আটার ডাল যেখানে জনপ্রিয়

ঐতিহ্যবাহী খাবার আটার ডাল। ছবি: সংগৃহীত

গাইবান্ধার এক সময়ের তুমুল জনপ্রিয় আটার ডাল (চালের গুঁড়া বা আটার সঙ্গে মাংসের তরকারি) আবারও ফিরে পাচ্ছে আগের জৌলুস। অনেক বছরের পুরোনো সুস্বাদু এই খাবার আগে শুধু গ্রামাঞ্চলে জনপ্রিয় থাকলেও এখন শহরেও ছড়িয়ে পড়ছে এর নামডাক। 

গণ উন্নয়ন কেন্দ্রের প্রধান নির্বাহী এম আবদুস সালাম দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'স্বাধীনতার পূর্ববর্তী কিংবা পরবর্তী সময়ে গাইবান্ধার অনেক এলাকায় বিশেষ এই খাবার খুবই জনপ্রিয় ছিল। এখনো এই খাবারের প্রচলন থাকলেও কালের বিবর্তনে এর পরিসর সংকুচিত হয়ে এসেছে। ছোটবেলা থেকে দেখেছি এলাকায় কেউ মারা গেলে, মজলিশ কিংবা কোথাও বড় করে বিয়ের অনুষ্ঠান হলে সেখানে সাদা ভাতের সঙ্গে আটার ডাল পরিবেশন করা হতো এবং এটা খুবই স্বাদের একটা খাবার ছিল।'

'আমার কাছে মনে হয় যেহেতু এই সুস্বাদু খাবারটি দীর্ঘকাল এই এলাকার ঐতিহ্য বহন করে এসেছে, সেহেতু কোনো না কোনো ফরমেটে যদি খাবারটি চালু থাকত, তাহলে মানুষ একটি ঐতিহ্যবাহী খাবারের স্বাদ পেত। সেই সঙ্গে আমাদের খাবার তালিকায় আবার এই খাবারটি যোগ হতো', যোগ করেন আব্দুস সালাম।

শুধু গাইবান্ধায় নয়, আশেপাশের জেলাতেও আটার ডালের বেশ জনপ্রিয়তা ছিল। এখনো কম-বেশি রয়েছে। তবে এলাকা বা অঞ্চলভেদে একেক জায়গায় একেক নাম। যেমন: জামালপুরে পিঠালি, কুড়িগ্রামের চিলমারী অঞ্চলে এটাকে বলা হয় মেলানি, টাঙ্গাইলে মেন্দা, আর সিরাজগঞ্জ অঞ্চলে আটার ডাল পিটলি নামে পরিচিত।

সম্প্রতি গাইবান্ধা শহরের কয়েকটি রেস্তোরাঁতে বাণিজ্যিকভাবে আটার ডাল তৈরি করা শুরু হয়েছে, যা পার্সেলের মাধ্যমে অনেক জায়গায় যাচ্ছে।

প্রায় বছরখানেক আগে গাইবান্ধায় প্রথমবারের মতো ঐতিহ্যের এই খাবার বাণিজ্যিকভাবে হোটেলে ভোক্তাদের পাতে তুলে ধরেছে বাঙলা হোটেল। শহরের হকার্স মার্কেটে প্রায় বছরখানেক ধরে ঐতিহ্যবাহী এই খাবারের বাণিজ্যিক রূপ দিয়েছে প্রতিষ্ঠানটি। ফলে শহরের ভোক্তারাও মাত্র ১০০ টাকায় আটার ডালের স্বাদ নিতে পারছে।

ঐতিহ্যবাহী খাবার আটার ডাল রান্না করছেন এক নারী। ছবি: সংগৃহীত

কোন সময়ে বা কার হাত ধরে এই অঞ্চলে আটার ডালের প্রচলন হয়েছিল, তা জানতে না পারলেও স্থানীয়রা বলছেন, যুগের পর যুগ ধরে গ্রামীণ জনপদে এই খাবারের প্রচলন আছে। এমনকি সাঁওতাল জনগোষ্ঠীর কাছেও জনপ্রিয় খাবার আটার ডাল। যদিও তাদের রন্ধন পদ্ধতি কিছুটা ভিন্ন।

স্থানীয়দের ভাষ্য, শত বছর ধরে আটার ডাল জনপ্রিয় ছিল গাইবান্ধার তিস্তা, যমুনা ও ব্রহ্মপুত্র নদীর চরাঞ্চলে। এসব অঞ্চলে আগে কেউ মারা গেলে সাধারণত ৪০ দিন পরে কিংবা আরও পরে এক ধরনের কাঙালি ভোজের আয়োজন করত মৃত ব্যক্তির পরিবার কিংবা স্বজনরা।

এমন আয়োজনে আত্মীয়-স্বজন, পাড়া-প্রতিবেশীকে দাওয়াত দেওয়া হয়। আর এই অনুষ্ঠানের প্রধান আকর্ষণ থাকে আটার ডাল। দাওয়াত না পেলেও শুধু আটার ডালের লোভে বিভিন্ন এলাকার মানুষ এমন অনুষ্ঠানে অংশ নেন।

