৬৫ বছরেও 'তরুণ' দেশবন্ধু সুইটমিট

মতিঝিলে অবস্থিত দেশবন্ধু সুইটমিট। ছবি: মাহমুদ নেওয়াজ জয়

সময়টা ৫০ এর দশকের শেষ দিক। শচী মোহন গোপ তখন রাস্তায় বিক্রি করতেন দুধ, দই আর মাঠা। ১৯৫৮ সালে প্রতিষ্ঠা করলেন নিজের রেস্তোরাঁ। নাম দেশবন্ধু সুইটমিট অ্যান্ড রেস্টুরেন্ট। আইটেম হিসেবে এলো সকাল আর সন্ধ্যার জন্য পরোটা, লুচি। সঙ্গে হালুয়া, লাবড়া আর ৩-৪ প্রকারের মিষ্টি।

দেশবন্ধু হিসেবে পরিচিত ছিলেন চিত্তরঞ্জন দাশ (১৮৭০-১৯২৫)। তার সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ছিল নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসুর। তাদের জীবনদর্শন গভীরভাবে প্রভাবিত করেছিল শচী মোহনকে। আর তাই মতিঝিলে নিজের প্রতিষ্ঠা করা রেস্তোরাঁর নাম দেশবন্ধু দিয়েছিলেন।

সে সময় ইত্তেফাক পত্রিকার অফিস ছিল এর বিপরীতেই। সংবাদকর্মীরা নাশতা করতে আসতেন। সেখান থেকেই ছড়িয়ে গেল নাম।

এখানে প্রায় ৪২ বছর ধরে কাজ করছেন বাবুল দেবনাথ। তিনি জানালেন বিখ্যাতদের পদধূলি পড়ার কথা।

বললেন, 'এমন একটা সময় ছিল যখন কবি, লেখক, শিল্পীরা এদিকে আসতেন, আড্ডা দিতেন। এই হোটেলে ফিল্মের লোকজনও আসতেন। তখন তো গুলিস্তানের এদিকেই ছিল শহর। পুরান ঢাকাও খুব জমজমাট। আর তার সঙ্গে মতিঝিলের এদিকটাও ৬০ এর দশক থেকে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠছিল। এদিকে বাণিজ্যিক বিভিন্ন ভবনও ছিল। তখন আমাদের দোকানের বিপরীতে ইত্তেফাকের অফিস। প্রথমে মানিক মিয়া ছিলেন সম্পাদক, যুদ্ধের আগেই মারা যান। আমি তার গল্প শুনেছি। এখানে এক সময় আসতেন তিনি, সঙ্গে আরও নামকরা সব সাংবাদিক।'

প্রতিষ্ঠাতা শচী মোহন গুহ। ছবি: মাহমুদ নেওয়াজ জয়

বাবুল দেবনাথ ৮০ এর দশকের শুরু থেকে কাজ করছেন এখানে। সে সময় প্রতিষ্ঠাতা শচী মোহন গোপ বেঁচে ছিলেন। তার কাছেই এসব গল্প শুনেছেন।

রেস্তোরাঁর ক্যাশে বসা মিন্টু দত্ত বললেন, 'শচী বাবু মারা গেছেন ১৯৮৫ সালে। বাবুল কাকা তাকে সরাসরি পেয়েছিলেন। আমি এখানে আছি ২০১৮ সাল থেকে। আমি তাদের থেকে শুনি আগেকার সেই ঘটনাগুলো।'

বাবুল দেবনাথ স্মৃতির অর্গল খুলে বসেন।

বলেন, 'এখন তো মিডিয়ার লোকজন তত আসে না। কিন্তু ৬০-৭০ এর দশকে এখান থেকে বহুবার এফডিসিতে নাশতা গেছে। এখানকার হালুয়া (সুজি), পরোটা আর ভাজির খ্যাতি ছিল পুরো ঢাকায়৷ এখনও আশপাশ তো বটে, বাইরে থেকেও লোকজন খেতে আসে। এই হোটেলের নাশতা রাজ্জাক, কবরী, শাবানাদেরও পছন্দের ছিল।'

রসগোল্লা, রাজভোগ ও (পেছনে) শিঙাড়া ও নিমকি। ছবি: মাহমুদ নেওয়াজ জয়

'বিভিন্ন অনুষ্ঠান বা আয়োজনে আশপাশের প্রতিষ্ঠানগুলো খাবার নিত এখান থেকে। রেস্তোরাঁয় পরোটা, ভাজি (লাবড়া), হালুয়ার পাশাপাশি আছে ৪-৫ রকমের মিষ্টি। ছানা আমিত্তি, কালাই আমিত্তি, কালোজাম, রসগোল্লা ও রাজভোগ। এ ছাড়া শিঙাড়া, নিমকি,লাড্ডু, দই', বলেন তিনি।

