একজন মহৎপ্রাণ শিক্ষকের গল্প
প্রায় বছরখানেক আগের ঘটনা। হঠাৎ করেই সন্তানের ভবিষ্যৎ শিক্ষাজীবন নিয়ে উৎকণ্ঠিত হয়ে পড়লেন নীলফামারী জেলার ডোমার উপজেলার শালমারা ও বন্দরপাড়া গ্রামের বাসিন্দারা। কারণ প্রত্যন্ত এ গ্রাম ২টির শিশুদের জন্য একটিমাত্র শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান শালমারা বন্দরপাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় আর চালু রাখা যাচ্ছিল না জমির সংকটের কারণে।
স্কুলটি ছিল নীলফামারী-ডোমার-চিলাহাটি স্থলবন্দর সড়কের গা ঘেঁষে। সড়কের উন্নয়ন ও প্রশস্তকরণের জন্য বিদ্যালয়ের জমি পুরোটাই অধিগ্রহণ করে সরকার।
এ অবস্থায় উপজেলা শিক্ষা কমিটি গত বছরের আগস্টে বিদ্যালয়টির ভবিষ্যৎ সম্পর্কে সিদ্ধান্ত নিতে জরুরি সভা আহ্বান করে।
উপজেলা চেয়ারম্যান, উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও), উপজেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তা, স্কুলটির প্রধান শিক্ষিকা ও অন্যান্য সদস্যদের উপস্থিতিতে সভায় সিদ্ধান্ত হয়- এলাকাবাসীর উদ্যোগে কিনে হোক বা কারও দানে হোক, কাছাকাছি স্থানে যদি একখণ্ড জমির ব্যবস্থা করা যায়, তাহলে বিদ্যালয়টি সেখানে স্থানান্তর করা সম্ভব হবে। তা না হলে প্রতিষ্ঠানটি বিলুপ্ত করা ছাড়া আর কোনো উপায় থাকবে না।
এ ব্যাপারে স্কুলের প্রধান শিক্ষিকা মহামায়া দেব বর্মণ দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'যেহেতু কাছাকাছি কোনো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান নেই, তাই স্কুলটি বিলুপ্ত হলে এর শিক্ষার্থী, শিক্ষক ও কর্মচারীদের একাধিক দূরবর্তী বিদ্যালয়ে সংযুক্ত করা হবে বলে সিদ্ধান্ত হয়েছিল।'
এ অবস্থায় সমস্যার সমাধান খুঁজে পেতে প্রধান শিক্ষিকা বিদ্যালয় পরিচালনা কমিটির সভা আহ্বান করলেন। সভায় অভিভাবক, শুভানুধ্যায়ী ও স্থানীয় সচ্ছল ব্যক্তিদের আমন্ত্রণ জানানো হলো। কিন্তু দীর্ঘ আলোচনায় সবাই উদ্বেগ প্রকাশ করলেও কেউই মূল্যবান জমি দান করতে রাজি হলেন না। একক বা যৌথভাবে তহবিল সংগ্রহ করে জমি কেনার উদ্যোগ নিতেও আগ্রহী হতে দেখা গেল না কাউকে।
এমন পরিস্থিতিতে প্রিয় প্রতিষ্ঠানের এমন অরক্ষিত অবস্থা দেখে বিচলিত হয়ে পড়লেন শালমারা বন্দরপাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠাকালীন প্রধান শিক্ষক জগদীশ চন্দ্র রায় (৬২)। এ ঘটনার ২ বছর আগে তিনি অবসরে গেলেও, প্রতিষ্ঠানটির সঙ্গে তার সম্পর্ক ছিল আবেগের। তাই বিদ্যালয়টিকে বিলুপ্তির হাত থেকে বাঁচাতে অনেক প্রতিবন্ধকতা সত্ত্বেও অদূরে ৫০ লাখ টাকা মূল্যের নিজের একখণ্ড জমি দান করলেন বিদ্যালয়ের জন্য।
