কেন ব্যাংক ও এনবিএফআইয়ের শেয়ার কিনতে আগ্রহ দেখান না বিনিয়োগকারীরা

খেলাপি ঋণ, ব্যাংক, বাংলাদেশ ব্যাংক, ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জ, ডিএসই, এনবিএফআই, ব্যাংক বহির্ভূত আর্থিক প্রতিষ্ঠান,
ছবি: সংগৃহীত

উচ্চ খেলাপি ঋণের কারণে ব্যাংক ও ব্যাংক বহির্ভূত আর্থিক প্রতিষ্ঠানের (এনবিএফআই) শেয়ারের প্রতি আস্থা হারাচ্ছেন বিনিয়োগকারীরা। ফলে, এসব কোম্পানির শেয়ার কিনতে খুব বেশি আগ্রহ দেখান না তারা।

এছাড়া, বিনিয়োগকারীদের একটি অংশের মূল আকর্ষণ থাকে কারসাজির প্রতি। তবে, ব্যাংক ও ব্যাংক বহির্ভূত আর্থিক প্রতিষ্ঠানের শেয়ার সংখ্যা বেশি হওয়ায় কারসাজির সুযোগ তেমন নেই। তাই এসব শেয়ার কিনতে চান না তারা।

ফলে ক্রেতা সংকটের মধ্যে গত কয়েক মাস ধরে ৮টি ব্যাংকের শেয়ারের দাম ১০ টাকার নিচে আছে। ৮টি ব্যাংক বহির্ভূত আর্থিক প্রতিষ্ঠানের (এনবিএফআই) শেয়ারেরও একই অবস্থা। অথচ একসময় ব্যাংক ও এনবিএফআইয়ের শেয়ার বিনিয়োগকারীদের কাছে সবচেয়ে আকর্ষণীয় ছিল।

শেয়ারবাজার বিশ্লেষক অধ্যাপক মোহাম্মদ মুসা বলেন, 'আমরা যদি হিসাব করি তাহলে দেখা যাবে, ব্যাংক ও এনবিএফআইয়ের প্রকৃত সম্পদ মূল্য কম। তাই তাদের শেয়ারের দামও কম থাকে।'

অধ্যাপক মোহাম্মদ মুসা ইউনাইটেড ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির স্কুল অব বিজনেস অ্যান্ড ইকোনমিক্সের ডিন। তিনি পুঁজিবাজার নিয়ে দীর্ঘদিন কাজ করছেন। আন্তর্জাতিক অঙ্গনে পুঁজিবাজার নিয়ে তার বেশ কিছু প্রকাশনা আছে।

'ব্যাংক ও ব্যাংক বহির্ভূত আর্থিক প্রতিষ্ঠানের প্রকৃত সম্পদ মূল দুটি কারণে কম, একটি হলো উচ্চ খেলাপি ঋণে জর্জরিত ব্যাংকগুলো প্রয়োজনীয় নগদ অর্থ আয় করতে পারে না। অন্যটি হলো, বিনিয়োগকারীরা মনে করেন- ব্যাংক ও এনবিএফআইগুলো পর্যাপ্ত পরিমাণে প্রভিশন রাখছে না, এজন্য তাদের আয় ভবিষ্যতে কমে যেতে পারে,' বলেন তিনি।

বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, চলতি বছরের মার্চ পর্যন্ত ব্যাংক খাতের খেলাপি ঋণ ১ লাখ ৩১ হাজার ৬২১ কোটি টাকা হয়েছে, যা আগের বছরের চেয়ে ১৬ শতাংশ বেশি।

ব্যাংকিং খাতের মোট ১৪ লাখ ৯৬ হাজার ৩৪৬ কোটি টাকা ঋণের ৮ দশমিক ৮ শতাংশ খেলাপি।

বাংলাদেশ ব্যাংকের ফাইন্যান্সিয়াল স্ট্যাবিলিটি রিপোর্ট অনুযায়ী, গত বছর শেষে ব্যাংকিং খাতে ঝুঁকিপূর্ণ ঋণের পরিমাণ ছিল ৩ লাখ ৭৭ হাজার ৯২২ কোটি টাকা।

