‘ছাড় দিয়ে বড় ঋণখেলাপিদের আড়ালে রাখা হচ্ছে’

দেশে খেলাপি ঋণের পরিমাণ অন্তত দেড় লাখ কোটি টাকা এবং ঋণ নিয়ে চলমান মামলাসহ নানা ইস্যু মিলিয়ে মোট পরিমাণ ৪ লাখ কোটি টাকার বেশি হবে বলে মনে করেন অর্থনীতিবিদরা। গতকাল জাতীয় সংসদে শীর্ষ ২০ ঋণখেলাপির তালিকা প্রকাশ করেছেন অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল। তাদের মোট ঋণের পরিমাণ প্রায় ১৯ হাজার ২৮৩ কোটি ৯৩ লাখ টাকা। এর মধ্যে খেলাপি ঋণের পরিমাণ ১৬ হাজার ৫৮৭ কোটি ৯২ লাখ টাকা।

ঋণখেলাপির এই তালিকা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন অর্থনীতিবিদরা।

সংসদে অর্থমন্ত্রী আরও জানান, বাংলাদেশে বর্তমানে মোট ঋণখেলাপি গ্রাহকের সংখ্যা ৭ লাখ ৮৬ হাজার ৬৫। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, গত সেপ্টেম্বর শেষে ব্যাংক খাতের মোট খেলাপি ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ১ লাখ ৩৪ হাজার ৩৯৬ কোটি টাকায়।

অর্থনীতিবিদরা বলছেন, ২০১৯ সালে মে মাসে ১০ থেকে ৫০ শতাংশের পরিবর্তে পরিশোধযোগ্য ঋণের ২ শতাংশ অর্থ জমা দিয়ে ১০ বছরের জন্য ঋণখেলাপির তালিকা থেকে নাম কাটানোর সুবিধা বর্তমান অর্থমন্ত্রী দিয়েছিলেন। সেই সুবিধা নিয়েই শীর্ষ ঋণখেলাপিরা তালিকা থেকে তাদের নাম বাদ কাটিয়েছেন।

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের সাবেক শিক্ষক অধ্যাপক ড. মইনুল ইসলাম দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'অর্থঋণ আদালত ও সুপ্রিম কোর্টে যে মামলাগুলো বিচারাধীন, সেগুলোকে ক্লাসিফায়েড ঋণে অন্তর্ভুক্ত করা হয় না। এটাই মোট খেলাপি ঋণের প্রধান অংশ। আরেকটি বিষয় হলো মন্দ ঋণ রাইট-অফ করা হয়েছে। সেটা ৫৫ হাজার কোটি টাকার মতো। সেটাও ক্লাসিফায়েড ঋণে অন্তর্ভুক্ত করা হয় না। এগুলো সব যোগ করলে মোট খেলাপি ঋণের পরিমাণ ৪ লাখ কোটি টাকা ছাড়িয়ে যাবে।'

গতকাল সংসদে প্রকাশিত তালিকা বিষয়ে তিনি বলেন, 'বর্তমান অর্থমন্ত্রী ২০১৯ সালে যে সুবিধাটা দিয়েছেন, সেটা হলো— পরিশোধযোগ্য ঋণের ২ শতাংশ অর্থ জমা দিয়ে ১০ বছরের জন্য খেলাপি ঋণের তালিকা থেকে নাম কাটানো যাবে। এই সুবিধা ব্যবহার করেই রাঘব-বোয়ালরা তালিকা থেকে বের হয়ে গেছে। বাংলাদেশে এই মুহূর্তে সবচেয়ে বড় ঋণখেলাপি কে, তা অজানা নয়। অথচ তার নাম এই ২০ জনের তালিকায় নেই। বর্তমানে যারা দেশে শীর্ষ ঋণখেলাপি, তাদের একজনের নামও কিন্তু ওই ২০ জনের তালিকায় নেই। তারা ২ শতাংশ অর্থ জমা দিয়ে ১০ বছরের জন্য ওই তালিকা থেকে বের হয়ে যাওয়ার সুবিধা গ্রহণ করেছে। সুতরাং ২০ জনের এই তালিকাটা প্রকৃত ঋণখেলাপির তালিকা হতে পারে না।'

'দেশের সবচেয়ে বড় ঋণখেলাপিকে ঋণখেলাপি বলায় তিনি ২০২০ সালের মার্চে আমাকে উকিল নোটিশ দিয়েছিলেন। জবাবে আমি বলেছিলাম, "২ শতাংশ টাকা জমা দিয়ে ১০ বছরের জন্য খেলাপি ঋণের তালিকা থেকে বের হয়ে যাওয়ার সুবিধা গ্রহণ করে আপনি তালিকা থেকে বাদ পড়েছেন। অতএব আপনাকে অভিনন্দন।" এই সুবিধার কারণেই বড় বড় ঋণখেলাপিদের একজনের নামও তালিকায় পাওয়া যাচ্ছে না', বলেন তিনি।

