টিনএজার সন্তানের সঙ্গে দূরত্ব-মতের অমিল, বাবা-মায়ের জন্য পরামর্শ

ছবি: স্টার

শৈশব ও প্রাপ্তবয়স্ক হওয়ার পথে যোগসূত্র স্থাপন করে মানুষের কৈশোরকাল বা টিনএজ। এ সময় কিশোর-কিশোরীদের মধ্যে বিভিন্ন শারীরিক ও মানসিক পরিবর্তন আসতে শুরু করে। এই পরিবর্তনের সঙ্গে তাদের আচরণেও বেশকিছু পরিবর্তন আসে, যার সঙ্গে মানিয়ে নিতে অভিভাবকদের বেশ হিমশিম খেতে হয়।

এ সময়টা টিনএজারদের নিজস্ব পরিচয়ের বিকাশ ঘটতে শুরু করে, বাবা-মায়ের প্রতি নির্ভরশীলতা কমতে থাকে, তাদের নিজস্ব জগত তৈরি হয়। বাবা-মায়ের সঙ্গে নানা বিষয়ে মতের অমিল হয়, ঘন ঘন হতে পারে মনোমালিন্য। এ সময়টা বাবা-মায়ের জন্য একটু চ্যালেঞ্জিং। যেহেতু সময়টা অনেক গুরুত্বপূর্ণ, সন্তানের সুষ্ঠু বিকাশের জন্য তাদের একটু কৌশলী হতে হবে। পরিস্থিতি সামলে নিতে হবে ধৈর্য ধরে।

এ বিষয়ে বাবা-মাদের জন্য পরামর্শ দিয়েছেন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের স্টুডেন্ট কাউন্সিলিং ও পরামর্শ কেন্দ্রের উপপরিচালক (মনোবিজ্ঞান) ইফরাত জাহান।

ইফরাত জাহান বলেন, 'একটি শিশু যখন কৈশোরে পা দেয়, তার মধ্যে বেশকিছু পরিবর্তন আসতে শুরু করে। এই পরিবর্তনগুলো পরিবার ও সমাজ ভিন্ন চোখে দেখে। কখনো মা বলেন, ''তুমি অনেক বড় হয়ে গেছ'', কখনো বাবা বলছেন, ''তুমি তো এখনো ছোট''। তারা কী ছোট না বড়, এই মানসিক দ্বন্দ্ব তাদের মধ্যে আইডেন্টিটি ক্রাইসিস তৈরি করে।'

টিনএজার সন্তানের প্যারেন্টিংয়ের ক্ষেত্রে কিছু বিষয় খেয়াল রাখা উচিত। এগুলো হলো-

আলাদা মানুষ হিসেবে ভাবুন

টিনএজারদের সঙ্গে বাবা-মায়ের দূরত্ব তৈরি হওয়ার সবচেয়ে বড় কারণগুলোর মধ্যে একটি হচ্ছে, বাবা-মা তাদেরকে আগের মতোই নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করেন এবং সন্তানরা সেটি কোনোভাবেই মানতে চায় না। এ ক্ষেত্রে বাবা-মার করণীয় হচ্ছে, এত বছর যেভাবে আপনার সন্তানকে লালনপালন করে এসেছেন, সেই সাধারণ নিয়ম আস্তে আস্তে বদলাতে শুরু করুন। এ সময় বাচ্চারা কখনো খিটখিটে আচরণ করে, কখনো অত্যন্ত আনন্দিত থাকে, কখনো বা অভিমানে গাল ফুলিয়ে বসে। এই আচরণগুলো স্বাভাবিক ধরে রেখে তাদের সাথে কথা বলুন। বিরক্তি তৈরি হলেও মনে রাখুন, আপনার সন্তান আর ছোট্ট শিশুটি নেই, সে বড় হতে শুরু করেছে। তাকে একজন আলাদা মানুষ হিসেবে মূল্যায়ন করার অর্থ হলো তাদের নিজস্ব চিন্তাভাবনা এবং অনুভূতিকে স্বীকৃতি দেওয়া।

এই নিজস্ব চিন্তাভাবনা ও অনুভূতি যে আপনার চিন্তাভাবনা ও অনুভূতি থেকে একেবারেই আলাদা হতে পারে সেটি মেনে নিন। তাকে বুঝতে চেষ্টা করুন। তার সব বিষয়ে নিয়ন্ত্রণ করার চেষ্টা থেকে সরে আসুন।