অধ্যাপক মোহাম্মদ মুসা শেয়ারের কম দামের জন্য কোম্পানিগুলোর বড় ফ্রি ফ্লোটকেও দায়ী করেন। তিনি বলেন, 'যেহেতু ব্যাংক ও এনবিএফআইয়ের অনেক শেয়ার আছে, তাই বড় বিনিয়োগকারীরা কারসাজির জন্য সেগুলো লক্ষ্যবস্তু করেন না।'

তিনি বলেন, সাধারণ বিনিয়োগকারীরাও এজন্য শেয়ার কিনছেন না। কারণ, তাদের মধ্যেও শেয়ার নিয়ে কারসাজির প্রবণতা আছে।

শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্ত ব্যাংক আছে ৩৫টি। এর মধ্যে এবি ব্যাংক লিমিটেড, ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংক লিমিটেড, গ্লোবাল ইসলামী ব্যাংক পিএলসি, আইসিবি ইসলামী ব্যাংক লিমিটেড, ন্যাশনাল ব্যাংক লিমিটেড, ওয়ান ব্যাংক লিমিটেড, স্ট্যান্ডার্ড ব্যাংক লিমিটেড এবং ইউনিয়ন ব্যাংক লিমিটেডের শেয়ার দর এখন ১০ টাকার কম।

অন্য ১২টি ব্যাংকের শেয়ারের দাম গায়ের দামর চেয়ে সামান্য বেশি।

অধ্যাপক মোহাম্মদ মুসা আরও বলেন, 'অনেকগুলো কোম্পানির আছে যাদের শেয়ারের দাম অনেক বেশি। এর মূল কারণ হলো- তাদের শেয়ার সংখ্যা কম। ফলে, এই কোম্পানিগুলোতে কারসাজির আশায় বিনোয়োগকারীরা এসব শেয়ার কেনেন।'

উদাহরণ হিসেবে বলো হেয়ে পারে, সপ্তাহের প্রথম কর্মদিবস রোববারে দীর্ঘদিন লোকসানে থাকা জুটা স্পিনার্স লিমিটেডের শেয়ার ৩৩৪ টাকায় লেনদেন হয়েছে। এই কোম্পানিটির ১৭ লাখ শেয়ার আছে।

এছাড়া ইমাম বাটন ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেড, নর্দার্ন জুট ম্যানুফ্যাকচারিং কোম্পানি লিমিটেড, জিল বাংলা সুগার মিলস লিমিটেড ও শ্যামপুর সুগার মিলস লিমিটেডের মতো দুর্বল কোম্পানির শেয়ার ১০০ টাকার ওপরে লেনদেন হয়েছে। যদিও এসব কোম্পানির গায়ের দর ১০ টাকা।

ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের (ডিএসই) তথ্য অনুযায়ী, তাদের ২২ লাখ থেকে ৭০ লাখ পর্যন্ত শেয়ার আছে। কিন্তু, ব্যাংক ও এনবিএফআইগুলোর শেয়ার আছে ৭০ কোটি থেকে ১৬০ কোটি পর্যন্ত।

ইউসিবি অ্যাসেট ম্যানেজমেন্টের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও প্রধান নির্বাহী শেখ মোহাম্মদ রাশেদুল হাসান বলেন, 'ব্যাংক ও এনবিএফআইগুলো অন্য কোম্পানির চেয়ে বেশি নিয়ন্ত্রিত, তাই বিনিয়োগকারীদের তাদের প্রতি আরও আস্থা রাখা উচিত ছিল।'

তিনি আরও বলেন, কিন্তু তথ্য-উপাত্তের ভিত্তিতে প্রায় প্রতিদিনই সংবাদপত্রে ব্যাংকিং খাতের বিশ্লেষণ প্রকাশিত হচ্ছে। সেসব বিশ্লেষণে বলা হচ্ছে, দেশের বেশিরভাগ ব্যাংক কঠিন সময় পার করছে। তাই এ খাতের সম্পদের তথ্য সঠিকভাবে বুঝতে পারেন না বিনিয়োগকারীরা।

'এছাড়াও ব্যাংক ও ব্যাংক বহির্ভূত আর্থিক খাত তার সক্ষমতা হারাচ্ছে কিনা তা নিয়েও বিনিয়োগকারীরা বিভ্রান্ত। ফলে এখানে তাদের অংশগ্রহণ কম,' যোগ করেন তিনি।

