বিএডিসির কৃষি উন্নয়ন প্রকল্পের ভূমি উন্নয়ন কাজেই ‘অনিয়ম’

এক্সক্যাভেটর দিয়ে বীজ আলু উৎপাদন উপযোগী জমি থেকে মাটি কেটে নিয়ে যাচ্ছে ঠিকাদাররা। ছবি: আসাদুজ্জামান টিপু/স্টার

বিএডিসির অধীনে নীলফামারীর ডোমারে দেশের সর্ববৃহৎ 'ভিত্তি বীজ আলু উৎপাদন খামারে' অবৈধভাবে বীজ আলু উৎপাদন উপযোগী ৩ একর উঁচু জমির শ্রেণী পরিবর্তন করে ডোবা বানিয়ে ফেলার অভিযোগ উঠেছে।

খামার কর্তৃপক্ষ ঠিকাদারদের উঁচু জমির মাটি খনন করে তা খামারের অন্য নিচু জমি ভরাট করার সুযোগ করে দিয়েছেন বলে অভিযোগ স্থানীয়দের।

খামার সূত্রে জানা যায়, নিয়ম অনুযায়ী বীজ আলু উৎপাদনের জন্য নিচু জমিকে উঁচু করার প্রয়োজন হলে কার্যাদেশ পাওয়া ঠিকাদাররা খামারের বাইরে থেকে মাটি সংগ্রহ করে নিজ ব্যবস্থাপনায় তা পরিবহন করে জমিতে ফেলবেন। 

তবে এ প্রকল্পের ক্ষেত্রে এ কাজের জন্য বাইরে থেকে মাটি কেনা, পরিবহনসহ অন্যান্য বিষয় বিবেচনায় সরকার যথেষ্ট অর্থ বরাদ্দ দিয়েছে।

উঁচু জমি থেকে মাটি কেটে নেওয়ায় তৈরি হয়েছে ডোবা। ছবি: আসাদুজ্জামান টিপু/স্টার

অভিযোগ উঠেছে, খামার কর্তৃপক্ষ ও ঠিকাদার আর্থিকভাবে লাভবান হতে ভূমি উন্নয়ন কাজে (নিচু জমি উঁচুকরণ) বড় ধরনের অনিয়ম করেছে। অনিয়মের বৈধতা দিতে নিয়ম অনুযায়ী সব কাজ সম্পন্ন হয়েছে উল্লেখ করে পর্যবেক্ষণ দিয়ে কাজের বিপরীতে সম্পূর্ণ বিল পরিশোধ করে দিয়েছে।

খামারের উঁচু জমিকে কেটে ডোবা বানিয়ে ফেলার কারণে, চাষিদের ক্রমবর্ধমান চাহিদা পূরণে বীজ আলু উৎপাদনের জমি বৃদ্ধি করার সরকারি উদ্দেশ্য ব্যাহত হয়েছে। কারণ সদ্য উদ্ধারকৃত ৩ একর আয়তনের উঁচু জমিটি আর বেশি বীজ উৎপাদনের কাজে ব্যবহার করা সম্ভব হচ্ছে না।

বিএডিসি সূত্রে জানা যায়, সরকার বীজ আলু উৎপাদন বৃদ্ধিতে সম্প্রতি ৬০০ কোটি টাকার 'মানসম্পন্ন বীজ আলু উৎপাদন ও সংরক্ষণ এবং কৃষক পর্যায়ে বিতরণ জোরদারকরণ' শীর্ষক প্রকল্প হাতে নিয়েছে।

এ প্রকল্পের আওতায় বিএডিসির সারা দেশের বিভিন্ন আলু বীজ উৎপাদন খামারে গোডাউন, শেড, কোল্ড স্টোরেজসহ বিভিন্ন অবকাঠামো নির্মাণ ও ভূমি উন্নয়ন কর্মসূচি যথা নিচু জমি উঁচুকরণ, জমি উদ্ধার ও অন্যান্য কর্মসূচি হাতে নেওয়া হয়।

বীজ আলু উৎপাদন উপযোগী জমি থেকে মাটি কেটে বিধি বহির্ভূতভাবে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। ছবি: আসাদুজ্জামান টিপু/স্টার

দেশের সর্ববৃহৎ বীজ আলু উৎপাদন খামার হিসেবে ডোমার ভিত্তি বীজ উৎপাদন খামারটি ২০২১-২০২২ অর্থবছরে এ প্রকল্পের কাজের একটি বৃহৎ অংশ বাস্তবায়ন করেছে।

বাস্তবায়নের অংশ হিসেবে খামারের সি-ব্লকের একটি আমবাগান কেটে আলু চাষের জন্য ৩ একর উঁচু জমি উদ্ধার করা হয়।

সেইসঙ্গে, খামারের ৩০-৩৩ একর নিচু জমি তলদেশ থেকে সর্ব্বোচ্চ সাড়ে ৩ ফুট উঁচু করতে একাধিক ঠিকাদারকে কার্যাদেশ দেওয়া হয়। এ কাজের জন্য বরাদ্দ দেওয়া হয় ১২ কোটি টাকা।

কিন্তু নিয়ম অনুযায়ী খামারের বাইরে থেকে মাটি সংগ্রহ করে নিজ ব্যবস্থাপনায় আনার কথা থাকলেও গ্রামবাসীর অভিযোগ, ঠিকাদাররা আম বাগানের উদ্ধারকৃত ৩ একর উঁচু জমির মাটি ৪-৫ ফুট গভীরতায় কেটে ৩০-৩৩ একর নিচু জমি ভরাট করছে।

