ঢাকা শহরের সব গাছ হয়ত একদিন উন্নয়নের পেটে যাবে

গাছ কাটা
গত ৭ মে দুপুর ১২টার দিকে আবাহনী মাঠের উত্তর-পশ্চিম কোণ থেকে তোলা। ছবি: সুমন আলী/স্টার

'গাছ কাটা নিয়ে কেউ কেউ মর্মাহত হতেই পারেন, কষ্ট পেতেই পারেন। এটা তাদের আবেগের বিষয়।' ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের মেয়র শেখ ফজলে নূর তাপস কথাটা ঠিকই বলেছেন। ধানমন্ডির সাত মসজিদ রোডে গাছ কাটা শুরু হওয়ার ১০ দিনের মাথায় প্রথমবারের মতো এ প্রসঙ্গে কথা বলেছেন নগরপিতা।

অবশ্যই গাছ কাটাটা আবেগের ও দুঃখের বিষয়। এই আবেগ ও ভালোবাসা না থাকলে যেমন পরিবার, সমাজ ও দেশ বাঁচে না, তেমনি প্রকৃতিও বাঁচবে না। গাছ শুধু যে আমাদের ছায়া দেয় তা না, আমাদের জীবনও রক্ষা করে। গাছ আমাদের প্রয়োজন। এই কথাটা একজন শিশুও জানে। তাই যেকোনো মূল্যে গাছকে বাঁচিয়ে রাখাটাই আপনার, আমার ও নগরপিতারও কর্তব্য। 

তিনি আরও বলেছেন, 'আবার অনেকেই ঢালাওভাবে অনেক কথা বলছেন, পূর্ণ তথ্য না নিয়েই কথা বলেন। আসলে উন্নয়ন কাজে অনেক সময় গাছ ফেলে দিতে হয়, কেটে ফেলতে হয়। এটা অত্যন্ত দুঃখজনক। কিন্তু আমরা তখনই করি, যখন নিতান্তই আর কোনো উপায় থাকে না।'

মেয়রকে বিনীতভাবে বলতে চাই, রাস্তা-ঘাটের উন্নয়নের জন্য প্রথমেই কেন নির্বিচারে গাছ কাটতে হবে? ছোট থেকে বড় গাছ, ফুল-পাতায় ভরা গাছ, পাখিদের আবাসন সব নিশ্চিহ্ন করে দিতে হবে কেন? বিশ্বের বিভিন্ন দেশে তো গাছ রক্ষা করেই নগর উন্নয়ন করা হয়। তারা যদি পারে, আপনারা পারছেন না কেন?

ডিএসসিসি আরও বলছে, সড়কটিতে যেসব গাছ ছিল সেগুলো মিডিয়ানের গাছের উপযোগী নয়। গাছগুলো রাস্তায় চলাচলকারী বাসসহ অন্যান্য যানবাহনের ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করত। বিভিন্ন সময় ঝড়ে গাছ ও গাছের ডাল ভেঙে পড়ে দুর্ঘটনা ও মানুষ আহতেরও ঘটনা ঘটেছে। এজন্য মিডিয়ান তৈরি করে ছোট ও মাঝারি আকারের ফুলের গাছ লাগাবে দক্ষিণ সিটি।

আজ উন্নয়নের কথা বলে আপনি যে গাছ কাটছেন, সেই গাছগুলো অন্তত ১০-১২ বছর আগে রোপণ করা হয়েছিল। আমাদের সন্তানরা এই গাছগুলোকে বড় হতে দেখেছে। ওই পথে চলার সময় গাছগুলোতে ধরা নানা রঙের ফুলের সমাহার দেখে পুলকিত হয়েছে। আজ আপনারা রাতের আঁধারে সব গাছ কেটে ফেললেন। কর্তৃপক্ষ বলল, এর চেয়ে দ্বিগুণ-তিনগুণ গাছ লাগানো হবে। এরপর সেই গাছগুলোও একদিন বড় হবে, অন্য কোনো নগরপিতা এসে ১০-১২ বছর পর উন্নয়নের কথা বলে সেগুলোকেও কর্তন করবেন। আর সেদিনও নগরবাসী বা এলাকাবাসী এসব দেখে প্রতিবাদ জানাবেন, কাঁদবেন, আবেগে বিহ্বল হয়ে পড়বেন। হ্যাঁ, এভাবেই ঘটনা চলতে থাকবে।