ব্যাংক বাহির্ভূত ২৩টি আর্থিক প্রতিষ্ঠানের মধ্যে যাদের শেয়ারের দর গায়ের দরের চেয়ে কম সেগলো হলো- বাংলাদেশ ইন্ডাস্ট্রিয়াল ফাইন্যান্স কোম্পানি লিমিটেড, ফারইস্ট ফাইন্যান্স অ্যান্ড ইনভেস্টমেন্ট লিমিটেড, এফএএস ফাইন্যান্স অ্যান্ড ইনভেস্টমেন্ট লিমিটেড, ফার্স্ট ফাইন্যান্স লিমিটেড, ইন্টারন্যাশনাল লিজিং অ্যান্ড ফাইন্যান্সিয়াল সার্ভিসেস লিমিটেড, পিপলস লিজিং অ্যান্ড ফাইন্যান্সিয়াল সার্ভিসেস লিমিটেড, প্রিমিয়ার লিজিং অ্যান্ড ফাইন্যান্স লিমিটেড এবং ইউনিয়ন ক্যাপিটাল লিমিটেড।

ইউসিবি অ্যাসেট ম্যানেজমেন্টের রাশেদুল হাসান বলেন, বিনিয়োগকারীদের আস্থার অভাব পুরো খাতকে বিপর্যস্ত করছে। এতে কিছু প্রতিষ্ঠানের শেয়ারের দাম তুলনামূলক কম হলেও বিনোয়োগকারীরা কিনছেন না।

ডিএসইর তথ্য অনুযায়ী, কোনো ব্যাংক ও এনবিএফআইয়ের শেয়ার দর ৬০ টাকার বেশি নয়, যেখানে ২৩টি দুর্বল কোম্পানির মধ্যে ৮টির শেয়ার এর বেশিতে লেনদেন হচ্ছে।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একটি তালিকাভুক্ত ব্যাংকের এক শীর্ষ কর্মকর্তা বলেন, কিছু ব্যাংক ও এনবিএফআই উচ্চ খেলাপি ঋণের চাপে আছে। কিন্তু তারা কিছু করপোরেট গভর্নেন্স মেনে চলছে এবং কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নিয়মের মধ্যে আছে।

তিনি আরও বলেন, কিছু ব্যাংক ও এনবিএফআই লভ্যাংশও দিচ্ছে। তাই বলা যায় কিছু ক্ষেত্রে এসব প্রতিষ্ঠানকে অবমূল্যায়ন করা হয়, কারণ বেশিরভাগ বিনিয়োগকারী গুজবে কান দেয়। এছাড়া ব্যাংক ও এনবিএফআইয়ের শেয়ারের সংখ্যা বেশি হওয়ায় কারসাজি করা কঠিন।

'আমরা যদি শেয়ারবাজারের দিকে খেয়াল করি তাহলে দেখব, অনেক তালিকাভুক্ত কোম্পানির কোনো কারখানা নেই অথবা বহু বছর ধরে উৎপাদন বন্ধ আছে, তবুও তাদের শেয়ারের ব্যাংক ও এনবিএফআইয়ের শেয়ারের ওপরে লেনদেন হয়,' যোগ করেন তিনি।

তিনি জানান, এর অর্থ হলো শেয়ারবাজারের বেশিরভাগ বিনিয়োগকারী কারসাজি করা শেয়ারে বেশি আগ্রহ দেখান।

ব্যাংকিং ও এনবিএএফআই খাতে ২৮ শতাংশ বা ১৬টির শেয়ার দর গায়ের দরের চেয়ে কম আঠে নিচে আছে। ডিএসইর তথ্য অনুযায়ী, অন্য সব খাতের ৪ শতাংশ বা ১২টি কোম্পানি ফেসভ্যালুর নিচে আছে।

এসব প্রতিষ্ঠানের মধ্যে ১০টিই টেক্সটাইল খাতের। আর বেশিরভাগ কোম্পানির পারফরম্যান্স মানসম্মত নয় এবং তাদের প্রচুর শেয়ার আছে।

Comments