প্রেম বা বিয়েতে বয়সের পার্থক্যের ভূমিকা
যাদের প্রেম বা বিয়ের মতো রোমান্টিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে বয়সের ফারাকটা একটু বেশি, যেমন ১০ বছর বা তারও বেশি, তাদের দিকে সমাজ যেন একটু বাঁকা চোখেই তাকায়। তবে গবেষণা থেকে জানা যায়, বয়সের তারতম্যটা সাধারণত কমই শ্রেয় মনে করা হলেও নারী ও পুরুষ উভয়েই প্রেম বা বিয়ের ক্ষেত্রে তাদের চেয়ে ১০-১৫ বছর ছোট বা বড় ব্যক্তিকে বেছে নিতে আগ্রহী।
রোমান্টিক সম্পর্কের জন্য কেন মানুষ সাধারণত কাছাকাছি বয়সের সঙ্গীই খুঁজে নেন, এটুকু বোঝা খুব সহজ। দুই পক্ষেরই এক বন্ধুবৃত্ত থাকা এবং তাদের মাধ্যমে সাক্ষাৎ হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। সমবয়সীদের মধ্যে আগ্রহের জায়গা, মূল্যবোধ, জীবনের পর্যায় এবং প্রাধান্য এসব বিষয়ে সাধারণত সাদৃশ্য খুঁজে পাওয়া যায়। শারীরিক বৈশিষ্ট্যের ক্ষেত্রেও বয়স একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়, আর সম্পর্কে জড়ানোর জন্য আকর্ষণ তৈরি হতেও এটি একটি ভূমিকা রাখে।
সে যাই হোক, সম্পর্কের ক্ষেত্রে পছন্দসই বয়সের ফারাক সংস্কৃতিভেদে আলাদা হতে পারে। এশিয়া ও আফ্রিকার মতো মহাদেশগুলোতে যুগলরা পাশ্চাত্যের দেশগুলোর চেয়ে ৩০ শতাংশ বেশি বয়সের পার্থক্য পছন্দ করেন।
সম্পর্কের দীর্ঘমেয়াদী সাফল্যে কি আদৌ বয়সের কোনো ভূমিকা আছে
এ নিয়ে বিশ্বজুড়ে বিভিন্ন বিশেষজ্ঞের বিভিন্ন মত। শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজের সাইকিয়াট্রি বিভাগের প্রধান ও সহযোগী অধ্যাপক ড. মো. জিল্লুর রহমান খান বলেন, 'সম্পর্কের চূড়ান্ত সাফল্য আসলে সেই যুগলের সক্ষমতা এবং দুঃসময়ে একসঙ্গে থাকার, কথা রাখার ওপর নির্ভর করে।'
তিনি বলেন, 'বয়সের বেশি পার্থক্য এমন যুগলদের চাইতে ৫-৭ বছর ফারাক আছে এমন যুগলরা সম্পর্কের সমস্যা নিয়ে আমাদের কাছে বেশি আসেন।'
যুক্তি দিয়ে বিষয়টি খোলাসা করেন তিনি, 'যেসব যুগলের মধ্যে বয়সের ফারাক কম, তারা মানসিক পরিপক্বতার দিক থেকে সাধারণত একই পর্যায়ে থাকেন। তারা জীবনকে একইভাবে দেখেন এবং তাদের একই ধরনের লক্ষ্যমাত্রা থাকে। অন্যদিকে, একজন ২০ বছর বয়সীর অভিজ্ঞতা ও জীবনকে দেখার চোখ ৩৫ বছর বয়সী একজনের চাইতে বিভিন্নভাবে আলাদা হতে পারে।'
মেলবোর্নের ডিয়াকিন ইউনিভার্সিটির স্কুল অব সাইকোলজির অধ্যাপক ড. গেরি কারান্টজাসের মতও প্রায় একই।