২ শতাংশ অর্থ জমা দিয়ে তালিকা থেকে নাম কাটানোর সুবিধাটি অত্যন্ত ক্ষতিকর ছিল উল্লেখ করে একুশে পদকপ্রাপ্ত এই অর্থনীতিবিদ বলেন, 'বর্তমান অর্থমন্ত্রী ছাড়া আর কেউই আগে এই সুবিধা দেয়নি। এই সুবিধাই শীর্ষ ঋণখেলাপিরা নিয়েছে। এই ধরনের সুবিধা বাতিল করতে হবে। পাশাপাশি প্রত্যেক ব্যাংকের শীর্ষ ১০ ঋণখেলাপিদের জন্য ট্রাইব্যুনাল করার কথা আমি বারবার বলে যাচ্ছি। এগুলো না করলে এই সমস্যা থেকে মুক্তি পাওয়ার কোনো উপায় নেই।'

করোনা মহামারির সময় ২ বছর ঋণের টাকা দিতেই হয়নি উল্লেখ করে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ ডেইলি স্টারকে বলেন, 'আরেকটা সুবিধা দেওয়া হয়েছে যে, ২ শতাংশ টাকা দিলে আর ঋণখেলাপির তালিকায় নাম থাকবে না। এগুলোসহ নানা রকমের ছাড় দেওয়া হয়েছে। এখন অনেকেই এই ২ শতাংশ টাকা জমা দেওয়ার সুবিধাটা নিয়েছেন। যে কারণে কাগজে তাদের নাম নেই। কারণ অফিশিয়ালি তো এখন আর তাদেরকে ঋণখেলাপি বলা যাবে না। বাস্তবতা হলো যেই টাকাটা ঋণ হিসেবে দেওয়া হয়েছে, সেই টাকাটা আর আদায় হচ্ছে না।'

বিভিন্নভাবে ছাড় দিয়ে ঋণখেলাপিদের সুবিধা দেওয়া হচ্ছে উল্লেখ করে এই অর্থনীতিবিদ বলেন, 'ঋণের ওপর এত ছাড় দেওয়াটা ঠিক হচ্ছে না। যত বেশি ছাড় দেওয়া হবে, ততই সমস্যা বাড়বে। সেই সুবিধাই তো ঋণখেলাপিরা নেবে। আমি মনে করি যে ২০ জনের তালিকা প্রকাশ করা হলো, এখন অবিলম্বে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে হবে। ব্যাংক ব্যবস্থাটা নেবে। তাদেরকে বলতে হবে এই কাজটা করতে। আর বাংলাদেশ ব্যাংককে বিবেচনা করতে হবে যে, এরকম ছাড় আর কতদিন দেবে। এর মাধ্যমে তো বাস্তবতাটা আড়াল করে রাখা হচ্ছে।'

বিশ্বব্যাংকের ঢাকা অফিসের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ জাহিদ হোসেন ডেইলি স্টারকে বলেন, ঋণখেলাপিদের তালিকা প্রকাশের বিষয়টি ভালো। কারণ এর ফলে তারা সামাজিকভাবে শাস্তি পাবে। কিন্তু শীর্ষ খেলাপিদের নাম তালিকায় নেই। তাই তালিকাটি প্রশ্নবিদ্ধ।'

'তালিকায় খেলাপি ঋণের প্রকৃত চিত্র উঠে আসেনি' বলে মনে করেন পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুরও

তিনি ডেইলি স্টারকে বলেন, 'আমার কাছে মনে হয়েছে, যাদের ব্যবসা বন্ধ হয়ে যেতে পারে বলে অর্থমন্ত্রীর কাছে মনে হয়েছে, তাদের নামই তিনি সংসদে প্রকাশ করেছেন। রাজনৈতিক মদদপুষ্ট খেলাপিরা ২০১৯ সালে বাংলাদেশ ব্যাংকের দেওয়া সুবিধা গ্রহণ করে তালিকা থেকে নিজেদের নাম কাটিয়েছে। কিন্তু, শীর্ষ খেলাপিদের এই সুবিধা দেওয়া ঠিক হয়নি।'

ব্যাংকিং খাতে শৃঙ্খলা ফেরাতে খেলাপিদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়ার পরামর্শ দেন এই অর্থনীতিবিদ।

Comments

The Daily Star  | English

‘Shockingly insufficient’

"The proposed decision to allocate USD 250 billion per year for all developing countries is shockingly insufficient," said the adviser

8h ago