বাড়ছে ঋণ ও আমানতের সুদ
মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে এবার নীতি সুদহার বা রেপো রেট বাড়িয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। গতকাল কেন্দ্রীয় ব্যাংক রেপো রেট দশমিক ৭৫ শতাংশীয় পয়েন্ট বাড়িয়ে ৭ দশমিক ২৫ শতাংশ করেছে।
বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে রেপো রেটে অর্থ ঋণ নেয়। তাই রেপো রেট বাড়ালে বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর ঋণ ও আমানতের সুদের হারও বেড়ে যায়।
গতকাল কেন্দ্রীয় ব্যাংকের এক বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, নীতি সুদহার বৃদ্ধির ফলে স্ট্যান্ডিং ল্যান্ডিং ফ্যাসিলিটি ৮ দশমিক ৫০ শতাংশ থেকে ৯ দশমিক ২৫ শতাংশ এবং স্ট্যান্ডিং ডিপোজিট ফ্যাসিলিট ৪ দশমিক ৫০ শতাংশ থেকে বেড়ে ৫ দশমিক ২৫ শতাংশ হবে।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের একজন কর্মকর্তা বলেন, এক দশকের মধ্যে এবারই এভাবে দ্রুত গতিতে নীতি সুদহার বাড়ানো হলো। এ নিয়ে গত ১৮ মাসের মধ্যে সপ্তমবারের মতো নীতি সুদহার বাড়ানো হলো। কারণ ভোক্তা মূল্যস্ফীতি উচ্চ স্তরে আছে।
চলতি বছরের সেপ্টেম্বরে গড় মূল্যস্ফীতি বেড়ে হয়েছে ৯ দশমিক ৬৩ শতাংশ, যা কেন্দ্রীয় ব্যাংকের লক্ষ্যমাত্রা ৬ শতাংশের চেয়ে বেশি।
বাংলাদেশ ব্যাংকের মুদ্রানীতি কমিটির বাড়ানো রেপো রেট বা নীতি সুদহার আজ থেকে কার্যকর হচ্ছে।
নীতি সুদহার কেন্দ্রীয় ব্যাংকের আর্থিক নীতির একটি শক্তিশালী হাতিয়ার, কারণ এটি দেশের অর্থ সরবরাহ, মূল্যস্ফীতি ও তারল্য সংকট করতে পারে।
সর্বশেষ গত জুনে বাংলাদেশ ব্যাংক রেপো রেট দশমিক ৫০ শতাংশীয় পয়েন্ট বাড়িয়ে ৬ দশমিক ৫০ শতাংশ করেছিল।
কিন্তু, বাংলাদেশ ব্যাংক রেপো রেট বৃদ্ধি এবং এটি শক্তিশালী করার ক্ষেত্রে অন্যান্য দেশের তুলনায় অনেক পিছিয়ে আছে।
যেমন- যুক্তরাষ্ট্রের ফেডারেল রিজার্ভ ও ইউরোপীয় কেন্দ্রীয় ব্যাংক গত বছর ও এ বছর রেকর্ড মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে নীতি সুদহার বাড়িয়েছে।
দাম স্থিতিশীল রাখতে ও ঋণের খরচ বাড়াতে যুক্তরাষ্ট্র ২২ বছরের মধ্যে সুদের হার সর্বোচ্চ স্তরে বাড়িয়েছিল। ২০২২ সাল থেকে তারা ১১ বার এই হার বাড়িয়েছে
ফলে, বিশ্বের বৃহত্তম অর্থনীতির দেশটির বার্ষিক মূল্যস্ফীতি আগস্টে ৩ দশমিক ৬ শতাংশে পৌঁছবে বলে আশা করা হয়েছিল। যা ২০২২ সালের জুনের সর্বোচ্চ ৯ দশমিক ১ শতাংশের চেয়ে বেশ কম।
একইভাবে, ইউরোজোনের মূল্যস্ফীতি গত বছরের অক্টোবরে সর্বকালের সর্বোচ্চ ১০ দশমিক ৬ শতাংশ থেকে কমে এ বছরের আগস্টে ৫ দশমিক ৩ শতাংশে দাঁড়িয়েছে।
রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের ফলে তৈরি হওয়া সংকটের কারণে পণ্যের দাম তীব্রভাবে বেড়েছে এবং দেশের মূল্যস্ফীতিও উচ্চ স্তরে পৌঁছেছে। ফলে, গত বছরের মে মাসে বাংলাদেশ ব্যাংক রেপো রেট বাড়ানো শুরু করে। এরপর থেকে এই হার ঊর্ধ্বমুখী করা হয়েছে।
