শীতলক্ষ্যা পাড়ে অর্ধশতাধিক গাছ কাটল বিআইডব্লিউটিএ
একটি উন্নয়ন প্রকল্পের জন্য নারায়ণগঞ্জ শহরের শীতলক্ষ্যা নদীর তীরে কয়েক ডজন গাছ কেটে ফেলেছে বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌ-পরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআইডব্লিউটিএ)।
তবে, নির্বিচারে গাছ কাটার এই কার্যক্রমকে 'গণহত্যার' সঙ্গে তুলনা করে প্রতিবাদ জানিয়েছেন স্থানীয় বাসিন্দা ও পরিবেশকর্মীরা।
বিআইডব্লিউটিএ নারায়ণগঞ্জ নদীবন্দর সূত্রে জানা যায়, ওই এলাকায় একটি মাল্টিপারপাস টার্মিনাল নির্মাণের প্রকল্প নিয়েছে বিআইডব্লিউটিএ। সেখানে থাকবে আধুনিক রেস্ট হাউস, পার্কিং প্লেস। এ প্রকল্পের নির্মাণ কাজের জন্য গাছ কাটা হচ্ছে।
গতকাল শনিবার দুপুরে সরেজমিনে প্রকল্প এলাকায় গিয়ে দেখা যায়, নারায়ণগঞ্জ শহরের ৩ নম্বর মাছঘাট এলাকায় নদীর তীরে গাছ কেটে স্তূপ করে রাখা হয়েছে। কাটা গাছের অন্তত ৩২টি অবশিষ্ট নিচের অংশ (গোড়া) খুঁজে পাওয়া গেছে, যা সম্প্রতি কাটা হয়েছে।
স্থানীয়রা জানায়, সপ্তাহখানেক ধরে গাছগুলোকে কাটা হচ্ছে। ইতোমধ্যে দশ বছর বয়সী কড়ই ও বটগাছসহ অর্ধশতাধিক গাছ কেটে ফেলা হয়েছে।
মাছঘাট এলাকায় সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত একটি কড়ই গাছের নিচে সবজি বিক্রি করতেন ষাটোর্ধ্ব শাহানুর বেগম। শনিবার দুপুরে তাকে রোদ থেকে বাঁচতে মাথার উপর একটি প্লাস্টিকের ব্যাগ টেনে রাখতে দেখা যায়। কারণ, যে কড়ই গাছটি এতদিন তাকে ছায়া দিচ্ছিল, সেটি কেটে ফেলা হয়েছে।
কেটে ফেলা গাছটির গোড়া দেখিয়ে এই নারী দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'আমি কয়েক বছর ধরে এখানে সবজি বিক্রি করি। গ্রীষ্ম-বর্ষায় এই গাছ আমারে আরাম দিত। এখন চারিদিকে ছায়ার কিছু নাই। ব্যাগ মাথায় দিয়া রইদের তাপ থেকে বাঁচতেছি।'
'আমরা শুনেছি এইখানে সরকারি ভবন করা হইব, তাই গাছ কাটা হইছে। গাছ কাটায় কষ্ট হইলেও আমাদের কথা তো কেউ চিন্তা করে না', বলেন শাহানুর।
এদিকে, নির্বিচারে গাছ কাটার প্রতিবাদ জানিয়েছেন স্থানীয় পরিবেশ ও সংস্কৃতিকর্মী। রোববার দুপুরে তারা বিআইডব্লিউটিএ চেয়ারম্যান, পরিবেশ অধিদপ্তর, জেলা প্রশাসক ও নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশনে স্মারকলিপি দিয়েছেন।
এর আগে গত বুধবার নদীর তীরে যেখানে গাছ কাটা হচ্ছে সেখানে মানববন্ধনও করেছেন তারা। প্রতিবাদের অংশ হিসেবে সেখানে দুই দিনব্যাপী আলোকচিত্র প্রদর্শনীও করা হয়েছে।
