উন্নয়নপাঠ: নদী ও প্রাণ, স্মার্ট উন্নয়নের নিগূঢ়পাঠ
'উন্নয়নপাঠ: নদী ও প্রাণ' বইতে উন্নয়ন বিষয়ে প্রশ্ন জারি রাখার ওপরে জোর দেওয়া হয়েছে। প্রশ্ন ছাড়া কোনো কিছু গ্রহণ না করাই আধুনিক দৃষ্টিভঙ্গি। প্রশ্ন করার সক্ষমতা বিশেষ পারদর্শিতাও বটে। যে সমাজে প্রশ্ন নেই সে সমাজ স্থবির। আর স্থবিরতা তৈরি করে অচলায়তন। প্রশ্ন মানে গতিশীলতা। বিজ্ঞানী আলবার্ট আইনস্টাইন বলেছিলেন-প্রশ্ন বন্ধ করা যাবে না। প্রশ্ন ও মুক্তি সহোদর।
আমীন আল রশীদ তার বইতে অনেকগুলো গুরুতর প্রশ্ন তুলেছেন। যেমন ''এ উন্নয়ন নিশ্চয়ই ১০ শতাংশ মানুষের জন্য নয়। উন্নয়নের সুফল যদি রাষ্ট্রের প্রান্তিক মানুষকে স্পর্শ না করে; টিসিবির লম্বা লাইনে দাঁড়িয়ে যদি মধ্যবিত্তের মাথা নিচু হয়ে যায়, তাহলে সেই আয়ের ২,৬০০ ডলার কোনো অর্থবহন করে কি না, সেটিই প্রশ্ন।''
অদম্য উন্নয়নের জোয়ারে দেশের নদ-নদী, প্রাণ ও প্রকৃতির কী হাল হয়েছে, লেখক তা তুলে ধরার চেষ্টা করেছেন। গ্রন্থপাঠে প্রতীতি জন্মে অপরিকল্পিত ও অনিয়ন্ত্রিত উন্নয়নের প্রতিপক্ষ হয়ে দাঁড়াচ্ছে মানুষ, নদী, প্রাণ ও প্রকৃতি। উন্নয়নের 'ষড় ক' ও পদ্মার ভবিষ্যৎ প্রবন্ধে লেখক উল্লেখ করেছেন ''বারবার আমাদের নদীগুলোকে খুন করা হয়েছে উন্নয়ন ও প্রবৃদ্ধির অজুহাতে''। তিনি আরও লিখেছেন-''প্রভাবশালীরা নদী তীরে কারখানা গড়ার অনুমতি পেলে নদীও খেয়ে ফেলে।
বাংলাদেশকে খাদক রাষ্ট্রে পরিণত করা হয়েছে-যার নিপুণ বুনন উঠে এসেছে এ সংকলনে। জনগণের সম্পদ কীভাবে সুরক্ষা করতে হয় সেই মনোভঙ্গি নেই রাজনীতিবিদ, ব্যবসায়ী ও আমলাতন্ত্রের সমন্বয়ে গড়ে নতুন উন্নয়ন যোগসূত্রে। তাদের ভোগের প্রবণতা অপ্রতিরোধ্য, টাকা বানানোর পাঁয়তারায় লিপ্ত। বাংলাদেশকে টাকা বানানোর মেশিন পরিণত করা হয়েছে। উন্নয়নজীবীরা শুষে নিচ্ছে বাংলাদেশের হৃদয়। লেখকের একাধিক প্রবন্ধে নদ-নদী, খাল-বিল দখল, দূষণ, হত্যা ঘুরে ফিরে এসেছে। তিনি চ্যালেঞ্জের মুখে পড়া নদীগুলো সবিস্তার আলোচনা তুলেছেন।
লিখেছেন, ''নদী বিপন্ন হলে মানুষও বিপন্ন হবে। নদীমাতৃক দেশ থেকে যদি নদীই হারিয়ে যায়, সেই দেশে মানুষ থাকবে কীভাবে? '' আমরা জানি, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর পদ্মা পাড়ি দিয়ে শিয়ালদহ আসতেন। মৈত্রীয় দেবীকে লেখা এক চিঠিতে রবীন্দ্রনাথ বলছেন, বাংলাদেশের মতো মনটা আমার নদীমাতৃক। পদ্মা থেকে দূরে এসে অবধি আমি যেন নির্বাসনে আছি-দূর হতে প্রায় তার ডাক শুনতে পাই।
সড়কমুখীনতা কীভাবে নদীপথসমূহকে ক্রমশ সংকুচিত করে তুলেছে, প্রবন্ধ সংকলনে তাও তুলে ধরা হয়েছে সবিস্তারে। লেখকের শ্লেষ মিশানো বয়ান-''বাংলার মানুষ এতই পারঙ্গম যে, সে তার দেশকে নদীমাতৃক বলার পরও, নদী যার মাতা, সেই মাকে হত্যা করে, এমন আত্মঘাতী সন্তান পৃথিবীতে বিরল।''