এ কাজের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট শ্রমিকরা জানান, আম বাগানের মাটি গত ৪-৫ মাস ধরে খামার কর্তৃপক্ষের উপস্থিতিতেই খনন করা হচ্ছে। ঢাকা থেকে প্রকল্প পরিচালক কয়েকবার এলাকাটি পরিদর্শন করলেও, তিনি এ অনিয়মের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেননি।

তারা আরও জানান, খামারের ৩০-৩৩ একর নিচু জমি ভরাট করে উঁচু করতে বাইরে থেকেও মাটি আনতে হয়েছে। 

খামার সংলগ্ন কুমবাড়ীর ডাঙ্গা গ্রামের বাসিন্দা মমিনুর রহমান খামার প্রতিষ্ঠার জন্য জমি দিয়েছিলেন।

তিনি দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'খামার কর্তৃপক্ষ ঠিকাদারকে দিয়ে আলু উৎপাদন উপযোগী জমি নষ্ট করেছে। আমাদের পূর্বপুরুষেরা এসব অনিয়ম করার জন্য খামারে জমি দান করেননি।'

খামারের পূর্ব গেট সংলগ্ন দোকানদার মো. বেলিম দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'খামারের ভেতর দিয়ে জনগণের চলাচলের জন্য একটি রাস্তা আছে। এ রাস্তা ব্যবহার করে ডোমার উপজেলা পরিষদসহ হাটবাজারে যাতায়াত করা যায়। কিন্তু কিছুদিন ধরে খামার কর্তৃপক্ষ জনগণের চলাচল নিয়ন্ত্রণ করছে, যেন তাদের অনিয়ম চোখে না পড়ে।'

মাটি ভরাটসহ বিভিন্ন কার্যাদেশ পাওয়া সবচেয়ে বড় ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান ঢাকার এস এ ট্রেডার্স।

প্রতিষ্ঠানটির সত্ত্বাধিকারী সেলিম আহমেদ ডেইলি স্টারকে বলেন, 'কর্তৃপক্ষের অনুমতি ছাড়া সেখানে কারও পক্ষে কিছু করা সম্ভব নয়। আমি যতদূর জানি, উদ্ধারকৃত আম বাগানের উঁচু জমি কাটা হয়েছে উপরিভাগকে সমতল করার জন্য, যেন সেটা বীজ আলু উৎপাদন উপযোগী হয়।'

তিনি বলেন, 'নিয়ম অনুযায়ী খামারের নিচু জমি উঁচু করতে বাইরে থেকে মটি আনতে হয়। খামারের জমির মাটি এ কাজে ব্যাবহার করা সম্ভব নয়।'

'ভূমি উন্নয়ন তথা খামারের নিচু জমি ভরাট করে উঁচু করার কাজ যথাযথভাবে শেষ করায় খামার কর্তৃপক্ষ সম্পূর্ণ বিল দিয়েছে,' যোগ করেন তিনি।

স্থানীয় বিএডিসি সূত্রে জানা যায়, খামার কর্তৃপক্ষ নিয়ম বহির্ভূতভাবে খনন করে ডোবায় পরিণত করা ৩ একর জমি পুনরায় উঁচু করতে নতুন প্রকল্প প্রস্তাব তৈরি করে তা ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের কাছে দাখিলের প্রস্তুতি নিচ্ছে।

তবে এ প্রকল্প অর্থের অপচয় ও অনিয়ম আড়ালের অপচেষ্টা বলে উল্লেখ করেন স্থানীয়রা।

এসব অনিয়মের বিষয়ে মন্তব্য জানতে প্রকল্প পরিচালক আবীর হোসেনকে বেশ কয়েকবার ফোন করলেও তিনি ফোন ধরেননি, মেসেজ পাঠালেও উত্তর দেননি।

তবে ডোমার খামারের উপপরিচালক আবু তালেব মিয়ার কাছে জানতে চাইলে তিনি খামারের উঁচু জমির মাটি কাটার বিষয়টি স্বীকার করেন।

তিনি ডেইলি স্টারকে বলেন, 'নিয়ম অনুযায়ী সেই জমিটির উঁচু-নিচু উপরিভাগ সমতল করার জন্যই আমরা সেখানে মাটি কেটেছি। তাছাড়া সেটির বালুযুক্ত কয়েক ফুট নিচ পর্যন্ত অনুর্বর বলে অপসারণ করেছি। শিগগির মানসম্পন্ন মাটি দিয়ে এ জায়গা পূরণ করা হবে।'

কিন্তু জমির উপরিভাগ সমতল করতে সেখানে ৪-৫ ফুট গভীর ডোবা কীভাবে তৈরি হলো? এমন প্রশ্ন করা হলে তিনি কোনো উত্তর দেননি।

এছাড়া ঠিকাদারদের সরকারি জমির মাটি বিনামূল্যে কেন দেওয়া হলো এবং কেন অনিয়ম করার পরেও তাদের পুরো বিল দেওয়া হলো, জানতে চাইলেও কোনো সদুত্তর দিতে পারেননি তিনি।

Comments

The Daily Star  | English

Consensus key to take Bangladesh forward: Yunus

"We are now working to bring our beloved Bangladesh back onto the path of equality, human dignity, and justice," he said

48m ago