এ ব্যাপারে মনোবিদ ইফরাত জাহান বলেন, 'কিশোর বয়সে বন্ধুদের নিয়ে আলাদা জগত তৈরি হয়। বাবা-মায়ের ওপর নির্ভরশীলতা কমতে থাকে, যা অনেক অভিভাবক মেনে নিতে পারেন না। তারা সন্তানের সঙ্গে রাগারাগি করেন। কিন্তু এতে হিতে বিপরীত হয়। তাই বাবা-মায়ের উচিত সন্তানের যেকোনো ইতিবাচক পরিবর্তনকে গ্রহণ করা।'

বন্ধু হয়ে উঠার চেষ্টা করুন

কিশোর বয়সীদের সঙ্গে বাবা-মায়ের বন্ধুত্বপূর্ণ আচরণ তাদের মানসিক স্বাস্থ্যের জন্য খুবই প্রয়োজনীয়। বিভিন্ন গবেষণায় দেখা গেছে, যে টিনএজারদের পরিবারের সঙ্গে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক যত বেশি, তাদের মানসিক কষ্ট, হতাশায় ভোগার প্রবণতা তত কম।

এ ব্যাপারে মনোবিদ ইফরাত জাহান বলেন, 'কিশোর-কিশোরীদের বাবা-মাকে প্রয়োজন হয় সবচেয়ে বেশি। কিন্তু এ সময়টাতে আমরা অভিভাবকরা সন্তানদের শাসনের মধ্যে রাখতে চাই। তাদের সঙ্গে বন্ধুসুলভ আচরণ না করে উপদেশ দিই, যা বাচ্চারা পছন্দ করে না। এতে করে তাদের ধারণা হয়, বাবা-মা আমাকে বোঝে না। ফলশ্রুতিতে সন্তানের সঙ্গে বাবা-মায়ের দূরত্ব তৈরি হয়।'

আলোচনা করে সীমানা নির্ধারণ করে দিন

কী করতে হবে বলে দেওয়া পছন্দ করে না টিনএজাররা। তারা মনে করে, তারাই সবকিছু ভাল জানে। কিন্তু বাবা-মা সবক্ষেত্রে তাদের যা পছন্দ তা-ই করতে দিতে পারেন না। এক্ষেত্রে একটু কৌশলী হতে হবে। সমস্যা তৈরি করতে পারে এমন কোনো কাজ না হলে তাদেরকে কাজটা  করার অনুমতি দিতে পারেন, কিন্তু কিছু সীমানা বেঁধে দিয়ে।

যেমন-তারা যদি বন্ধুদের সঙ্গে বাইরে ঘুরতে যেতে চায়, তাহলে কোথায়, কখন এবং কার কার সঙ্গে যেতে পারবে এবং কোন সময় তাদের বাড়িতে ফিরতে হবে তার সীমা নির্ধারণ করে দিন।

সোশ্যাল মিডিয়া ব্যবহারের ক্ষেত্রেও বিষয়টি এমনই। তাদের সময়, স্থান, পরিস্থিতি বুঝে সেটি ব্যবহার করতে দিন। একেবারে দেবেনই না, এমনভাবে চিন্তা করবেন না। আবার তাদের যখন ইচ্ছা ব্যবহার করবে এতটা ছাড়ও দেবেন না। যেমন- দীর্ঘ ভ্রমণে তাদের স্মার্টফোনে সোশ্যাল মিডিয়া ব্যবহার করতে দিন। কিন্তু রাতের খাবার টেবিলে এটি করা যাবে না বলে দিন।

শুধু নিষেধাজ্ঞা নয়, ব্যাখ্যা দিন

অভিভাবকরা সাধারণত টিএনএজারদের কোনো কাজে বাধা প্রদান বা উপদেশ দিয়েই নিজেদের দায়িত্ব শেষ হয়েছে বলে মনে করেন। কিন্তু কোনো কাজ কেন ক্ষতিকর, কেন আপনি এটি করতে নিষেধ করছেন তার কারণ উল্লেখ করাও জরুরি। তাহলে তারা বিষয়টি বুঝতে চেষ্টা করবে এবং আপনাকে ভুল বুঝবে না।

মনোবিদ ইফরাত জাহান বলেন, 'কিশোর-কিশোরীর ওপর কোনকিছু চাপিয়ে না দিয়ে বরং ভালোভাবে তা ব্যাখ্যা করা উচিত। উপদেশ কমিয়ে বাবা-মায়ের উচিত সন্তানকে বুঝিয়ে বলা। কেন আপনি বিষয়টি নিয়ে খুশি নন, বা কেন তাকে এ কাজে বাধা দিচ্ছেন তা স্পষ্ট করুন। এতে অভিভাবকদের মনোভাবও সন্তান বুঝতে পারবে।'

Comments

The Daily Star  | English

Battery-run rickshaw drivers block traffic in different parts of Dhaka

They took to the streets in the Agargaon, Mohammadpur, Jatrabari, and Jatiya Press Club areas

18m ago