টক্সিক সম্পর্ক কী, সরে আসাই কি একমাত্র সমাধান
আজকাল একজোড়া শব্দ প্রায়ই সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ঘুরতে দেখা যায়। আর তা হলো 'টক্সিক রিলেশনশিপ'। মনের ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলে, ব্যক্তির স্বাভাবিক জীবনযাত্রা ব্যাহত হয়, এমনকি সামাজিকভাবেও হেয় করে- এমন সম্পর্ককে টক্সিক রিলেশনশিপ বা টক্সিক সম্পর্ক বলা যেতে পারে।
টক্সিক সম্পর্ক কী
ব্যক্তিভেদে সম্পর্কের ধরন ভিন্ন হয়, সম্পর্কের সংজ্ঞাও একেকজনের কাছে একেক রকম। তবে আপনার সঙ্গী যদি প্রতিনিয়ত আপনাকে ছোট করে কথা বলে, যেকোনো কাজে জবাবদিহিতা চায় এবং নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে, সবসময় আপনাকে সন্দেহের দৃষ্টিতে দেখে এমন সম্পর্ককে টক্সিক বলা যায়।
এ বিষয়ে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী কল্যাণ ও পরামর্শদান কেন্দ্রের উপপরিচালক (মনোবিজ্ঞান) শুভাশীষ কুমার চ্যাটার্জি বলেন, 'টক্সিক রিলেশনশিপ শব্দ দুটি খুব প্রচলিত হলেও খুব জাজমেন্টাল। সাইকোলজিতে এ ধরনের টার্ম আমরা ব্যবহার করি না। তবে বিভিন্ন সময় সম্পর্কের টানাপোড়েন নিয়ে অনেকেই আসেন। তাদের মধ্যে অনেকে আছেন যারা তাদের সঙ্গীর আচরণে মানসিকভাবে খুব পীড়ায় আছেন, তাদের আত্মবিশ্বাস কমে গেছে, কিন্তু তবুও তারা সেই সম্পর্ক থেকে বের হতে পারছেন না। এটা অনেকটা গোলকধাঁধার মত। যতই আপনি বের হওয়ার রাস্তা খুঁজুন না কেন, চাইলেও পারছেন না। এ ধরনের সম্পর্ককে আমরা টক্সিক রিলেশনশিপ বলতে পারি।'
কীভাবে বুঝবেন আপনার সম্পর্ক টক্সিক
সম্পর্ক মানেই বিশ্বাস, ভরসা আর স্বস্তির একটি জায়গা। তা হোক বন্ধুত্বের সম্পর্ক কিংবা ভালোবাসার। কিন্তু এই সম্পর্ক যদি আপনাকে তিনটি উপাদানের একটি দিতেও ব্যর্থ হয় তবে বুঝতে হবে, কোথাও সমস্যা আছে।
মনোবিদ শুভাশীষ কুমার চ্যাটার্জি বলেন, 'আপনার কাছে যে আচরণটি অস্বাভাবিক মনে হবে, আরেকজনের কাছে এটি খুব স্বাভাবিক মনে হতে পারে। যেমন- অনেক সম্পর্ক আছে যেখানে সঙ্গী বলে দেয় কেমন পোশাক পরবেন, কোথায় যাবেন, কার সঙ্গে মিশবেন। এটি আপনার কাছে ডমিনেটিং মনে হতে পারে। কিন্তু ওই ব্যক্তি হয়তো এটাকে ভালবাসা বলে ভাবছেন।'