প্রায় ৩৩ বছর আগে ১৯৮৯ সালে এলাকার কয়েকজন শিক্ষিত বেকারকে নিয়ে জগদীশ চন্দ্র রায় ডোমার উপজেলার এমন প্রত্যন্ত জায়গায় টিনের চাল ও বাঁশের বেড়া দিয়ে বিদ্যালয়টি প্রতিষ্ঠা করেন। স্কুলের জন্য ছাত্রছাত্রী পাওয়া যেত না তখন। সন্তানদের স্কুলে পাঠানোটা অহেতুক মনে করে অভিভাবকরা তাদের খেতের কাজে পাঠিয়ে দিতেন। দারিদ্র্য কবলিত অঞ্চলের এ বিদ্যালয়টির জন্য শিক্ষার্থী সংগ্রহ করতে তিনি ও তার সহযোগীরা সে সময় বাড়ি বাড়ি গিয়েছেন। সন্তানদের কাজে না পাঠিয়ে বিদ্যালয়ে ভর্তি করতে রাজি করিয়েছেন অভিভাবকদের।
১৯৯৮ সালে বিদ্যালয়টি এমপিওভূক্ত হয়। তার আগ পর্যন্ত দীর্ঘ ৯ বছর জগদীশ চন্দ্র রায় এখানে বিনা বেতনে প্রধান শিক্ষক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। ২০১৩ সালে বিদ্যালয়টি জাতীয়করণ হলেও সরকারি নির্দেশে ৫ বছরের মাথায় ২০১৮ সালে অবসরে যেতে হয় তাকে।
নিজ হাতে গড়ে তোলা বিদ্যালয়টি বাঁচাতে পৈতৃক সূত্রে পাওয়া যে জমি দান করেছেন জগদীশ চন্দ্র রায়, সেটা তার নিজের নামে থাকলেও গোটা প্রক্রিয়াটি খুব সহজ ছিল না। এ কাজটি তাকে করতে হয় পরিবারের সদস্যদের মনে আঘাত না দিয়ে।
জমি দেওয়ার বিষয়ে জগদীশ চন্দ্র রায় পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে আলোচনায় বসলে শুরুতে নিজেদের অনিশ্চিত ভবিষ্যতের কথা ভেবে দ্বিমত করেন তার সন্তানরা। তখন সন্তানদের বোঝানোর দায়িত্ব নেন তার স্ত্রী অমলা রানী রায় (৫৪)। শেষ পর্যন্ত মায়ের কথায় সম্মতি দেন তাদের ২ ছেলে ও ১ মেয়ে।
অমলা রানী ডেইলি স্টারকে বলেন, 'আমরা ধনী নই। শুধু খেয়ে-পরে বেঁচে থাকার মতো যতটুকু থাকার, ততটুকুই ছিল। তাই স্বামীর সিদ্ধান্তের সঙ্গে একমত হওয়া আমাদের পক্ষে পক্ষে কঠিন ছিল। আর স্কুলটির সঙ্গে তার (জগদীশ চন্দ্র রায়) যে আবেগের সম্পর্ক ছিল, তাতে আমাদের সম্মতি না পেলে তিনি হৃদয়ে বড় আঘাত পেতেন। শেষ বয়সে তাকে আমরা দুঃখ দিতে চাইনি।'
পরিবারর সম্মতি পেয়ে জগদীশ চন্দ্র রায় উপজেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তার সঙ্গে সাক্ষাৎ করে তার ইচ্ছার কথা জানান। শিক্ষা কর্মকর্তা তাকে নিয়ে যান উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা, উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান ও অন্য কর্মকর্তাদের কাছে।
অবশেষে গত বছরের ১৫ সেপ্টেম্বর উপজেলার ঊর্ধ্বতন সরকারি কর্মকর্তাদের উপস্থিতিতে ডোমার সাব-রেজিস্ট্রি অফিসে তিনি আনুষ্ঠানিকভাবে বিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের কাছে জমিটি বুঝিয়ে দেন।