২ কোটি টাকা ব্যয়ে কংক্রিটের সৌন্দর্যবর্ধনে সাত মসজিদ রোডের কয়েকশ গাছ কেটেছে দক্ষিণ সিটি করপোরেশন। পরিবেশবাদী ও বিশেষজ্ঞরা বলছেন, রাস্তার ডিভাইডারে গাছ রেখেও সৌন্দর্যবর্ধনের কাজ করা যেত। একসঙ্গে একটি রাস্তার সব গাছ কেটে ফেলার মতো এমন নৃশংসতা আগে আমরা দেখিনি। শহরটাকে যেন নগ্ন করে ফেলার পাঁয়তারা চলছে। দফায় দফায় প্রতিবাদ ও মানববন্ধনসহ নানা কর্মসূচি পালন করার পরও দক্ষিণ সিটি করপোরেশন মিডিয়ানের প্রায় এক হাজারের মতো গাছ কেটে ফেলেছে।

আমার বাসায় ছোট ৩টি বারান্দা আছে। সেখানে সাধ্যমতো যত বেশি গাছ লাগানো যায়, লাগিয়েছি। এরমধ্যে কোনো কারণে দু-তিনটি গাছ যদি মারা যায় বা পাতা বিবর্ণ হয়ে পড়ে, কষ্টে বুক ভেঙে যায়। মনে হয়- কেন গাছগুলো মারা গেল? তবে আমি কি ওদের অযত্ন করেছি? এই গাছগুলোর সবুজ পাতা ও ফুল দেখে কত ধরনের পাখি এসে বসে, উড়া-উড়ি করে, পোকামাকড় খায়। চোখ ভরে দেখি আর আনন্দিত হই। কংক্রিটের এই নগর জীবনে এটাই আমার সুখ।

সাত মসজিদ রোড, মিরপুর রোড, শ্যামলী, কল্যাণপুর দিয়ে যারা চলাচল করেন, তারা দেখেছেন রাস্তার মাঝখানে এই ডিভাইডারে যে গাছগুলো লাগানো ছিল, সেই গাছগুলোতেও যখন বিভিন্ন ধরনের ফুল ফোটে, আমাদের মনেও সুখ হত। অথচ সড়কদ্বীপ, ফুটপাত, মিডিয়ান এবং পাবলিক টয়লেট নির্মাণসহ বিভিন্ন অবকাঠামো উন্নয়নের লক্ষ্যে ৯ কোটি ৬২ লাখ টাকার একটি প্রকল্পের অধীনে সব গাছ কাটা হচ্ছে।

মানবাধিকারকর্মী অ্যাডভোকেট সুলতানা কামাল বলেন, '১৯৬১ সাল থেকে ধানমন্ডিতে আছি, তবে সব গাছ কেটে ফেলার মতো এমন নৃশংসতা আগে দেখিনি।' বাংলাদেশ পরিবেশ আইনবিদ সমিতির (বেলা) প্রধান নির্বাহী ও সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান বলেছেন, 'গত ৫ দিনে ধানমন্ডিতে যে তাণ্ডব দেখলাম, তা শুধু এই নগর প্রশাসন দ্বারাই সম্ভব। যে নগর প্রশাসন কারও কথা শোনে না। একটি নগর প্রশাসনের কাছে মানুষ স্বস্তি আশা করে, শান্তি আশা করে। তবে এই নগর প্রশাসন নগরবাসীকে অশান্তি দিচ্ছে। তারা ধানমন্ডি এলাকায় আমাদের কারও কথা শোনেনি, কারও কথা মানেনি, নির্বিচারে গাছ কেটেছে।'