তিনি আরও বলেন, 'সব সম্পর্কেই মনোমালিন্য হয়। শতভাগ ঠিকঠাক সম্পর্ক বলে তো কিছু হয় না। কোনো ঝগড়ার পর ভুল যারই থাকুক না কেন যদি একজনই বারবার সম্পর্ক স্বাভাবিক রাখতে ভুল স্বীকার করে নেন, তবে বুঝতে হবে সম্পর্কের প্রতি ওই ব্যক্তিই বেশি যত্নশীল। আবার সবসময় সঙ্গীকে ছোট করে কথা বলা, তার সাফল্যকে হুমকি মনে করা, সবার সামনে অসম্মান করে কথা বলা কিংবা সঙ্গীকে কেউ অসম্মান করলে কোনো প্রতিবাদ না করা এ সবই সম্পর্কের জন্য ক্ষতিকর। সম্পর্কে মানসিক নিরাপত্তা না থাকলে সেটি আপনার মনের জন্য মোটেই ভালো নয়।'
কীভাবে টক্সিক রিলেশনশিপ থেকে সরে আসা যায় এ ব্যাপারে জিজ্ঞেস করা হলে মনোবিদ শুভাশীষ কুমার চ্যাটার্জি বলেন, `এমন অনেক ঘটনা পেয়েছি যেখানে ছেলেটি মেয়েটির গায়ে হাত তোলেন। কিন্তু তারপরও মেয়েটি সম্পর্ক থেকে বেরিয়ে আসতে পারেন না। কারণ পরক্ষণেই ছেলেটি তার ভুল বুঝতে পারেন এবং এমন আর কখনো হবে না এই ধরনের প্রতিশ্রুতি দেন। মেয়েটিও আবেগপ্রবণ হয়ে বিশ্বাস করে নেন। কিন্তু জেনে রাখা ভালো, এরকম সমস্যা সাধারণত মেটে না। কারণ যে একবার গায়ে হাত তুলতে পারে, সে বারবার পারবে।'
'এমন কিছু ছেলেও আছে, যাদেরকে তাদের মেয়ে সঙ্গী দিনের পর দিন আঘাত করে কথা বলছে, বিশ্বাসঘাতকতা করছে, তবুও সম্পর্কের ইতি টানতে পারেন না। আমাদের কাছে এ ধরনের কেস আসলে আমরা এ রকম সম্পর্ক থেকে বেরিয়ে আসার পরামর্শ দিই। কারণ এই সম্পর্ক তাদের শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্যের জন্য যেমন ক্ষতিকর, তেমনি জীবনের পথেও মারাত্মক হুমকি হয়ে দাঁড়ায়। আপনার সঙ্গী যদি দিনের পর দিন আপনাকে মানসিক কষ্টের মধ্যে রাখে, তার আচরণের কোনো পরিবর্তন না হয়, তবে মনকে শক্ত করে ভবিষ্যতের কথা ভেবে এমন সম্পর্ক থেকে বেরিয়ে আসাই ভালো। কারণ ব্রেকআপ বা বিচ্ছেদ হয়ত আপনাকে কিছুদিন সাময়িক যন্ত্রণা দেবে, কিন্তু তা অ্যাবিউসিভ সঙ্গীর সঙ্গে সারাজীবন কাটানোর যন্ত্রণা থেকে অনেক কম', বলেন তিনি।
তবে সবক্ষেত্রে সরে আসাই সমাধান না। টক্সিক রিলেশনশিপের তিক্ততা কমিয়ে কীভাবে সম্পর্ক সুন্দর হবে এ ব্যাপারে কিছু পরামর্শ দিয়েছেন শুভাশীষ কুমার চ্যাটার্জি-
শ্রদ্ধাবোধ থাকা
যেকোনো সম্পর্কের কিছু দাবি থাকে, বৈশিষ্ট্য থাকে। রোমান্টিক সম্পর্কে থাকা দুজন সঙ্গীই চাইবেন সঙ্গী তার প্রতি যত্নশীল হোক, দায়িত্বশীল হোক। তিনি আস্থা চান, প্রতিশ্রুতি চান। তবে এসবের পাশাপাশি একে অন্যের প্রতি শ্রদ্ধাশীল থাকাও জরুরি। কিন্তু এ জায়গায় অনেকেই ছাড় দেন, যা পরে সম্পর্কের জন্য ক্ষতিকর হয়ে দাঁড়ায়। তাই যেকোনো সম্পর্কে ভালোবাসা যেমন জরুরি, শ্রদ্ধাবোধ থাকাও জরুরি।
ক্ষমাশীল হওয়া