উন্নয়ন প্রদর্শন রাষ্ট্রের একটি বিশেষ অভ্যাস হয়ে উঠেছে। রাষ্ট্র হয়ে উঠেছে প্রদর্শনবাদী। বড় বড় অবকাঠামো নির্মাণ ও বিনির্মাণ মাধ্যমে রাষ্ট্র জনমনস্তত্ত্বে স্থায়ী আসন গাড়তে চায়। পাবলিক মেমোরির একচ্ছত্র মালিকানা নিতে চায়। উন্নয়নের বিশাল প্রদর্শনীর মূল রাজনীতি হলো কদর্য রূপকে ভুলিয়ে রাখা। যেমনটি উত্তরাধুনিক তাত্ত্বিক মিশেল ফুকো বলেছেন-দেখানোটা একটা ফাঁদ।
রাষ্ট্র বাতিক রোগে আক্রান্ত। কারণে অকারণে সবকিছুর ভেতর ষড়যন্ত্র খোঁজার অপপ্রয়াস তার। দুঃখকষ্টে প্রাণখুলে শোক প্রকাশের নাগরিক অধিকারও আজ সংকুচিত। জোরে হাসাও যায় না কাঁদাও যায় না। হাসি ও কান্না দুটিই রাষ্ট্রের নিমর্ম ব্যাকরণের কবলে। লেখন আমীন আল রশীদের যুতসই চয়ন, ''একজন পঞ্চাশোর্ধ মানুষ যদি সংসারের খরচ মেটাতে ব্যর্থ হয়ে ক্যামেরার সামনে কান্না করেন, সেটিকেও ষড়যন্ত্র বলে আখ্যা দেয়ার লোকের অভাব নেই''।
বাংলাদেশ আজ প্রকল্পশাসিত দেশ। হাজারো প্রকল্পের সমষ্টি বাংলাদেশ। প্রকল্পভিত্তিক উন্নয়নের রয়েছে ব্যাপক রাজনৈতিক অর্থনীতি। এসব নির্বিচার উন্নয়নের সুফল সাধারণ মানুষ কতটুকু পায়, তা নিয়ে লেখক আমীন আল রশীদ প্রশ্ন তুলেছেন- ''এসব উন্নয়নের সুফলভোগী শতকরা ১০ ভাগ মানুষ।...রাষ্ট্রে যখন ব্যবসায়ী ও ঠিকাদারারই যখন নীতিনির্ধারকদের আসনে বসে যান, তখন তাদের কাছে উন্নয়ন মানেই প্রকল্প।''
অসম উন্নয়ন বাংলাদেশের উন্নয়ন ডিসর্কোসের একটি প্রধান প্রবণতা। অথচ মহান মুক্তিযুদ্ধের মূল চেতনা ছিল একটি সমতাভিত্তিক সমাজ প্রতিষ্ঠা। গ্রামপ্রধান বাংলাদেশকে আজ পুরো নগরের সাজে সাজানো হচ্ছে। নগর হয়ে উঠছে উন্নয়নকেন্দ্র। লেখক তাঁর ''যানজট মানেই উন্নয়ন'' প্রবন্ধে বলছেন- ''শহরে বা নগরে এসে বাংলাদেশকে পাওয়া যায় না। শহর বা নগরে এসে বাংলাদেশ নিহত হয়।''
আমীন আল রশীদের প্রবন্ধগ্রন্থের শেষ প্রবন্ধ ''উন্নয়নকে প্রশ্ন করাই উন্নয়ন সাংবাদিকতা''।
সাংবাদিকদের অন্যতম প্রধান কাজ হলো প্রশ্ন করা। কার জন্য এ প্রশ্ন। খুব সহজ উত্তর যারা ক্ষমতা এবং টাকা নিয়ে ডিল করেন। পাবলিক পোর্টফলিও হোল্ড করেন। জনগণের দ্বারা আরোপিত ক্ষমতা বা অর্থে ব্যয়িত যে কার্যক্রম সম্পর্কে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ প্রশ্ন করার পূর্ণ অধিকার একজন সাংবাদিকের রয়েছে। সাংবাদিক জনগণের হয়ে প্রশ্ন করেন। জনগণের জানার এ অধিকার জাতীয় ও আন্তর্জাতিক সকল মানদণ্ডে স্বীকৃত।
