আমরা অতি দ্রুত বিপজ্জনক অবস্থার দিকে যাচ্ছি: মইনুল ইসলাম

অর্থনৈতিকভাবে দেউলিয়া রাষ্ট্রে পরিণত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে রাজনৈতিক সহিংসতা ছড়িয়ে পড়েছে শ্রীলঙ্কায়। পতন হয়েছে প্রভাবশালী কর্তৃত্ববাদী পরিবার সরকারের।

প্রায় শতভাগ সাক্ষরতার হার ও প্রায় ৪ হাজার ডলার মাথাপিছু আয় নিয়ে যে রাষ্ট্রটির হওয়ার কথা ছিল দক্ষিণ এশিয়ার সিঙ্গাপুর, সেই রাষ্ট্রটি এখন ঋণখেলাপি। বৈদেশিক ঋণে বড় বড় প্রকল্প গ্রহণ, বৈধ চ্যানেলে রেমিট্যান্স প্রবাহ কমে যাওয়া, বড় আয়ের পথ পর্যটন খাতে মহামারির ধাক্কাসহ বিভিন্ন কারণে দেশটির এমন পরিণতি।

শ্রীলঙ্কার সঙ্গে তুলনামূলক আলোচনায় অর্থনীতির সব সূচকে বাংলাদেশ স্বস্তিদায়ক অবস্থায় আছে। তবে আগামী ৪-৫ বছর পরে গিয়ে স্বস্তিদায়ক অবস্থা থাকবে কি না, তা নিয়ে অর্থনীতিবিদরা প্রশ্ন তুলছেন। সতর্ক করছেন, পরামর্শ দিচ্ছেন। সাধারণের জনমনে অর্থনীতি নিয়ে রয়েছে অস্বস্তিকর অনেক প্রশ্ন। সেসব প্রশ্নের উত্তর মিলতে পারে একুশে পদকপ্রাপ্ত অর্থনীতিবিদ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক শিক্ষক অধ্যাপক মইনুল ইসলামের এই সাক্ষাৎকার থেকে।

দ্য ডেইলি স্টার: মাথাপিছু আয়ের আলোচনা আসলেই ২টি বিষয় সামনে আসে। একটি নেতিবাচক আলোচনা হয় যে, আমার আয় তো বাড়ল না। আরেকটি প্রশ্ন আসে, শ্রীলঙ্কার মাথাপিছু আয় তো আমাদের চেয়ে ভালো ছিল। তাহলে, শ্রীলঙ্কার এই অবস্থা হলো কেন? এই বিষয়ের আসলে ব্যাখ্যাটা কী?

অধ্যাপক মইনুল ইসলাম: শ্রীলঙ্কার আমদানি সক্ষমতা এখন শূন্যের কোঠায় নেমে গেছে। শ্রীলঙ্কা আগে থেকেই অনেকগুলো ভুল করছিল। ২০০৯ থেকে ২০১৯ পর্যন্ত দেশটি অনেকগুলো ভুল করেছে, কিন্তু ২০১৯ এ বড় বড় কয়েকটি ভুল করেছে। গোতাবায়া রাজাপাকসে প্রেসিডেন্ট হওয়ার পর ভ্যাট ১৫ শতাংশ থেকে ৮ শতাংশে নামিয়ে ফেলেন, ন্যাশনাল রিবিল্ডিং ট্যাক্স তুলে দেন। কাজেই সরকারের রাজস্ব আয় প্রায় ৩০ শতাংশ কমে যায়।

তারা ২০১৯ সালে প্রাকৃতিক পদ্ধতিতে চাষের জন্য রাসায়নিক সার ও কীটনাশক আমদানি নিষিদ্ধ করে। ফলে তাদের কৃষিজাত ও খাদ্য উৎপাদনে প্রায় এক-তৃতীয়াংশ ফলন বিপর্যয় হয়। এর মধ্যে যখন করোনা মহামারি শুরু হয় তখন তাদের পর্যটন খাত থেকে আয় শূন্যের কোঠায় নেমে যায়, যেটা ছিল তাদের আয়ের সবচেয়ে বড় খাত।