গেরি বলেন, 'জীবনের বিভিন্ন পর্যায়ে আমরা বিভিন্ন ধরনের কাজে যুক্ত হই। তাই যখন কোনো যুগলের মধ্যে একজন জীবনের এমন একটি লক্ষ্যকে প্রাধান্য দেন, যা অন্যজনের সঙ্গে খাপ খায় না– তখন মতপার্থক্য তৈরি হতে পারে।'
যদি সামাজিক ও সাংস্কৃতিক রীতিনীতির কথা বলা হয়, তবে বেশি বয়সী পুরুষ ও কমবয়সী নারীর মধ্যকার সম্পর্ক নিয়ে তর্কাতর্কি অতটা নেই।
প্রচলিত বিশ্বাস ছিল, পুরুষরা নারীর মধ্যে জীবনীশক্তি এবং সন্তানধারণের ক্ষমতা খুঁজে থাকেন। এজন্য এসব বিষয় খেয়াল রেখে সঙ্গী খোঁজেন তারা। অন্যদিকে নারীরা পুরুষের মধ্যে খোঁজেন তার এবং তার সন্তানদের জন্য সুরক্ষা। সেখান থেকে পুরুষদের ক্ষেত্রে বয়সে ছোট এবং নারীদের ক্ষেত্রে বয়সে বড় সঙ্গী খোঁজার প্রবণতা।
তবে নারীরা উপার্জন করায় তাদের আর পুরুষের মধ্যে নিরাপত্তা খোঁজার প্রয়োজন নেই। বর্তমানে পুরুষদের মধ্যেও অনেকে আছেন যারা সন্তান চান না। ফলে তাদের বেশি বয়সী নারীদের দিকে ঝোঁকার প্রবণতাও বৃদ্ধি পেয়েছে। তাই এখন বয়সের ফারাকটা শুধুই পছন্দের বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে।
ড. মো. জিল্লুর রহমান খান তার বক্তব্য আরও স্পষ্টভাবে তুলে ধরেন, 'সব যুগলই আলাদা। অনেকেই আছেন যারা বেশি বয়সের ফারাক থাকা সত্ত্বেও সম্পর্কটি সুন্দরভাবে এগিয়ে নেওয়ার বিষয়টি গুরুত্ব দেন। তাই কোনো জুটি যদি একে অন্যের গুরুত্বের বা প্রাধান্যের বিষয়টি বুঝতে সময় নেন এবং সেগুলোর প্রতি সম্মান দেখান, তাহলে সাধারণত সেসব সম্পর্ক টিকে থাকে।'
এক্ষেত্রে আরও একটি বিষয় উল্লেখ্য, যে জুটিরা শুরুর দিকে রোমান্টিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে বয়সের পার্থক্য অনেক বেশি মনে করে, সময়ের সঙ্গে সঙ্গে তাদের কাছে বয়সের ফারাক কম গুরুত্ব পেতে থাকে।
অধ্যাপক ড. গেরি কারান্টজাস বলেন, 'একজন ২০ বছর বয়সী ও ৩০ বছর বয়সীর মধ্যে বয়সের পার্থক্য বেশ অনেকটা হলেও ৩০ বছর পর কিন্তু এই তাদের বয়স হবে যথাক্রমে ৫০ এবং ৬০ বছর। এক্ষেত্রে কিন্তু পার্থক্য বেশি মনে হচ্ছে না।'
একটি সম্পর্ক সুন্দর থাকবে কি না সেটি এখন আর কোনো যুগলের বয়সের ওপর নয়, তাদের পারস্পরিক মূল্যবোধ, বিশ্বাস ও লক্ষ্যের ওপর নির্ভর করে। তারা যদি প্রয়োজনের সময় একে অন্যকে সমর্থন যুগিয়ে যেতে পারেন, নিজের জায়গাটুকু ধরে রাখতে পারেন এবং নিজেদের মধ্যকার দ্বন্দ্ব নিরসনে পরিপক্ব মন-মানসিকতার প্রমাণ দিতে পারেন– তবে বয়স একটি সংখ্যা ছাড়া আর কিছুই নয়।
অনুবাদ করেছেন অনিন্দিতা চৌধুরী
Comments