উচ্চ মূল্যস্ফীতির সঙ্গে আর কত দিন মানিয়ে চলবে মানুষ?

উচ্চ মূল্যস্ফীতি, মূল্যস্ফীতি, পেঁয়াজ, ব্যয়, আলু, চিনি, ডিম, বাংলদেশ ব্যাংক, বিশ্বব্যাংক,

উচ্চ মূল্যস্ফীতি দেশের নির্দিষ্ট, নিম্ন ও মধ্যম আয়ের মানুষের জীবনযাপনকে ব্যয়বহুল করেছে। ক্রমবর্ধমানভাবে এই চাপ অব্যাহত আছে। এতে সাধারণ মানুষ জীবনযাত্রার ব্যয় মেটাতে হিমশিম খাচ্ছেন।

দীর্ঘদিন ধরে চলমান মূল্যস্ফীতির কারণে এসব মানুষের ক্রয় ক্ষমতাও কমেছে। ফলে তারা ব্যয় কমাতে বাধ্য হচ্ছেন, এমনকি প্রতি মাসের মুদির বাজারের জন্য নির্ধারিত বাজেট কমিয়েছেন। শুধু তাই নয় অনেকেই তাদের দীর্ঘদিনের সঞ্চয় ভাঙাতে বাধ্য হয়েছেন। অনেকে আবার উচ্চ ব্যয়ের কারণে বাবা-মায়ের কাছে কম টাকা পাঠাচ্ছেন।

ঢাকার দক্ষিণখানের বাসিন্দা কামরুল হাসান নাঈম বলেন, গত এক বছরে ৩০ শতাংশের বেশি খরচ বেড়েছে। কিন্তু, আনুপাতিক হারে বেতন বাড়েনি। 

তাই অতিরিক্ত খরচ বহনের জন্য এক বছরের বেশি সময় ধরে সাপ্তাহিক ছুটির দিনেও ফ্রিল্যান্সিং করছেন এই আইটি কর্মকর্তা। নাঈম তার তিন সদস্যের পরিবার নিয়ে বছরে দুই-তিনবার ঘুরতে যেতেন। কিন্তু, এখন বছরে মাত্র একবার ঘুরতে যায় পরিবারটি।

চট্টগ্রামের একটি ফার্মাসিউটিক্যালস কোম্পানির সিনিয়র মেডিকেল প্রমোশন অফিসার রেজাউল করিম বলেন, এক বছর আগে আয়ের একটি অংশ সঞ্চয় করতে পেরেছিলেন।

'এখন, আমি একটি পয়সাও সঞ্চয় করতে পারি না,' বলেন রেজাউল করিম।

তিনি জানান, এক বছর আগে এক সপ্তাহের যে পরিমাণ সবজি কিনতে ২০০ টাকা খরচ হতো, এখন সেই একই পরিমাণ সবজি কিনতে খরচ হয় প্রায় ৫০০ টাকা। তিনি সন্তানদের জন্য প্রতি মাসে তিন হাজার টাকার ফল কিনতেন। সেই বাজেটও কমিয়ে অর্ধেকে নামিয়ে আনা হয়েছে। চার সদস্যের পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তি তিনি। উচ্চ মূল্যের এই বাজারে সন্তানদের অনেক ইচ্ছা পূরণ করতে পারেন না, যা একজন বাবা হিসেবে তার জন্য হতাশার বলে মনে করেন তিনি।

নাঈম ও করিমের মতো বাংলাদেশের লাখ লাখ মানুষ এভাবে জীবনযাত্রার ব্যয় বৃদ্ধির সঙ্গে সংগ্রাম করছেন।

রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ শুরুর পর বিশ্বব্যাপী পণ্যের মূল্য বেড়েছে। যার প্রভাবে গত দেড় বছরে বাংলাদেশে মূল্যস্ফীতি সর্বোচ্চ পর্যায়ে পৌঁছেছে।

ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) তথ্য অনুযায়ী, গত এক বছরে মোটা মসুর ডালের দাম বেড়েছে ১৩ দশমিক ১৬ শতাংশ, আলুর দাম বেড়েছে ৬৭ দশমিক ২৭ শতাংশ, দেশি পেঁয়াজের দাম বেড়েছে ১১২ দশমিক ৫০ শতাংশ এবং ব্রয়লার মুরগির দাম বেড়েছে ৬ শতাংশ। গুঁড়ো দুধের দাম বেড়েছে ১৬ দশমিক ৪৩ শতাংশ, চিনির দাম বেড়েছে ৪৫ দশমিক ৬০ শতাংশ এবং লবণের দাম বেড়েছে ১২ দশমিক ৩৩ শতাংশ।

এ বছরের সেপ্টেম্বরে খাদ্য মূল্যস্ফীতি দাঁড়িয়েছে ১২ দশমিক ৩৭ শতাংশ, যা টানা দুই মাস ধরে ১২ শতাংশের ওপরে আছে এবং গত বছরের একই সময়ের চেয়ে প্রায় তিন শতাংশীয় পয়েন্ট বেশি। খাদ্যবহির্ভূত মূল্যস্ফীতি দাঁড়িয়েছে ৭ দশমিক ৮২ শতাংশ।

মূল্যস্ফীতির এই পরিসংখ্যান বলে দেয়, এখানে প্রায় সবকিছুই ব্যয়বহুল হয়ে উঠেছে, যা মানুষের খাদ্যাভ্যাসে পরিবর্তন আনতে বাধ্য করেছে।

বিশ্বব্যাংকের মতে, মূল্যস্ফীতি ভোক্তাদের ক্রয় ক্ষমতা কমিয়েছে, এটি ব্যক্তিগত খরচ আনুমানিক ৭ দশমিক ৫ শতাংশ থেকে ৩ দশমিক ৫ শতাংশে কমাতে অবদান রেখেছে।

ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) তথ্য অনুযায়ী, গত এক বছরে মোটা মসুর ডালের দাম বেড়েছে ১৩ দশমিক ১৬ শতাংশ, আলুর দাম বেড়েছে ৬৭ দশমিক ২৭ শতাংশ, দেশি পেঁয়াজের দাম বেড়েছে ১১২ দশমিক ৫০ শতাংশ এবং ব্রয়লার মুরগির দাম বেড়েছে ৬ শতাংশ। গুঁড়ো দুধের দাম বেড়েছে ১৬ দশমিক ৪৩ শতাংশ, চিনির দাম বেড়েছে ৪৫ দশমিক ৬০ শতাংশ এবং লবণের দাম বেড়েছে ১২ দশমিক ৩৩ শতাংশ।

চলতি বছরের আগস্টের মাঝামাঝিতে এক ডজন ডিমের দাম এক কেজি ব্রয়লার মুরগির দামের সমান হয়ে গিয়েছিল। 

এদিকে, দাম বৃদ্ধিতে মিরপুরের রড ও সিমেন্ট বিক্রেতা মাহবুব আলী শুক্রবার ও শনিবার কাঁচাবাজারে যাওয়া বন্ধ করে দিয়েছেন।

তিনি বলেন, 'সাধারণত ছুটির দিনগুলোতে বাজারে ভিড় বেশি থাকে। তাই পণ্যের দামও বেশি থাকে। কিন্তু, অন্যান্য দিনে ভিড় তুলনামূলক কম থাকে এবং অনেক সময় পণ্যের দাম কিছুটা কম থাকে।'

সাভারের আশুলিয়ায় একটি পোশাক কারখানায় ফায়ার সেফটি অফিসার হিসেবে মাসিক ২০ হাজার টাকা বেতনে চাকরি করেন নকীব হোসেন।

তিনি জানান, ২০২১ সালে কারখানায় যোগ দেওয়ার পর থেকে গ্রামের বাড়িতে বসবাসকারী বাবা-মা, স্ত্রী ও কন্যাদের কাছে মাসে সাত থেকে আট হাজার টাকা পাঠাতেন।

'এখন আমি আড়াই হাজার থেকে তিন হাজার টাকা পাঠাতে পারি। বাকি টাকা বড় ভাই ও বোন পাঠান,' বলেন এই পোশাক কর্মী।