কিন্তু, ২০২০ সালের এপ্রিল থেকে চালু থাকা ৯ শতাংশ সুদ হারের সীমার কারণে এই বৃদ্ধি প্রত্যাশিত ফল আনতে পারেনি।
অবশ্য আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) ৪ দশমিক ৫ বিলিয়ন ডলার ঋণের শর্ত পূরণে কেন্দ্রীয় ব্যাংক গত জুনে ঋণের সুদ হারের সীমা প্রত্যাহার করে নেয়। এরপর একটি নতুন সুদহার ব্যবস্থা চালু করে। কিন্তু, উচ্চ মূল্যস্ফীতি ইতোমধ্যে মানুষের জীবনযাত্রাকে ব্যয়বহুল করে তুলেছে।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নতুন ফর্মুলা অনুযায়ী, ব্যাংকগুলো ট্রেজারি বিলের ছয় মাসের মুভিং এভারেজ রেটে ৩ শতাংশ মার্জিন আরোপ করতে পারবে। এটি স্মার্ট রেট হিসেবে পরিচিত। সেপ্টেম্বরে স্মার্ট ছিল ৭ দশমিক ২০ শতাংশ এবং আগস্টে ৭ দশমিক ১৪ শতাংশ।
পলিসি রিসার্চ ইন্সটিটিউটের নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর বলেন, কেন্দ্রীয় ব্যাংক ঋণের সুদের হার বাড়ানোর অনুমতি দিলেই নীত সুদহার বৃদ্ধি কার্যকর হবে। অন্যথায় মূল্যস্ফীতির চাপ কমানো সম্ভব হবে না।
তিনি মনে করেন, মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে রাখতে ও বিনিময় হার স্থিতিশীল করতে কয়েক মাস ধরে ধীরে ধীরে নীতি সুদহার বাড়াতে হবে।
ক্রমবর্ধমান সুদের হার বিনিয়োগের ক্ষতি করতে পারে, তবে আইএমএফের প্রাক্তন এই কর্মকর্তা বলছেন, এখন মূল লক্ষ্য হওয়া উচিত মূল্যস্ফীতি যুক্তিসঙ্গত স্তরে নামিয়ে আনা এবং বিনিময় হার স্থিতিশীল করা।
গত ১৮ মাসে মার্কিন ডলারের বিপরীতে টাকার মূল্য প্রায় ২৮ শতাংশ কমেছে।
বাংলাদেশ ব্যাংক এমন সময়ে নীতি সুদহার বাড়িয়েছে যখন বেসরকারি খাতের ঋণের প্রবৃদ্ধি ক্রমাগত কমছে। কারণ অর্থনীতির ওপর চাপ ও আসন্ন সংসদ নির্বাচনকে কেন্দ্র করে রাজনৈতিক সংকটের আশঙ্কায় ব্যাংক ঋণ দেওয়া কমিয়েছে, ব্যবসায়ীরাও ঋণ কম নিচ্ছেন।
চলতি বছরের আগস্টে বেসরকারি খাতের ঋণের প্রবৃদ্ধি ছিল ৯ দশমিক ৭৫ শতাংশ এবং আগের মাসে ছিল ৯ দশমিক ৮২ শতাংশ।
সামগ্রিক সুদের হার যখন বাড়ছে তখন অর্থ সরবরাহ জোরদার করতে নীতি সুদহার বাড়ানোর এই উদ্যোগ নিলো কেন্দ্রীয় ব্যাংক।
এ বছরের জুলাইয়ে আমানতের গড় সুদের হার দাঁড়িয়েছে ৪ দশমিক ৪৬ শতাংশে, যা এক মাস আগে ছিল ৪ দশমিক ৩৮ শতাংশ। জুলাইয়ে ঋণের গড় হার বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৭ দশমিক ৭৫ শতাংশে, যা জুনে ছিল ৭ দশমিক ৩১ শতাংশ।
মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংক লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা সৈয়দ মাহবুবুর রহমান বলেন, নীতি সুদহার বৃদ্ধির ফলে অবশ্যই বাজারে প্রভাব পড়বে। চাপ আরও বাড়বে।
তিনি আরও বলেন, আমানতের হার বাড়লেও বেসরকারি খাতে ঋণ প্রবাহ কমবে। নিট সুদের মার্জিন, সুদের ব্যয় এবং সুদের আয়ের মধ্যে পার্থক্যও কমবে।
'এই উদ্যোগের ফলে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে আসবে বলে আশা করা হচ্ছে। কিন্তু দেখা যাক এটা কিভাবে কাজ করে,' বলেন তিনি।
Comments