গাছ কাটার এই কার্যক্রমকে 'গণহত্যা' আখ্যা দিয়ে 'শীতলক্ষ্যা পাড়ের গাছ রক্ষায় নারায়ণগঞ্জবাসী' আন্দোলনের সমন্বয়ক কবি আরিফ বুলবুল বলেন, 'নদীর তীরে নিরিবিলি জায়গা হওয়ায় এটি ছিল সংস্কৃতিমনা বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষের মিলনমেলা। এটি বিভিন্ন পাখি এবং অন্যান্য প্রজাতির বাসস্থানও ছিল। এমন একটি ছায়া-সুনিবিড় প্রাকৃতিক পরিবেশ ধ্বংস করে ইট-পাথরের দালান তৈরি করা একটি অদরকারি কাজ। কোনো দায়িত্বশীল ব্যক্তি নির্বিচারে এভাবে গাছ কেটে বাস্তুতন্ত্রের ক্ষতি করতে পারে না। আমি এটাকে গণহত্যাই বলতে চাই।'
পরিবেশ অধিদপ্তর সূত্রে জানা যায়, শীতলক্ষ্যা নদীর চারপাশের এলাকাসহ দেশের ১৩টি এলাকাকে প্রতিবেশগতভাবে সংকটপূর্ণ এলাকা হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। এ এলাকাগুলোতে প্রাকৃতিক বন ও গাছ কাটা বা আহরণ, প্রাণী ও উদ্ভিদের আবাসস্থল ধ্বংসকারী কার্যকলাপসহ নয়টি কার্যক্রম সরাসরি নিষিদ্ধ করা হয়েছে আইনে।
গণসংহতি আন্দোলন নারায়ণগঞ্জ জেলা কমিটির সমন্বয়কারী ও পরিবেশবাদী সংগঠন 'প্রতিবেশ আন্দোলন' এর সদস্য তরিকুল সুজন বলেন, 'ইসিএ তালিকায় শীতলক্ষ্যা নদী ১২ নম্বরে। বিআইডব্লিউটিএ নির্মাণের জন্য এই নদীর তীরের শতাধিক গাছ কেটে ফেলেছে যা গ্রহণযোগ্য নয়। আমরা বিশ্বাস করি যে, এই গাছগুলো রেখেই অবকাঠামো তৈরি করা যায়।'
না জানিয়ে গাছ কাটায় খুশি নয় নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশন। করপোরেশনের নগর পরিকল্পনাবিদ মঈনুল ইসলাম ডেইলি স্টারকে বলেন, 'নগর এলাকায় যে কোনো উন্নয়ন কার্যক্রম নেওয়ার আগে সিটি করপোরেশনের সঙ্গে আলোচনা করা উচিত। কিন্তু, বিআইডব্লিউটিএ তাদের কাজের বিষয়ে আমাদের জানায়নি। শীতলক্ষ্যার আশপাশের এলাকা ইসিএ তালিকাভুক্ত হওয়া সত্ত্বেও আমরা জানতে পেরেছি যে বেশ কিছু গাছ কেটে ফেলা হয়েছে যা নিশ্চিতভাবে বাস্তুতন্ত্রকে ব্যাহত করবে। সিটি করপোরেশন এ বিষয়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেবে।'
অন্যদিকে, এই প্রকল্পটি রাজউকের ডিটেইল এরিয়া প্ল্যানকেও বাধাগ্রস্ত করবে বলে মনে করেন তিনি।
যোগাযোগ করা হলে বিআইডব্লিউটিএ নারায়ণগঞ্জ নদী বন্দরের নির্বাহী প্রকৌশলী নিজাম উদ্দিন পাঠান ডেইলি স্টারকে বলেন, 'নদীর পাড়ে এই এলাকায় একটি টার্মিনাল ভবন নির্মাণ করা হবে। এই প্রকল্পের কারণে কিছু গাছ কাটতে হয়েছে। গাছগুলো বিআইডব্লিউটিএ'র জমিতেই ছিল। নিয়ম মেনে আমরা বন বিভাগ ও বিআইডব্লিউটিএ'র অনুমতি নিয়ে গাছ কেটেছি।'
Comments