রবি ঠাকুর বলেছেন, 'ক্ষমাই যদি করতে না পার, তবে তাকে ভালোবাস কেন?' সঙ্গীকে ভালোবাসলে তার ছোটখাট ভুলত্রুটি ক্ষমা করে দেবেন। রাগ পুষে রাখবেন না। কখনো নিজের ভুল হলে তার কাছে ক্ষমা চাইবেন। তবে এর মানে এই নয়, একজন দিনের পর দিন আপনাকে আঘাত করে ক্ষমা চেয়ে যাবে আর আপনি বিনাবাক্যে তা মেনে নেবেন। ভুলের ধরন বুঝে সিদ্ধান্ত নিতে হবে।
সময় দেওয়া
যেকোনো সম্পর্কে সময় দেওয়া খুবই জরুরি। যত ব্যস্তই থাকুন না কেন প্রিয়জনের জন্য ২৪ ঘণ্টার মধ্যে ১০ মিনিটও কি বের করা সম্ভব না তার খোঁজ নেওয়ার জন্য? সবসময় যে ঘণ্টার পর ঘণ্টা একসঙ্গে কাটাতে হবে তা না। আপনি তার পাশে আছেন, তাকে মনে করছেন এটি তাকে অনুভব করানো সম্পর্কের জন্য গুরুত্বপূর্ণ। কোনো সম্পর্ক যদি শুধু সময়ের অভাবে নষ্ট হতে শুরু করে, তবে আগে সময় বের করে দেখুন সম্পর্ক আগের মতই সজীব আছে কি না।
ছাড় দেওয়া
সম্পর্কে থাকা দুজনকেই যথাসম্ভব ছাড় দিতে হবে। সংবেদনশীল হতে হবে, সহানুভূতি থাকতে হবে। শুধু একজন সব ছাড় দিয়ে গেলে সম্পর্কের তিক্ততা বাড়তে থাকে। ধরুন, গতকাল আপনার সঙ্গী পিৎজা খেতে চাইলেন কিন্তু আপনি চাইলেন বার্গার খেতে। তিনি আপনার পছন্দের প্রতি সম্মান দেখিয়ে বার্গার খেলেন। এজন্য পরেরবার পিৎজার দোকানে নিয়ে যাবেন আপনার সঙ্গীকে। এটিই সম্পর্কের বোঝাপড়া।
ভারসাম্য বজায় রাখা
যদি কখনো মনে হয়, আপনি সম্পর্কের প্রতি বেশি যত্নশীল, আপনি বেশি ক্ষমা চাইছেন, আপনিই প্রতিবার তার খুশির চিন্তা করছেন, অপরপ্রান্তের মানুষের এদিকে কোনো মাথাব্যথা নেই- তবে বুঝবেন আপনার সম্পর্কটি একতরফাভাবে চলছে। এমন হলে আপনার সঙ্গীর সঙ্গে কথা বলুন, আপনার ভাবনাগুলো তাকে জানান। তিনি এ ব্যাপারে কী ভাবছেন সেটি জানুন। তবেই বুঝবেন, সম্পর্ক কতটা ভালো আছে।
সম্পর্ক থেকে সাময়িক ছুটি
ধরুন, আপনার প্রিয় মানুষটি বারবার একই ভুল করছেন। আপনি কষ্ট পাচ্ছেন জেনেও এই ভুল থেকে বের হতে পারছেন না তিনি। সেক্ষেত্রে সম্পর্ক থেকে সাময়িক ছুটি নিতে পারেন। অনেক সময় অনুপস্থিতি একজনের উপস্থিতি ভালোভাবে জানান দিতে পারে। যোগাযোগ বন্ধ থাকলে হয়তো তিনি ধীরে ধীরে উপলব্ধি করতে পারবেন, কেন আপনি কষ্ট পেতেন অথবা তার জীবনে আপনার গুরুত্ব কতটা। এটাকে বলে, নেগেটিভ রিইনফোর্সমেন্ট। সম্পর্ক সুন্দর রাখতে মাঝে মাঝে এমন ছুটি নেওয়া জরুরি।
কাউন্সিলিং সাপোর্ট
দুজনই সম্পর্কে থাকতে চান কিন্তু কিছুতেই সম্পর্কের টানাপোড়েন কমছে না, সেক্ষেত্রে কাপল থেরাপি বা কাউন্সিলিংয়ের সাহায্য নিতে পারেন।
Comments