একই সঙ্গে বৈধ পথে তাদের রেমিট্যান্স আসাও প্রায় ৮৫ শতাংশ কমে যায়। অফিসিয়াল চ্যানেলের চেয়ে হুন্ডিতে বেশি অর্থ পাওয়ায় দেশটির মানুষ বৈধ পথে রেমিট্যান্স পাঠানো কমিয়ে দেন। বৈধ পথে এই রেমিট্যান্স না আসায় সেই অর্থ আমদানির কাজে ব্যবহার করতে পারেনি সরকার। আমাদের দেশেও হুন্ডির মাধ্যমে প্রায় ১০ থেকে ১২ বিলিয়ন ডলার আসে। কিন্তু তারপরেও বৈধ চ্যানেলে ২০ থেকে ২২ বিলিয়ন ডলার আসে। বাণিজ্য ঘাটতি পূরণের জন্য রেমিট্যান্স একটি বড় ভূমিকা রাখে। শ্রীলঙ্কায় বৈধ চ্যানেলে রেমিট্যান্স ৮৫ শতাংশ কমে যাওয়ায় রিজার্ভ অতি দ্রুত শূন্যের কোঠায় নেমে গেছে।

দেশটি খাদ্যশস্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ ছিল। ফলন বিপর্যয়ের ফলে তাদের প্রায় ৪৫০ মিলিয়ন ডলার খরচ করতে হয়েছে খাদ্য আমদানি করতে। এতে তাদের রিজার্ভ অতি দ্রুত কমে ৫০ মিলিয়ন ডলারে নেমে আসে। রিজার্ভ না থাকায় খাদ্য, জ্বালানি, ওষুধ কিছুই তারা আমদানি করতে পারছে না।

শ্রীলঙ্কার মাথাপিছু আয় ৪ হাজার ডলারের কাছাকাছি ছিল। কিন্তু, এই টাকা তো আর সবার পকেটে যায় না। এখন প্রচণ্ড মুদ্রাস্ফীতি রয়েছে দেশটিতে। ১ ডলারের বিপরীতে তারা পাচ্ছে ৩১৫ থেকে ৩৩০ রুপি। এই সব মিলিয়ে তাদের অর্থনীতি একেবারে ধসে গেছে।

ডেইলি স্টার: বাংলাদেশে আরেকটি বিষয় আলোচনায় রয়েছে, তা হলো চীনের ঋণের ফাঁদে পড়ে শ্রীলঙ্কার আজ এই অবস্থা। এর কতটা সত্যি?

অধ্যাপক মইনুল: এর পুরোটা সত্য নয়। চীনের ঋণে তারা অনেকগুলো অপ্রয়োজনীয় প্রকল্প করেছে। হাম্বানটোটা সমুদ্র বন্দর, রাজাপাকসে আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর, চাইনিজ কলম্বো সিটি, বেশ কয়েকটি মহাসড়কও তারা করেছে চীনের কাছ থেকে নেওয়া ঋণে। ঋণ বন্ড ছেড়ে প্রায় ৯ বিলিয়ন ডলার আন্তর্জাতিক বাজার থেকে তারা সংগ্রহ করেছে। সব মিলিয়ে তাদের বৈদেশিক ঋণ প্রায় ৫১ বিলিয়ন ডলারে উঠে গেছে, যেখানে তাদের মোট জিডিপি মাত্র ৮০ বিলিয়ন ডলার।

এই ঋণের অর্থ যখন পরিশোধের সময় এসেছে তখন তাদের কিস্তি এসেছে প্রায় ৮ বিলিয়ন ডলার। এটা শোধ করতে না পেরে তারা নিজেদের ঋণ খেলাপি ঘোষণা করেছে।

তবে, সমস্যার প্রধান কারণ রাজস্ব কমিয়ে দেওয়া, প্রাকৃতিক পদ্ধতিতে চাষ করতে গিয়ে ফলন কমে যাওয়া, বৈধ পথে রেমিট্যান্স আসা কমে যাওয়া এবং করোনায় পর্যটন খাতের আয় শূন্য হয়ে যাওয়া।