উত্তরের অবস্থাও একইরকম। ঢাকার তাপমাত্রা কমাতে উত্তর সিটির মেয়র ২ লাখ গাছ রোপণের ঘোষণা দিয়েছেন, একজন হিট অফিসার নিয়োগ দিয়েছেন। অন্যদিকে শ্যামলী, কল্যাণপুর, মিরপুর রোডের গাছ কাটা চলছেই। অনুরোধ, আবেদন, নিবেদন, আন্দোলন, স্মারকলিপি পেশ করেও কোনো লাভ হয়নি।

রাস্তার এই চলমান কাজের প্রকল্প পরিচালক গণমাধ্যমকে বলেছেন, 'এ রাস্তাটির মিডিয়ানে এতদিন যে গাছগুলো ছিল, সেগুলো অনেকটাই আগাছা। রাস্তার মিডিয়ানে এসব গাছ থাকার কারণে নানা সময়ে দুর্ঘটনা ঘটেছে। গাছের ডালপালার কারণে গাড়ি চলাচলে প্রতিবন্ধকতারও সৃষ্টি হয়েছে। তাই এসব গাছ কাটার পরে মিডিয়ান তৈরি করে এর মাঝে নানা ধরনের ফুলগাছ ও সৌন্দর্যবর্ধনকারী গাছ লাগানো হবে।'

ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন কতগুলো গাছ কেটেছে? এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, 'এসব অপরিকল্পিত গাছগুলোকে তো আর গাছ বলা যাবে না। দেখা গেছে শত শত জাম গাছ, শত শত আম গাছ। এগুলো তো এক বছর হলেই কাটা পড়ে। এসব গাছের কারণে অর্ধেক রাস্তা আনইউজড (অব্যবহৃত) থাকে।'

গাছের কারণে এই রাস্তায় দুর্ঘটনা ঘটেছে, তা শুনিনি। তারা কোথা থেকে এই খবর পেয়েছেন, জানি না। শত শত আম ও জাম গাছই-বা কোথায় দেখেছেন তারা? তা-ও জানি না। নতুন উদ্যোগে গাছ লাগানোর জন্য আবার নাকি এগ্রিকালচারাল অফিসার নিয়োগ দিচ্ছেন তারা।

বাংলাদেশে যখন নির্বিচারে ও নির্দয়ভাবে গাছ কাটা হয়েছে বা হয়, তখন কখনো দেখিনি রাষ্ট্রীয় পর্যায়, ব্যবসায়ী মহল, রাজনীতিবিদ, আমলা, তারকা বা অন্য পেশাজীবীরা কেউ এ নিয়ে কোনো উদ্বেগ বা ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন। এলাকাবাসী ও পরিবেশবাদীরা বিভিন্ন সময় এগিয়ে এসেছেন। দুঃখ হয় তখন, যখন পশুপাখি নিধন, বন-জঙ্গল লোপাট, গাছ কর্তন, নদী ভরাট ইস্যুকে কোনো অপরাধ বলেই গণ্য করা হয় না। কারও তেমন কোনো উদ্বেগ-উৎকণ্ঠাও লক্ষ্য করি না।

প্রতিটি ক্ষেত্রেই মানুষ দেখছে যে, সবসময় উন্নয়নের একটি প্রবোধ দিয়ে রাখা হচ্ছে সবাইকে। গাছ কাটা, নদী ভরাট, কংক্রিটের জঞ্জাল বানানো— সবই উন্নয়ন। উন্নয়ন হলে পরিবেশকে ধ্বংস করে হতে হবে, পরিবেশের ক্ষতি একটু হবেই, উন্নয়ন আর পরিবেশ সাংঘর্ষিক—এমন মনোভাব আমাদের ওপর চাপিয়ে দেওয়া হচ্ছে। যখন যে সরকার বা অথরিটি যা উদ্যোগ গ্রহণ করছে, সেটাই জনগণের উন্নতির জন্য হচ্ছে, এটাই জনগণকে মেনে নিতে হবে।

