশজ সংস্কৃতির চর্চায় এগুলো যে অপরিহার্য ও অনিবার্য তা স্পষ্ট করেছে এই কবিতা। 'প্রকৃতি' কবিতায় দেখা যায় কৃষকের প্রতি কবির হার্দিক টান ও অনুভব। 

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সেই উক্তি স্মরণীয়, 'সহজ কথা কইতে আমায় কহ যে, সহজ কথা যায় না বলা সহজে।' আল মাহমুদ ' সোনালী কাবিন'-এ অনেক কঠিন কথা অনেক সহজ ভাষায় বলেছেন। ঠাকুরই তো বলেছেন, 'সেই সত্য যা রচিবে তুমি, ঘটে যা তা সব সত্য নহে। কবি, তব মনোভূমি, রামের জন্মস্থান অযোধ্যার চেয়ে সত্য জেনো।' সনেট দশ-এ কবির উচ্চারণ: 'শ্রমিক সাম্যের মন্ত্রে কিরাতের উঠিয়াছে হাত/হিয়েনসাঙের দেশে শান্তি নামে দেখো প্রিয়তমা,/এশিয়ায় যারা আনে কর্মজীবী সাম্যের দাওয়াত/তাদের পোশাকে এসো এঁটে দিই বীরের তকমা/আমাদের ধর্ম হোক ফসলের সুসম বন্টন,/পরম স্বস্তির মন্ত্রে গেয়ে ওঠো শ্রেণীর উচ্ছেদ,/এমন প্রেমের বাক্য সাহসিনী করো উচ্চারণ/ যেন না ঢুকতে পারে লোকধর্মে আর ভেদাভেদ।' পুরো কবিতাটার অংশ বিশেষ হাজির রয়েছে এখানে। তার পরও উদ্ধৃতাংশেই ইতিহাস-ঐতিহ্যের পথ বেয়ে কবির আশা স্পষ্ট হয়েছে।

সমাজতন্ত্রের প্রতি পক্ষপাত। ফসলের সুসম বন্টনের ইচ্ছে। লোকধর্মে ভেদাভেদ না থাকার প্রত্যাশা। সব একসূত্রে গ্রথিত হয়ে হাজির করেছে বৃহৎ এক স্বপ্নকে, যা ব্যক্তির এবং সমষ্টির সর্বজনীন এক চাওয়া। একটা কল্যাণ রাষ্ট্রে, জনগণ বান্ধব দেশে, দেশজ সংস্কৃতির চর্চায় এগুলো যে অপরিহার্য ও অনিবার্য তা স্পষ্ট করেছে এই কবিতা। 'প্রকৃতি' কবিতায় দেখা যায় কৃষকের প্রতি কবির হার্দিক টান ও অনুভব। 

যেমন : 'কতদূর এগোলো মানুষ!/কিন্তু আমি ঘোরলাগা বর্ষণের মাঝে/আজও উবু হয়ে আছি। ক্ষীরের মতন গাঢ় মাটির নরমে/কোমল ধানের চারা রুয়ে দিতে গিয়ে/ভাবলাম, এ-মৃত্তিকা প্রিয়তমা কিষাণী আমার...।' সভ্যতা যতই এগিয়ে যাক, কৃষির বাইরে যে যাওয়া যাবে না। মানুষের শেকড় যে কৃষিতেই বাঁধা, তারই সহজিয়া উচ্চারণ রয়েছে এসব পংক্তিতে। জীবন ও প্রকৃতিকে নিবিড়ভাবে দেখা, বোঝার নান্দীপাঠ করেছেন হাজির।

আল মাহমুদের 'প্রত্যাবর্তনের লজ্জা' কবিতা যেন সকল তরুণের ব্যক্তিগত এক ইশতেহার। যা থাকাটাই নন্দনযোগ্য। না থাকলে লজ্জা যে কখনও কখনও কত বড় আনন্দের, তা অনুভব করা মুস্কিল। কবি বলেছেন, 'কুয়াশার শাদা পর্দা দোলাতে দোলাতে আবার আমি ঘরে/ফিরবো/আর আমি মাকে জড়িয়ে ধরে আমার প্রত্যাবর্তনের/ লজ্জাকে/ঘষে ঘষে/তুলে ফেলবো'। ব্যক্তিগত লজ্জা যেমন মার আদরে ঘষে ঘষে তুলে ফেলতে হয়। তেমনি সমষ্টির লজ্জাকেও তুলে ফেলতে হয়। তা না হলে বন্ধন রচিত হয় না। সম্পর্কের গাঢ়তা ফিকে হয়ে আসে। প্রত্যাবর্তনের লজ্জা থাকাটাই ভাল না থাকাটাই লজ্জার। এই সত্য যেমন ব্যক্তির জন্য প্রযোজ্য, তেমনই প্রযোজ্য সমষ্টির, প্রতিষ্ঠানের, সমাজের, রাষ্ট্রের ক্ষেত্রেও।