মিন্টু দত্ত জানালেন, দইটা পুরো টক না, টক-মিষ্টি মেশানো দুধের দই। দোকানের শুরু থেকেই আছে এটা। আর দুপুরেও খাবার হিসেবে ভাত, রুই মাছ, মুড়িঘণ্ট, মুরগি, খাসি এসব পাওয়া যায়। সেটাও অনেকদিন আগে, অর্থাৎ শচী মোহন থাকতে থাকতেই চালু হয়েছিল। এখন দোকান তার ছেলে শ্যামল গোপের মালিকানায় চলছে।

দোকানে আছে বসার জন্য ৬টি টেবিল। প্রায় ২৪-২৫ জন এক সময়ে বসে খেতে পারবেন।

ছবি: মাহমুদ নেওয়াজ জয়

মিন্টু দত্ত বলেন, 'দোকানে আইটেম এই কয়টাই। কিন্তু সকাল ৭টা থেকে রাত ১০টা-বিক্রি একনাগাড়ে চলবেই। সকালেও পরোটা-হালুয়া-ভাজি চলে, সন্ধ্যায়ও তাই। মিষ্টির ভেতর আমিত্তি, রসগোল্লা বেশি চলে। মাসকালাইয়ের আমিত্তিটা ছানার চেয়ে বেশি বিক্রি হয়।'

কথা বলতে বলতেই দেখা গেল, কেউ খাচ্ছেন, কেউ আবার পার্সেল নিচ্ছেন। স্থানীয় একজন শিক্ষার্থী শুধু ৩ প্লেট সবজি পার্সেল নিলেন। জানা গেল, এই সবজি তথা লাবড়া আর হালুয়া চাহিদার শীর্ষে। লাবড়াটি আলু,পটল, পেঁপে, বেগুন, মিষ্টিকুমড়ার মিশ্রণ। সঙ্গে পাঁচফোড়নের ব্যবহার এর স্বাদকে আলাদা করতে ভূমিকা রেখেছে।

হালুয়াটি সুজির, যা তখন একেবারে শেষ পর্যায়ে৷ অনেকেই পরোটা/লুচির সঙ্গে মিষ্টির তুলনায় এটি বেশি পছন্দ করেন।

দোকান শুরুর পর শচী মোহন গোপ মাঠা কিংবা দুধ রাখেননি। তবে রেখেছিলেন দই। সেই টক-মিষ্টি স্বাদের দইয়ের ওপরে সরের তেমন আস্তরণ নেই। দই নরম ও মিষ্টি পরিমিত।

এক সময় এখানে চলচ্চিত্র ও সাহিত্য অঙ্গনের অনেকে আসতেন। এখন আর তেমন আসেন না। তাহলে কি বার্ধক্য ছুঁয়ে ফেলেছে দেশবন্ধুকে?

বাবুল দেবনাথ অবশ্য তা মনে করেন না।

লুচির সঙ্গে লাবড়া, টক-মিষ্টি দই, লুচির সঙ্গে রসগোল্লা ও ছানার আমিত্তি। ছবি: মাহমুদ নেওয়াজ জয়

তিনি বললেন, 'শহরের পরিবর্তন তো একটা ব্যাপার। তখন শহর ছিল গুলিস্তান-ওয়ারী-মতিঝিলের এদিকে। ৮০ এর দশক থেকে অন্যান্য জায়গায় শহর গড়ে উঠতে থাকে। ৯০ দশকের পর আরো পরিবর্তন ঘটেছে। তবে এখনো এখানে অন্যান্য এলাকা থেকে অনেক মানুষ আসে। ৯০ দশকেও তো এখান থেকে এফডিসিতে অনেকবার নাশতা গেছে।

এখন সবদিকে নতুন অনেক দোকান হয়েছে। আবার কবি-লেখকদের আড্ডার অন্য জায়গা তৈরি হয়েছে। তা ছাড়া, খাবারের ধরনেও পরিবর্তন এসেছে। লুচি বা পরোটার সঙ্গে সবজি/ লাবড়ার জায়গায় অনেকের ফাস্টফুড, বার্গার, ফ্রাই- এসব আইটেম পছন্দ। তবে দেশবন্ধুর নাশতা এখনো অনেক জনপ্রিয়।'

'আর শুরু থেকে নাশতার জন্য পরিচিত হলেও দুপুরে লাঞ্চ আইটেমও খুব চলে। আশপাশের অফিসগুলোতে যারা চাকরি করেন, তারা খেতে আসেন। তাই রেস্টুরেন্ট এখনো খুব ভালো অবস্থায় আছে, লোকসমাগম ভালো, প্রাণবন্ত আছে', যোগ করেন তিনি।

মিন্টু দত্ত যোগ করলেন, 'শুক্র – শনিবার ছুটির দিন, লোক একটু কম হয়। কিন্তু অফিস চলার দিনগুলোয় দুপুর কিংবা বিকেলে অনেক সময় সবার বসার জায়গা দেওয়া যায় না।'

৬৫ বছর বয়স হলেও দেশবন্ধু সুইটমিটকে তাই বৃদ্ধ বলা যায় না৷ কোলাহলমুখর তারুণ্যই ধরে রেখেছে রেস্তোরাঁটি এখনো।

 

Comments