পাকিস্তানের মতো তাদেরও এখন ভিক্ষার ঝুলি নিয়ে দৌড়াতে হবে। তাদেরকেও এখন আইএমএফের কাছে দৌড়াতে হবে। আইএমএফ নিশ্চয়ই তাদের অনেক শর্ত দেবে। দেশটিতে রাজনৈতিক যে সহিংসতা চলছে সেটা যতদিন চলবে ততদিন আইএমএফ টাকা দেবে না।

সৌদি আরবের কাছে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী শাহবাজ শরীফ গিয়ে ৮ বিলিয়ন ডলার নিয়ে এসেছেন। কিন্তু সৌদি আরব তো শ্রীলঙ্কাকে টাকা দেবে না। ভারত সেখানে ৩ বিলিয়ন ডলার দিয়েছে। চীন তাদের পাওনা ঋণের ক্ষেত্রে রিস্ট্রাকচারিং করলেও নতুন করে ঋণ দিচ্ছে না।

কাজেই সমাধানের জন্য তাদের আইএমএফ ও ভারত, কিংবা অন্য কোনো দেশ যদি তাদের ঋণ দেয় তাহলে সেটা নিতে হবে। এই ঋণের অর্থে যদি দেশটি আমদানি আবার চালু করতে পারে তাহলে ধীরে ধীরে আবার ঘুরে দাঁড়াতে পারবে।

ডেইলি স্টার: অর্থনীতিবিদদের ব্যাখ্যায় বারবার আসছে, বাংলাদেশের কোনো সূচকই বলে না যে আমাদের অবস্থাও শ্রীলঙ্কার মতো হবে।

অধ্যাপক মইনুল: খুব শিগগির বাংলাদেশ কোনো সংকটে পড়বে না, কিন্তু বাংলাদেশেও অনেকগুলো অপ্রয়োজনীয় প্রকল্প গ্রহণ করা হয়েছে। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, রাশিয়ার কাছ থেকে ১২ বিলিয়ন ডলার ঋণ নিয়ে ১ লাখ ১৩ হাজার কোটি টাকা খরচ করে মাত্র ২ হাজার ৪০০ মেগাওয়াট বিদ্যুতের জন্য রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ প্রকল্পের কথা। এটা অত্যন্ত নিকৃষ্টতম সাদা হাতি প্রকল্প। তারা বলছে, ২০ বছরে এই টাকা শোধ করতে পারবে। কিন্তু ২০২৫ সাল থেকে যখন কিস্তি শুরু হবে তখন বছরে ৫৬৫ মিলিয়ন ডলার পরিশোধ করতে হবে।

পদ্মা সেতুর রেললাইন প্রকল্প হচ্ছে ৪০ হাজার কোটি টাকা খরচ করে। সড়ক পথ চালু হলে সড়ক পথের সঙ্গে রেল পথের খরচ কোনো দিনও ফিজিবল হবে না। এখান থেকে যে আয় হবে তা দিয়ে ঋণের কিস্তি শোধ করার কোনো সম্ভাবনা নেই। অতএব, এটা একটা বড় ধরনের বোঝা হয়ে যাবে বাংলাদেশের ওপরে।

তেমনি আরেকটি প্রকল্প সাড়ে ১৮ হাজার কোটি টাকা ব্যয়ে কক্সবাজার পর্যন্ত রেললাইন নির্মাণ। এটা হওয়ার কথা ছিল বাংলাদেশ, চীন, ভারত, মিয়ানমার ইকোনমিক করিডোরের অধীনে। কিন্তু সেই করিডোর তো মরে গেছে। কারণ, ভারত এই প্রকল্প থেকে বের হয়ে গেছে। এডিবি থেকে নেওয়া ঋণে কক্সবাজার পর্যন্ত যে রেললাইন হচ্ছে তার কিস্তির টাকা এর থেকে আয়ের টাকায় শোধ হবে না।