চতুর্থ কাব্যগন্থে হাজির হন অন্য এক আল মাহমুদ। ততদিনে বদলে গেছে স্বপ্নের স্বাধীন বাংলাদেশ। বদলে গেছেন তিনিও। প্রথম, দ্বিতীয়, তৃতীয় কাব্যগ্রন্থে যে রেখা অংকিত হয়েছিল, পুষ্টি নিয়েছিলেন ইহজাগতিকতা থেকে, বাংলা সংস্কৃতির যে কালপর্বকে তিনি জ্ঞান করেছিলেন বিনির্মাণের পাথেয়। সেখান থেকে নিলেন ইউটার্ন।

কবির সেই স্বাধীনতা রয়েছে। শুধু কবি কেন, সকলেরই এই অধিকার রয়েছে। শুধু দেখার বিষয় তা যেন সাংঘর্ষিক ও অপরের জন্য ক্ষতিকর না হয়। অবশ্য, যে 'চিহ্নায়নে'র ভিত্তিতে আমরা যাকে বলছি ইউটার্ন, তা কি কবির ভেতরে আগে থেকেই ছিল ? ১৯৭৬-র পূর্বাপর ঘটনাবলী তাকে কেবল উন্মোচন ও প্রকাশ্যে নিয়ে এল। আল মাহমুদের কবি জীবনের পরিক্রমণ কী বলে? আগে থেকেই ছিল নিশ্চয়। কবি শুধু খুঁজে নিলেন আপন তাড়নার গন্তব্য নোঙ্গরভূমি।

কবি তখন ফসলের সুসম বন্টনের স্বপ্নে আর বিভোর নন। হিউয়েন সাঙয়ের দেশ নিয়ে নেই কোন উচ্ছ্বাস-আতিশয্যও। লোক ধর্মের ভেদাভেদে হন না আহত ও ব্যথাতুর। কারণ, কবির সামনে তখন দুলে উঠেছে মায়াবী পর্দা।

দুলে উঠলো পাঠক, দুলে উঠলো কবিতা। কবি লিখলেন 'মায়াবী পর্দা দুলে ওঠো', প্রকাশিত হল ১৯৭৬-এ। 'আমার মাথা' কবিতায় হাজির করলেন নিজের অনুভব। বললেন, 'আজকাল এমন হয় যে, আমার মাথা আমি আর/নামাতেই পারি না ...।'
'মায়াবী পর্দা দুলে ওঠো'তে আবিস্কার করলেন, 'পৃথিবীর সর্বশেষ ধর্মগ্রন্থটি বুকের ওপর রেখে আমি ঘুমিয়ে পড়েছিলাম... মায়াবী পর্দা দুলে উঠলো, যার ফাঁক দিয়ে যে দৃশ্যই চোখে পড়ে তোমরা বলো স্বপ্ন;'। কবি তখন 'সোনালী কাবিন' এর আকাক্সক্ষা, দায়-দায়িত্ব ও কর্তব্যবোধ থেকে অনেক দূরের বাসিন্দা। যে কবি ছিলেন, ইহজাগতিকতাকে বিনির্মাণের স্বপ্নে প্রতিজ্ঞ, প্রতিশ্রুতিবদ্ধ ও লক্ষ্যভেদি এক নাবিক। ১৯৭৬-এ পারলৌকিক বোধ ও ধারণাকে সন্তুষ্ট করায় হয়ে উঠল সেই কবির অভিপ্রায়। এই পরিবর্তনকে কি 'মোচড়হীন' বলা যুক্তিযুক্ত হবে? হবে না, নিশ্চয়।

কবি তখন ফসলের সুসম বন্টনের স্বপ্নে আর বিভোর নন। হিউয়েন সাঙয়ের দেশ নিয়ে নেই কোন উচ্ছ্বাস-আতিশয্যও। লোক ধর্মের ভেদাভেদে হন না আহত ও ব্যথাতুর। কারণ, কবির সামনে তখন দুলে উঠেছে মায়াবী পর্দা।
কবির পঞ্চম কাব্যগ্রন্থ প্রকাশিত হয় ১৯৮০-তে 'অদৃষ্টবাদীদের রান্নাবান্না'। 'মায়াবী পর্দা দুলে ওঠো' দর্শনের সম্পসারণ যার শরীরজুড়ে। 'ইহুদিরা' কবিতায় বললেন, 'অনিষ্টকর অন্ধকারে যখন পৃথিবী/আচ্ছন্ন হয়ে যায়, চারদিকে ডাইনীদের/ফুৎকারের মতো হাওয়ার ফিসফাস, আর পাখিরা গুপ্ত সাপের আতঙ্কে/আশ্রয় ছেড়ে অন্ধকারে ঝাঁপ দেয়/ঠিক তখুনি, ইহুদিরা হেসে ওঠে...।' এই কবিতায় আমাদেরকে অন্য এক উপলব্ধি ও বাস্তবতার মুখোমুখি দাঁড় করান কবি। যা ভাবায়, বিবিধ চিন্তার অগণন গিট্টুকে হাজির করে। আমরা সংশয়িত ও দ্বিধান্বিত হই। কেননা, ব্যক্তির কোন দোষ সকলের ওপর পড়ছে কি না, কিংবা সষ্টির কোন একটা অংশের দোষ সমগ্রর ওপর চাপিয়ে দেওয়া হচ্ছে কি না, মুখোমুখি হতে হয় সেই জিজ্ঞাসারও।