নকীব হোসেন জানুয়ারি থেকে আর্থিক সংকটের কারণে পেনশন স্কিমে টাকা জমা বন্ধ ও জমানো অর্থ তুলে নিতে বাধ্য হন।

সিরাজগঞ্জের একটি বেসরকারি উচ্চ বিদ্যালয়ের শিক্ষক মোজাম্মেল হোসেন জানান, বাজার থেকে যেন সবজি কিনতে না হয় সেজন্য দেড় বছর আগে নিজের উঠানে পেঁপে, মরিচ ও লাউয়ের চারা রোপণ করেন। সারা দেশে যখন ৭০০ থেকে ১ হাজার ২০০ টাকা কেজি দরে মরিচ বিক্রি হচ্ছিল তখন বাজার থেকে কোনো মরিচ কেনেননি এই শিক্ষক।

মোজাম্মেল হোসেনের অল্প পরিমাণ জমি আছে। সেই জমি তিনি আখ, সরিষা এবং আলু উৎপাদনকারী এক ভাগচাষীকে দিয়েছেন। 

'ফলে আমাকে আলু, সরিষার তেল, গুড় কিনতে হয় না। এগুলো সারা বছর ব্যবহার করতে পারি,' বলেন তিনি।

উচ্চ মূল্যস্ফীতির কারণে অনেকে পণ্য ও সেবা ক্রয়ের ক্ষেত্রে বিকল্পের দিকে ঝুঁকছেন। যেমন অনেকে বাইরে খাওয়ার মতো অপ্রয়োজনীয় ব্যয় কমিয়েছেন।

একটি বেসরকারি সংস্থায় কাজ করা এক ব্যক্তি বলেন, 'দেশে এখন ক্রিকেট বিশ্বকাপের উন্মাদনা চলছে। এজন্য আমার এক সহকর্মী বাংলাদেশ দলের জার্সি কেনার প্রস্তাব দেন। কিন্তু আমি কোনো আগ্রহ দেখায়নি। কারণ এই সময়ে জার্সি কেনা আমার কাছে বিলাসিতা মনে হয়েছে।'

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক সেলিম রায়হান বলেন, উচ্চ মূল্যস্ফীতি দীর্ঘায়িত হওয়ায় মানুষ নিজেদের অবস্থান থেকে নিজের মতো করে সমন্বয় করে চলার চেষ্টা করছেন।

তিনি বলেন, 'যাদের সুযোগ আছে তারা অতিরিক্ত খরচ মেটাতে অতিরিক্ত কাজ করছেন। কিন্তু যাদের কাজ করার সুযোগ নেই, তারা খাদ্য ও অন্যান্য জিনিসের ব্যবহার কমিয়ে দিচ্ছেন।'

তিনি আরও বলেন, অর্থনৈতিক ও সামাজিক উভয় দিক থেকেই নির্দিষ্ট আয়ের মানুষগুলো চাপের মধ্যে আছে। তাদের অনেকেই খরচ কমানোর জন্য সামাজিক অনুষ্ঠানে যাওয়া বন্ধ করে দিয়েছেন।

তিনি নির্দিষ্ট আয়ের মানুষকে সামাজিক সুরক্ষা প্রকল্পের আওতায় আনতে সরকারের কাছে আহ্বান জানান। এছাড়া বাজারে পণ্যের সরবরাহ বৃদ্ধি ও বাজার ব্যবস্থাপনায় অসঙ্গতি দূর করার আহ্বান জানান এই অর্থনীতিবিদ।

তবে, নিম্ন ও নির্দিষ্ট আয়ের মানুষ কতদিন এভাবে সংগ্রাম করবেন তা কেউ বলতে পারেননি।

Comments

The Daily Star  | English
Bangladesh trade deficit July-August FY25

Trade deficit narrows 2.6% in July-April

The country’s trade deficit narrowed by 2.60 percent in the first ten months of the current fiscal year compared to the same period a year ago, thanks to a rise in export earnings coupled with subdued imports..During the July-April period of fiscal year (FY) 2024-25, the trade gap was $18.

6h ago