সারারাত ধরে এসব আয়োজনে রান্নার পর ভোরে কিংবা সকালে খাবার পরিবেশন করা হয়। খোলা জায়গায় অসংখ্য মানুষ একসঙ্গে বসে এই খাবারের স্বাদ নেন। এক সময় কলা গাছের পাতা বা স্থানীয় ভাষায় পেটুয়া নামে পরিচিত কলা গাছের বাকলে ভাত আর আটার ডাল পরিবেশন করা হতো। এখন অনেকে ওয়ান টাইম প্লেটে এই খাবার পরিবেশন করেন। ধোঁয়া ওঠা গরম ভাতের সঙ্গে আটার ডালের স্বাদ হয়ে ওঠে অসাধারণ। গাইবান্ধা সদরসহ বেশ কয়েকটি উপজেলায় এই খাবার বেশ জনপ্রিয়।

গাইবান্ধার সমাজকর্মী জাহাঙ্গীর কবির তনু বলেন, 'আটার ডাল গাইবান্ধার একটি সুপ্রাচীন রেসিপি। চরাঞ্চলে এই খাবারের বিশেষ প্রচলন ছিল। এবার এই এলাকার ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী সাঁওতালদের খাবার তালিকায়ও আটার ডাল যুক্ত হয়েছিল। তবে তাদের রান্নার ধরন ছিল আলাদা। মূলত প্রাচীনকাল থেকে এই এলাকার প্রধান শস্য ধান হওয়ার কারণে বিশেষ এই খাবারের প্রচলন শুরু হয়েছিল বলে মনে করা হয়। চালের কুড়া বা আটার সঙ্গে মাংস মিশিয়ে তৈরি হয় এই সুস্বাদু খাবার। আগে এই খাবার শুধুমাত্র মুসলিম সম্প্রদায়ের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকলেও এখন বাণিজ্যিকভাবে হোটেলে খাসির মাংসের আটার ডাল তৈরি হওয়ার কারণে সব সম্প্রদায়ের মানুষ এই আটার ডালের স্বাদ নিতে পারছেন।'

ঐতিহ্যবাহী খাবার আটার ডাল। ছবি: সংগৃহীত

'বর্তমানে শুধু কেউ মারা গেলেই কেবল আটার ডাল তৈরি করা হয় না, বরং বিয়ে, জন্মদিন, বিবাহবার্ষিকীসহ নানা ধরনের সামাজিক অনুষ্ঠানে জনপ্রিয় এই খাবার রান্না করা হচ্ছে। আগে শুধু গ্রামীণ অঞ্চলে এই খাবারের প্রচলন থাকলেও এখন শহরের পরিবারগুলোতে এই খাবারের প্রচলন বেশি দেখা যাচ্ছে', বলেন জাহাঙ্গীর কবির তনু।

বাণিজ্যিকভাবে আটার ডাল তৈরির বিষয়ে জানতে চাইলে গাইবান্ধার বাঙলা হোটেলের পরিচালক সুজন প্রসাদ ডেইলি স্টারকে বলেন, 'আটার ডাল গাইবান্ধার একটি ঐতিহ্যবাহী খাবার। ছোটবেলায় বিভিন্ন গ্রামীণ অনুষ্ঠানে আমি এটা খেয়েছি। সেই সময় লক্ষ্য করেছি যে, অনেক মানুষ এই খাবারটি খেতে উন্মুখ হয়ে থাকত। কারণ সাধারণত বড় কোনো অনুষ্ঠান না হলে এই ডাল রান্না করা হতো না। তাই খুব সহজে মানুষ যেন এই ডাল খেতে পারে, সেজন্য আমি আটার ডাল বাণিজ্যিকভাবে রান্না করছি। এখন অনেক মানুষ পরিবার নিয়ে এসে আমার হোটেলে আটার ডাল খাচ্ছে। আত্মীয়-স্বজনের জন্য নিয়েও যাচ্ছে।'

'গাইবান্ধা ছাড়াও আশেপাশের জেলাগুলো থেকে অনেকেই এই খাবারের স্বাদ নিতে গাইবান্ধা আসছে। সেই সঙ্গে আমরা যেহেতু খাসির মাংসের ডাল রান্না করছি, তাই সব সম্প্রদায়ের মানুষ এখন সহজে এই খাবার খেতে পারছে', যোগ করেন সুজন প্রসাদ।

গাইবান্ধার স্থানীয় জনপ্রতিনিধিরা মনে করেন, যদি সরকারি-বেসরকারি পর্যায় থেকে এই খাবারকে ব্র্যান্ডিং করা হয়, তবে গাইবান্ধার রসমালাইয়ের মতো সারা দেশে এর জনপ্রিয়তাও ছড়িয়ে পড়বে।

Comments

The Daily Star  | English
Bangladesh welcomed 20 percent US tariff

Bangladesh gains edge after US tariff cut

Trump admin has reduced tariffs on Bangladeshi goods from 35% to 20%, a move expected to strengthen the country’s competitiveness against rivals such as India and Vietnam

8h ago