'আমার উদ্যোগ' কবিতায় বলা হল, 'কোনো উদ্যোগই আর প্রস্ফুটিত হয় না।/বীজ বপনের ক্ষেত্রগুলোও আমি ভুলে গেছি/যেমন চাঁদে-পাওয়া চাষী ভুলে যায় নিজের কর্ষিত ভূমি/অনেকটা তেমনি...।' এই কবিতাটা কি কবির আত্মবিশ্লেষণের স্বরূপ সন্ধান? এখন আর তা পরিস্কার করে জানার উপায় নেই। তবে, হওয়াটাই স্বাভাবিক ও সঙ্গত। ততদিনে জাতীয়তাবাদের প্রশ্নে জাতির সামনে হাজির হয়েছে বিভাজিত রূপ। বাঙালি জাতীয়তাবাদ আর বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদ। আল মাহমুদ দ্বিতীয়টার পক্ষে।

ফিরে যেতে হয় শুরুর আলোচনায়। সময়, সমকালকে আলিঙ্গণের অভিপ্রায় ছিল কবির।  এ কারণে এক জীবনে একাত্ম হয়েছে অনেক কিছুর সঙ্গে। তবে কবিতাকে ছেড়ে নয়, ভরকেন্দ্রে রেখেই। কবিতাকে সঙ্গে নিয়ে বুঝতে চেয়েছেন জীবন ও জগতের দর্শন, কী অর্থ এসবের? এ কারণেই আল মাহমুদের কলমে সৃষ্টি হয়েছে কালজয়ী সব কবিতা। সবচেয়ে বেশী সংখ্যক পাঠকপ্রিয়-জনপ্রিয় কবিতার ¯্রষ্টা তিনি। স্মরণ করা যেতে পারে, 'একুশের কবিতা'র অংশবিশেষ: 'ফেব্রুয়ারির একুশ তারিখ/দুপুর বেলায় অক্ত/বৃষ্টি নামে, বৃষ্টি কোথায়?/বরকতের রক্ত/...প্রভাতফেরীর মিছিল যাবে/ছড়াও ফুলের বন্যা/বিষাদগীতি গাইছে পথে/তিতুমীরের কন্যা।/চিনতে না কি সোনার ছেলে/ক্ষুদিরামকে চিনতে?/রুদ্ধশ^াসে প্রাণ দিলো যে/মুক্ত বাতাস কিনতে?/...প্রভাতফেরী, প্রভাতফেরী/আমায় নেবে সঙ্গে,/বাংলা আমার বচন, আমি/জন্মেছি এই বঙ্গে।'

বাংলা সাহিত্যে অনেক কবির 'সিগনেচার' পোয়েম রয়েছে। জীবনানন্দ দাশ বলতেই হাজির হয় 'বনলতা সেন'। কাজী নজরুল ইসলামের সঙ্গে 'বিদ্রোহী'। সুকান্তের সঙ্গে 'ছাড়পত্র'। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সঙ্গে 'সোনার তরী'। শামসুর রাহমানের সঙ্গে 'স্বাধীনতা তুমি'। জসীম উদ্দীনের সঙ্গে 'কবর'। কিন্তু আল মাহমুদের বেলায় এভাবে বলা মুস্কিল ও দুরুহ। কারণ, উনার 'সিগনেচার' পোয়েমের সংখ্যা একাধিক। নির্দিষ্ট করে কোন একটির কথা বলা দুরুহ। তা হলে কোনটা হতে পারে? সোনালী কাবিনের সনেটগুচ্ছ? তার মধ্যে কোনটি? এক, নাকি দশ? 'প্রত্যাবর্তনের লজ্জা', নাকি 'খড়ের গম্বুজ'? 'নোলক' নাকি 'কবিতা এমন'? এভাবে সংখ্যা বাড়বে। তারপরও কি বলব, আল মাহমুদ 'মোচড়হীন' কবি প্রতিভা।

Comments