যে জীবন বাবা-মায়ের একমাত্র সন্তানের

ছবি: সংগৃহীত

বাবা-মায়ের একমাত্র সন্তান হওয়ার ভালো ও মন্দ উভয় দিকই আছে। অবশ্য সবটাই ব্যক্তির অভিজ্ঞতার মুখাপেক্ষী। বাবা-মায়ের একমাত্র সন্তান হলে অধিকাংশেরই ভাগ্যে জোটে নিরবচ্ছিন্ন মনোযোগ এবং এই মনোযোগের ফলে সন্তানের মধ্যে ইতিবাচক ও নেতিবাচক উভয় ধরনের প্রভাবই পড়ে।

`নদীর এপার কহে' বা সুবিধা

`দুটি সন্তানের বেশি নয়, একটি হলে ভালো হয়।' বাংলাদেশের পরিবার পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের এই বার্তাটি মনে আছে তো? শুধু জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণের বৃহত্তর স্বার্থেই নয়, ব্যক্তিগত চাহিদা পূরণেও ব্যস্ত জীবনে একাধিক সন্তানকে যথেষ্ট মনোযোগ বা যত্নের মাধ্যমে বড় করা না সম্ভব হলে আধুনিক জমানায় একটি সন্তানকেই ঠিকভাবে লালন-পালন করাটাই হয়তো বিচক্ষণের কাজ। বহু বছর আগের লেখা, যোগীন্দ্রনাথ সরকারের সেই ছড়াটিতে যদি 'হারাধনের দশটি ছেলে' না থাকত, তবে যে তার শেষ ছেলেটিকে হয়তো মনের দুঃখে বনে যেতে হতো না! হারাধন ও তার স্ত্রীও সন্তানের প্রতি যথেষ্ট খেয়াল রাখতে পারতেন!

পারিবারিক জীবনে একে অন্যের প্রতিদিনের অভিজ্ঞতাকে সমৃদ্ধ করে তোলা হোক, খুনসুটিতে মেতে থাকা হোক বা নিছক একত্রে বসবাস হোক, আমাদের বেড়ে ওঠার গল্পে, অন্তত পরিবারে সহযাত্রী হিসেবে সর্বাগ্রে থাকে ভাই-বোনেরা। কিন্তু এই 'একলা সন্তান'দের জীবনে ভাই-বোন না থাকায় তাদের সঙ্গে সময় আর গল্প ভাগ করে নেওয়া যায় না যেহেতু, সেহেতু ছোটবেলা থেকেই সন্তান বাবা-মায়ের সঙ্গে বেশি ঘনিষ্ঠ থাকে। ছোট-বড় মনের সব ভাবনাই তাদের সঙ্গে ভাগ করে নেয়। তবে সেজন্য বাবা-মায়ের ব্যক্তিত্ব কতটা বন্ধুসুলভ, এ বিষয়টিও গুরুত্বপূর্ণ। যে সন্তানরা বাবা-মাকে বন্ধু হিসেবে পায়, তাদের জন্য জীবন যে অনেকটা বেশি সহজ, এতে কোনো সন্দেহ নেই।

এমনিতেও দিন দিন যৌথ পরিবারের ধারণা পালটে মানুষ গতিময়তার সঙ্গে তাল মিলিয়ে ক্ষুদ্র পরিবারের দিকে ঝুঁকেছে। আগে যেভাবে যৌথ পরিবারে অনেকগুলো সন্তান বড় করা খুব অনায়াসে হয়ে যেত, এখন তেমনটা হচ্ছে না। ক্ষুদ্র পরিবারের ধারণার সঙ্গেও একটি সন্তান নেওয়ার বিষয়টি মিলে যায়।

ওপারের গল্প কিংবা অসুবিধা

স্বাভাবিকভাবেই, একটি মাত্র সন্তান হলে বাবা-মা তাদের প্রতি একটু বেশিই যত্নশীল হয়ে থাকেন। তাদের জীবনের প্রায় সব কিছুই যেন সেই সন্তানকে ঘিরে ঘুরপাক খায়। এই অতি মনোযোগ কখনো কখনো হিতে বিপরীত পরিস্থিতিরও জন্ম দিতে পারে। সন্তানকে অধিক মাত্রায় নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা, আবেগীয়ভাবে বাবা-মায়ের প্রতি অতি-নির্ভরতা ইত্যাদি মানসিক বিষয়াবলী একজন ব্যক্তির সুস্থভাবে বেড়ে ওঠাকে ব্যাহত করতে পারে।

এমনকি এই ব্যক্তিদের ক্ষেত্রে 'ওনলি চাইল্ড সিনড্রোমের' মতো অতিমাত্রিক ধারণাও রাখেন অনেকে। যেমনটা দেখা যায় ১৮ শতকের দিকে পরিচালিত একটি শিশু বিষয়ক গবেষণা থেকে। সেখানে গবেষক ই ডব্লিউ বোহানোন ভাইবোন নেই, এমন শিশুদের মধ্যে নেতিবাচক আচরণগত বৈশিষ্ট্য চিহ্নিত করেছিলেন। এ গবেষণা অনুযায়ী, সবসময় মনোযোগের কেন্দ্রবিন্দুতে থাকা এই শিশুরা অন্যদের চাইতে কম সহযোগী মনোভাব পোষণ করে। তবে মনোবিজ্ঞানের পরবর্তী পর্যায়ে এটিকে একটি স্টেরিওটাইপড বা ছাঁচিকৃত ধারণা হিসেবে দেখা হয়। যার উত্তর মিলতে পারে 'প্যারেন্টার রেসপন্স টু ওনলি চিলড্রেন: ব্রেকিং দ্য স্টেরিওটাইপস' এর মতো গবেষণাপত্রগুলোতে।

তবে এটুকু বলা নিরাপদ যে, বোহানোনের এই অনুমান বা সিদ্ধান্ত সবক্ষেত্রে ভুল নয়। বিশেষ করে বাবা-মা যদি এই শিশুদেরকে প্রয়োজনের চেয়ে বেশি মনোযোগের মধ্যে লালন-পালন করে থাকেন, তবে এই অনুমান অনেকটাই সত্যি হতে পারে। এক্ষেত্রে ভারসাম্য রক্ষা করতে পারাটা একটি বিশেষ চ্যালেঞ্জ, ঠিক যেমন একাধিক সন্তানের ক্ষেত্রেও ঘটে থাকে।

সব মুদ্রারই থাকে এপিঠ-ওপিঠ। অন্নদামঙ্গল কাব্যের ঈশ্বরী পাটনির সেই উক্তিটি আজ মুখে মুখে ফেরে, 'আমার সন্তান যেন থাকে দুধে-ভাতে'।  কারণ সকল বাবা-মা এই একই আশাবাক্যে মন ভরেন, তা যতগুলো সন্তানই তাদের ঘরে থাকুক না কেন। একটি সন্তান হোক বা একাধিক, অনেকটাই বাবা-মায়ের লালন-পালনের পদ্ধতির ওপর নির্ভর করে যে এই শিশুরা ভবিষ্যতে কী ধরনের প্রাপ্তবয়স্ক ব্যক্তিতে পরিণত হতে যাচ্ছে।

 

Comments

The Daily Star  | English

Govt publishes gazette of 1,558 injured July fighters

Of them, 210 have been enlisted in the critically injured "B" category, while the rest fall under the "C" category of injured fighters

1h ago