উন্নয়নের স্যালাইন তত্ত্বে শেষের দিকে লেখক লিখছেন-''রাষ্ট্র চায় প্রশ্নহীন আনুগত্য''। এ অনুগত্য নিয়ে রাষ্ট্রের সংশয় জাগলে বা সন্দেহ তৈরি হলে রাষ্ট্র বিষয়টি নানাভাবে লেবেলিং করে; যেমন-উন্নয়ন ও সরকারবিরোধী ষড়যন্ত্র। রাষ্ট্রের কাজ প্রশ্নকে হত্যা করা বা নিদেনপক্ষে আহত করা। কারণ, রাষ্ট্র প্রশংসা শুনতে অভ্যস্ত, প্রশ্ন নয়। প্রশ্ন শুনলে রাষ্ট্রীয় মেশিনারিজ অস্বস্তিবোধ করে। রাষ্ট্র চায় সলিড আনুগত্য, যেখানে কোনো প্রশ্ন থাকবে না। জনগণ ভেড়ার পালের মতো সবকিছু অনুসরণ করবে। রাষ্ট্রীয় বয়ান পুনরুৎপাদন করবে সমবেতভাবে, কোরাসের তালে। জনগণ হবে বাধ্যতামূলক গল্প শোনা দেশের গর্বিত অংশীদার।
কিন্তু তা হয় না। সাংবাদিককে প্রশ্ন করতে হয়। তাদের ভেতর সংশয় থাকতে হয়। অনুসন্ধানী মনোভঙ্গি থাকতে হয়। লেখক লিখছেন- ''সাংবাদিকদের প্রথম ও প্রধান কাজ হলো প্রশ্ন করা। কিন্তু এখন প্রশ্ন করতে যত ভয়। প্রশ্ন না থাকলে সাংবাদিকতা থাকে না; সেটি হয়ে যায় জনসংযোগ।'' লেখক উদাহরণ দিয়েছেন-এদেশে এক কিলোমিটার পাকা রাস্তা বানাতে উন্নত দেশেগুলোর তুলনায় খরচ বেশি হয়, আবার বারবার কেন প্রকল্প সময় বাড়ানো হয় এবং ব্যয় বরাদ্দ বাড়ানো সেগুলো নিয়ে প্রশ্ন তোলাটা গুরুত্বপূর্ণ। তিনি আরও লিখেছেন- ''উন্নয়ন নামে যে ধোঁয়াশা বা মিথ তৈরি হয়, তাকে ব্যবচ্ছেদ করতে পারাটা ভীষণ প্রয়োজনীয়।''
কিন্তু ভয়ংকর যে ব্যাপারটি ঘটে গেল তা হলো প্রশ্নহীন সাংবাদিকতা। এর বিপরীতে তরতর করে দাঁড়িয়ে গেল ''ধন্যবাদ সাংবাদিকতা''। খুব যুতসই একটি শব্দবদ্ধ লেখক বেছে নিয়েছেন। তিনি আরও লিখেছেন- ''ধন্যবাদ সাংবাদিকতার সবচেয়ে বড় সুবিধা এখানে ঝুঁকি কম, সুবিধা বেশি।'' ধন্যবাদ সাংবাদিকতার প্রবল স্রোতের বিপরীতে গিয়ে ক্রিটিক্যাল প্রশ্ন করার অভিজ্ঞতা সুখের হয় না। পেটে হাত পড়তে পারে এবং পড়েও। গণমাধ্যম মালিকেরাও চান না কিছু তলিয়ে দেখা হোক। কেউ ঝুঁকি নিতে চায় না। কথাসাহিত্যিক হুমায়ুন আহমদের সৃষ্ট নাট্যচরিত্র ফারুক আহমেদের একটি উক্তি সমকালীন বাস্তবতা বুঝাতে লেখক ব্যবহার করেছেন- ধন্যবাদ দিয়ে কুল পাই না, সাংবাদিকতা করব কখন? লেখকের কলমেও নিকষ অন্ধকার বেরিয়ে এসেছে-উন্নয়ন নিয়ে প্রশ্ন করার চেয়ে প্রশংসা করাই এখন বেশি নিরাপদ।
উন্নয়ন দেখার ক্ষেত্রে আমীন আল রশীদ যে ক্রিটিক্যাল লেন্স ব্যবহার করেছেন তা স্বতন্ত্র। নানা পক্ষের দায়-দায়িত্ব নিয়ে তিনি প্রশ্ন তুলেছেন। গ্রন্থপাঠে পাঠক স্মার্ট উন্নয়নকে ভিন্নভাবে দেখার দৃষ্টিভঙ্গি পাবেন। যিনি নতুন দৃষ্টিভঙ্গি উপহার দেন তিনি অনন্য বটেই।
যানজট, সড়ক দুর্ঘটনা, ঈদযাত্রা, আমলাদের বিদেশ সফর, মাথাপিছু আয়, কলকারখানায় আগুন, সরকারি তদন্ত এবং হাওর প্রসঙ্গে অন্তর্ভেদী বিবরণ এসেছে প্রবন্ধগ্রন্থে। যা একুশে বইমেলায় পাওয়া যাচ্ছে। বইয়ের প্রচ্ছদ এঁকেছেন মুজিব মুহাম্মদ।
Comments