১০০ বছরেও কমেনি ঢাকার যে লাচ্ছি-ফালুদার জনপ্রিয়তা

ছবি: মাহমুদ নেওয়াজ জয়

ছোট পরিসরের একটি দোকান। সামনে দাঁড়িয়ে ও ভেতরে বসে লাচ্ছি পান করছেন কিংবা ফালুদা খাচ্ছেন ১০-১২ জন মানুষ। পুরান ঢাকার ৩০/১ জনসন রোডে অবস্থিত দোকানটির নাম সবারই জানা, বিউটি লাচ্ছি-ফালুদা।

সাইনবোর্ডই বলছে, এখানে ফালুদা, লাচ্ছি, লেবুর শরবত পাওয়া যায়। লাচ্ছি ও ফালুদার জন্য সুবিখ্যাত এই দোকানের নাম শোনেননি এমন ভোজনরসিক হয়তো পাওয়া যাবে না। ১৯২২ সালের ১৫ জুন শুরু হওয়া দোকানটি এর ভেতর পেরিয়েছে শত বছর। জনসন রোডের ফুটপাতে শুরু করা দোকানটি হয়ে উঠেছে পুরান ঢাকার ঐতিহ্যবাহী একটি দোকান।

দোকানটির জনসন রোড শাখাটি আদি শাখা। তবে পরে কাজী আলাউদ্দিন রোড ও নারিন্দায় তাদের আরও ২টি শাখা চালু রয়েছে। বর্তমানে দোকানটির দেখভাল করছে প্রতিষ্ঠাতার তৃতীয় প্রজন্ম। প্রতিষ্ঠাতা আবদুল আজিজের নাতি জাবেদ হোসেন দেখভাল করছেন বিউটি লাচ্ছির জনসন রোডের আদি দোকানের। তার ছোটভাই মানিক হোসেন দায়িত্বে আছেন কাজী আলাউদ্দিন রোডের দোকানটির।

আরেকটি শাখা আছে নারিন্দায়। সেটি দেখছেন জাবেদের বড় ভাই ইকবাল হোসেন। জাবেদ হোসেন অসুস্থতার জন্য দোকানে কমই আসেন। তার থেকে জানা গেল দোকানের শুরুর সময়ের কথা।

তিনি বললেন, 'আমাদের এই দোকান সেই ব্রিটিশ আমলের। আমার দাদা আবদুল আজিজ জনসন রোডে (রায়সাহেব বাজার) ফুটপাতে লাচ্ছি ও লেবুর শরবত বিক্রি করতেন। পরে আমার বাবা পাকিস্তান আমলে দোকান নেন। তার নাম আবদুল গাফফার। সে সময় থেকেই দোকানটি পরিচিত হয়ে উঠতে শুরু করে।'

প্রতিষ্ঠাতা আবদুল আজিজ। ছবি: সংগৃহীত

জানা গেল, আবদুল গাফফার প্রয়াত হয়েছেন ২০০১ সালে।

জাবেদ হোসেন বলেন, 'পাকিস্তান আমল থেকেই দোকানের পরিচিতি থাকলেও দেশ স্বাধীন হওয়ার পর পরিচিতি আরও বাড়ে। তখন ঢাকার শহর ছিল গুলিস্তান থেকে এদিকে। আশির দশকের পর থেকে দোকানের খ্যাতি আরও বাড়তে থাকে। তখন আব্বা দোকান চালাতেন। তিনি মারা যাওয়ার পর আমি আর আমার ২ ভাই অর্থাৎ ৩ জন ২টি দোকানের দেখভাল করছি।'

জানা গেল, শুরুর পর থেকে দীর্ঘ সময় পর্যন্ত লাচ্ছি ও লেমোনেডই বিক্রি করতেন তারা। পুরো ঢাকাজুড়ে খ্যাতি পায় তাদের লাচ্ছি। তবে তাদের সুখ্যাত আরেকটি খাবার ফালুদা সে তুলনায় অনেক পরে এসেছে। ২০০০ এর পর থেকে চালু হয় এটি।