এ প্রসঙ্গে বেলার প্রধান নির্বাহী ও সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী সৈয়দা রিজওয়ানা হাসানের এই কথাটি সবসময়ের জন্যই প্রণিধানযোগ্য। তিনি বলেছেন, 'আমাদের উন্নয়নের ন্যারেটিভকে প্রশ্ন করতে হবে। ২৯টি নদী বিশ্বের সবচেয়ে দূষিত, আমাদের বাতাস বিশ্বের সবচেয়ে দূষিত, আমরা সবচেয়ে অবসবাসযোগ্য নগরীতে বাস করি। তার মানে- আমাদের ওপর যে উন্নয়ন চাপিয়ে দেওয়া হচ্ছে, তা আমাদের ইচ্ছা অনুযায়ী নয়। এতে আমাদের কোনো অংশগ্রহণ নেই, আমাদের জেলের নেই, কৃষকের নেই— সেটি আমাদের বুঝতে হবে।' তিনি আরও বলেছেন, 'টেকসই উন্নয়নের সঙ্গে জনসম্পৃক্ততার যে বিষয়টি জড়িত, তা আমাদের দেশে একদমই মানা হয় না। পরিবেশ বিধিতে উল্লেখ থাকলেও তা মানা হয়নি।'

কল্যাণপুরে প্রধান সড়কের পাশে বেশ কয়েকটি বড় গাছ আছে। এর দুই-তিনটি গাছে প্রতিদিন বিকেলে একঝাঁক বক এসে বসে থাকে। মনে হয়-রাতটা তারা এখানেই কাটায়। আমার শুধু ভয় হয়, কোনোদিন সড়ক উন্নয়ন বা সড়ক চওড়াকরণের নামে এই গাছগুলোও যদি কেটে ফেলা হয়, তাহলে বকগুলো সব ভিটেহারা হয়ে যাবে।

এমনিতেই মেট্রোরেলের জন্য অসংখ্য বড় গাছ কাটা পড়েছে ফার্মগেট ও এয়ারপোর্ট রোডসহ অনেক জায়গায়। বড় হতে হতে দেখেছি- মানিক মিয়া এভিনিউকে বৃক্ষশূন্য হতে। রাস্তা প্রশস্ত করার জন্য প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান এখানকার বিশালাকায় গাছগুলো কেটে ফেলেছিলেন। এ ছাড়া, রমনা পার্ক, সোহরাওয়ার্দী উদ্যানও বিভিন্ন সময় হয়েছে বৃক্ষশূন্য।

কোথায়, কখন যে গাছ কেটে ফাঁকা করে ফেলা হচ্ছে, তা চট করে বোঝাও যায় না। পথ চলতে গিয়ে হঠাৎ লক্ষ্য করবেন, ঠা ঠা গরমে মাথার চাঁদি ফেটে যাচ্ছে, বিশ্রাম নেওয়ার জন্য হাঁসফাঁস লাগছে, তখন হয়তো একটু গাছের ছায়া খুঁজবেন, দেখবেন কোথাও কোনো ছায়া নেই। জানতেই পারবেন না কোন ফাঁকে পথের গাছগুলো সব কাটা পড়েছে। এভাবেই ঢাকা শহরের সব গাছ একদিন উন্নয়নের পেটে ঢুকে গেলেও আমাদের অবাক হওয়ার কিছু থাকবে না।

শাহানা হুদা রঞ্জনা, যোগাযোগ কর্মী

(দ্য ডেইলি স্টারের সম্পাদকীয় নীতিমালার সঙ্গে লেখকের মতামতের মিল নাও থাকতে পারে। প্রকাশিত লেখাটির আইনগত, মতামত বা বিশ্লেষণের দায়ভার সম্পূর্ণরূপে লেখকের, দ্য ডেইলি স্টার কর্তৃপক্ষের নয়। লেখকের নিজস্ব মতামতের কোনো প্রকার দায়ভার দ্য ডেইলি স্টার নেবে না।)

Comments

The Daily Star  | English
Bangladesh-India relations

The Indian media and Bangladesh-India relations

The bilateral relationship must be based on a "win-win" policy, rooted in mutual respect, non-hegemony, and the pursuit of shared prosperity and deeper understanding.

17h ago