পায়রা বন্দর তো গভীর সমুদ্র বন্দর করার জন্য করা হয়েছিল। এর পেছনে কয়েকশ কোটি টাকা এরই মধ্যে খরচ হয়ে গেছে। কিন্তু এখন আর সেখানে গভীর সমুদ্র বন্দর হবে না, সমুদ্র বন্দর হবে। পায়রা বিদ্যুৎ কেন্দ্রে চীনের অর্থায়ন আছে, তবে ঋণ না। সেটা অবশ্য বাংলাদেশের জন্য বড় ধরনের বোঝা হবে না।

আমরা খামখেয়ালি সিদ্ধান্তে যে একটার পর একটা প্রকল্প নিয়ে চলেছি এর কোনোটারই সঠিক ইকোনমিক ফিজিবিলিটি স্টাডি করা হয়নি। এই ধরনের খামখেয়ালি সিদ্ধান্তে নতুন বিমানবন্দর নির্মাণের করার কথা হচ্ছে, দ্বিতীয় আরেকটি পদ্মা সেতু করার কথা হচ্ছে, দ্বিতীয় বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট উৎক্ষেপণের কথা বলা হচ্ছে, ঢাকাকে অন্য জায়গায় সরিয়ে ফেলার কথা বলা হচ্ছে, ঢাকা থেকে কক্সবাজার পর্যন্ত বুলেট ট্রেন চালু করার কথা বলা হচ্ছে। এগুলো অপ্রয়োজনীয় প্রকল্প, যা আসলে সামষ্টিক চিন্তা থেকে নেওয়া হয়নি। সবই হবে ঋণের টাকায়। আমাদের ঋণের কিস্তি ২০২৫ সালের মধ্যেই ৪ বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়ে যাবে।

এটাতো গেল বৈদেশিক ঋণ। এর সঙ্গে বিশাল অভ্যন্তরীণ ঋণ আছে। সেটা যোগ করলে বাংলাদেশের ঋণ ও জিডিপির অনুপাত ৫০ শতাংশের উপরে চলে যাবে। এটা খুবই বিপজ্জনক একটা অবস্থা। সেখানে আমরা যাচ্ছি অতি দ্রুত। কাজেই দেশি-বিদেশি ঋণ গ্রহণ এবং উল্টোপাল্টা প্রকল্প গ্রহণের ব্যাপারে যদি নিজেদের নিয়ন্ত্রণ না করতে পারি তাহলে বছর চার-পাঁচেকের মধ্যে আমরাও শ্রীলঙ্কার পর্যায়ে চলে যাব।

এ বছরই আমাদের আমদানি প্রায় ৮২-৮৫ বিলিয়ন ডলারে চলে যাবে, কিন্তু রপ্তানি প্রায় ৫০ বিলিয়ন ডলার। এই ৩২-৩৫ বিলিয়ন ডলারের যে বাণিজ্য ঘাটতি সেটা তো রেমিট্যান্স দিয়ে পূরণ করতে পারব না। কাজেই এ বছরই আমাদের ১০ বিলিয়ন ডলারের একটা ঘাটতি সৃষ্টি হচ্ছে।

গত ৮ মাসে রিজার্ভের ৪৮ বিলিয়ন ডলারের যে হিসাব তা ৪২ বিলিয়ন ডলারে নেমে গেছে। পরের ২ মাসে এটা আরও ৪ বিলিয়ন ডলার কমে যাবে। এভাবে যদি আমাদের আমদানি রপ্তানির তুলনায় বাড়তে থাকে এবং সেটা যদি রেমিট্যান্স দিয়ে পূরণ করতে না পারি তাহলে অতি দ্রুত আমাদেরও রিজার্ভ শেষ হয়ে যাবে। রিজার্ভ বিপজ্জনক লেভেলে চলে আসলে টাকারও দাম কমবে। সেক্ষেত্রে আমাদের অর্থনীতিতেও একটা বিপদ আমরা দেখতে পাব, সব কিছুর দাম বেড়ে যাবে। এখন যে স্বস্তির অবস্থানে আমরা আছি সেটা বেশি দিন থাকবে না।

s.mortoza@gmail.com

Comments

The Daily Star  | English

‘Shockingly insufficient’

"The proposed decision to allocate USD 250 billion per year for all developing countries is shockingly insufficient," said the adviser

7h ago