বর্তমানে লাচ্ছি ও ফালুদা ২টি খাবারই নরমাল ও স্পেশাল এই ২ ধরনের প্রস্তুত করা হয়।

তাদের লাচ্ছির এমন সুখ্যাতির কারণ কী জানতে চাইলে জাবেদ হোসেন বলেন, তার মতে, তাদের প্রস্তুতপ্রণালিই হয়তো এই সুখ্যাতির কারণ।

তিনি জানান, লাচ্ছি তৈরির জন্য তারা ব্লেন্ডার ব্যবহার করেন না। অন্য কোনো রকম মেশিনের সাহায্যও নেন না। ছোট ভাইয়ের নামে প্রতিষ্ঠিত মানিক সুইটমিটে তৈরি দই ব্যবহার করেই তারা লাচ্ছি ও ফালুদা বানিয়ে থাকেন। কাজী আলাউদ্দিন রোডের এই দোকানটি ১৯৯৮ সালে আবদুল গাফফার প্রতিষ্ঠা করেছিলেন।

দোকানের একজন কর্মচারি জানান, ব্লেন্ডারের পরিবর্তে হাত ব্যবহার করেই তারা কাজ করেন। নানা রকম উপাদান একসঙ্গে মেশানোর জন্য ডাল ঘুটনি ব্যবহার করে থাকেন। দই, চিনি,বরফ একসঙ্গে মিশিয়ে ডাল ঘুটনি দিয়ে ঘুটিয়ে লাচ্ছি তৈরি হয়।

দোকানে প্রায় ৪০ বছর ধরে কর্মরত আছেন মো. শহীদুল্লাহ।

তিনি জানান, পুরান ঢাকার ঘরে ঘরে মেহমানদের আপ্যায়নের জন্য লাচ্ছি, মাঠা এগুলো পরিবেশনের ঐতিহ্য আছে। এ কারণেও বিউটির লাচ্ছি এত খ্যাতি পেয়েছে।

শহীদুল্লাহ ঢাকায় এসেছিলেন কাজ খুঁজতে। তারপর আবদুল গাফফারের অধীনে কাজ করতে শুরু করেন। সে সময় ছোট একটি টিনশেড দোকান ছিল এটি। গরমের সময় লাচ্ছি-লেমোনেডের প্রচুর চাহিদা ছিল। শীতে এসবের পাশাপাশি তৈরি করা হতো ডালপুরি ও আলুপুরি। এখন দোকান বড় হয়েছে, তবে লাচ্ছি তৈরির পদ্ধতি এখনও আগের মতোই।

এই লাচ্ছির স্বাদ নিতে দূর-দূরান্ত থেকেও আসেন অনেকেই। মেডিকেল শিক্ষার্থী দুর্জয় যেমন জানালেন তার ভালো লাগার কথা।

তার মতে, 'এই লাচ্ছির স্বাদ বেশ ভালো, মিষ্টি পরিমিত। তবে পার্সেলের জন্য গ্লাসের ব্যবস্থা নেই। সেটা থাকলে আরও ভালো হতো।'

জাবেদ হোসেন এখন অসুস্থতার কারণে আগের মতো সময় দিতে পারেন না দোকানে। তবে মান ঠিকঠাক রাখার বিষয়টি সবসময়ই খেয়াল রাখেন। পাশাপাশি, নতুন ঢাকাতেও শাখা খোলার ব্যাপারে চিন্তা-ভাবনা রয়েছে তার। এজন্য তার পছন্দ ধানমন্ডি। সবকিছু ঠিকঠাক থাকলে নতুন ঢাকাতে এর একটি শাখা খোলার ব্যাপারে উৎসাহী তিনি৷

প্রতিদিন সকাল ৯টা থেকে রাত ১২টা পর্যন্ত খোলা থাকে দোকান। বিকেলের পর থেকে রাত ৮টা-৯টা পর্যন্ত ভিড় বেশি হয়। প্রচণ্ড গরমের দিনে শান্তির পরশ পেতে অনেকেই চুমুক দেন এই লাচ্ছিতে, স্বাদ নেন ফালুদার। শতবর্ষ পেরিয়েও তাই মানুষকে সতেজ করছে ও নিজেও সতেজ রয়েছে বিউটি লাচ্ছি।

 

Comments

The Daily Star  | English

Not for kidney patient, they tried to rob bank for iPhones

Police say three robbers fabricated a story claiming that the robbery was to save a kidney patient

1h ago