এ খবর ছড়িয়ে পড়লে মানুষের প্রশংসা ও ভালোবাসায় সিক্ত হন জগদীশ চন্দ্র রায়। কিন্তু লোকচক্ষুর আড়ালে থেকে যাওয়া এই মহৎপ্রাণ মানুষটি এগুলোকে বাহুল্যই মনে করছেন। ডেইলি স্টারকে তিনি বলেন, 'আমি হাততালি বা সংবর্ধনা পাওয়ার আশা করি না। দানকৃত জমিতে নির্মাণাধীন ভবন সমাপ্ত করে সেখানে পাঠদান শুরু হলে সেটাই হবে আমার পরম প্রাপ্তি। সেটা হলে আমি মরেও শান্তি পাবো।'
জগদীশ চন্দ্র রায়ের এই মহৎকীর্তিকে স্বীকৃতি দিতে তাকে সংবর্ধনা দেওয়ার জন্য 'ডোমার নাগরিক ঐক্য পরিষদ' নামের একটি সংগঠন সম্প্রতি তার সঙ্গে যোগাযোগ করে। এ ব্যাপারে সংগঠনের সদস্যসচিব আহসান হাবীব লাব্বু বলেন, 'জগদীশ চন্দ্র রায় আমাদের বলেছেন, সংবর্ধনার জন্য অর্থ ব্যয় না করে তা বিদ্যালয়ের দরিদ্র শিক্ষার্থীদের পোশাক তৈরির কাজে ব্যয় করলেই তিনি খুশি হবেন।'
জগদীশ চন্দ্র রায়ের এই কীর্তির বিষয়ে কথা হয় শিক্ষাবিদ ও নীলফামারীর জেলা শিক্ষা কমিটির সদস্য শহীদুল ইসলামের সঙ্গে। নীলফামারী সদর উপজেলার চাঁদের হাট ডিগ্রি কলেজের অধ্যক্ষ তিনি। এই কলেজটি প্রতিষ্ঠার পাশাপাশি এলাকায় আরও একটি কৃষি কলেজ ও একটি মাদরাসা প্রতিষ্ঠায় তিনি নিজের জমি দান করেছেন।
অধ্যক্ষ শহীদুল ইসলাম বলেন, 'উচ্চমূল্যের কারণে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠায় ব্যক্তিগত জমি দান করার মতো ঘটনা এখনকার সময়ে বিরল। এছাড়া সরকারের নতুন নিয়ম অনুযায়ী জমিদাতার পক্ষে তার নিকট আত্মীয়দের সেই বিদ্যালয়ের শিক্ষক কিংবা কর্মচারী হিসেবে সরাসরি নিয়োগের সুযোগটিও নেই। এটিও একটি প্রতিবন্ধকতা হিসেবে কাজ করে।'
শহীদুল ইসলাম আরও বলেন, 'এমনও দেখা গেছে যে পূর্বপুরুষ অনেক আগে জমি দান করে গেছেন। কিন্তু তার উত্তরাধিকারীরা আইনের ফাঁক খুঁজে সেই জমির মালিকানা ফিরে পেতে মামলা পর্যন্ত করেছে।'
জগদীশ চন্দ্র রায়ের জমির মালিকানা হস্তান্তরের প্রধান সাক্ষী ছিলেন উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান তোফায়েল আহমেদ। তিনি বলেন, 'প্রধান সাক্ষী হয়ে এই মহান ত্যাগের অংশীদার আমিও হয়েছি। যেন শতবর্ষ পরে ভবিষ্যৎ প্রজন্ম মহৎ এই দাতার নামের পাশে আমার নামটিও দেখতে পায়।'
ডোমার উপজেলার তৎকালীন ইউএনও শাহীনা শবনম বলেন, 'জগদীশ চন্দ্র রায় ধনী নন, কিন্তু তার রয়েছে বিশাল হৃদয়। আশা করব তার আদর্শে অনুপ্রাণিত হয়ে আরও অনেকে এমন মহৎ কাজে এগিয়ে আসবে।'
পাকা স্কুলঘরের নির্মাণকাজ শুরু হয়নি এখনো
সম্প্রতি শালমারা বন্দরপাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়টি জগদীশ চন্দ্র রায়ের দেওয়া জমিতে স্থানান্তর করা হয়েছে। সেখানে টিনের তৈরি ২টি অস্থায়ী ঘরে চলছে শিক্ষার্থীদের পাঠদান।
বিদ্যালয়ে পরিচালনা পর্ষদের সদস্যসচিব ও প্রধান শিক্ষিকা মহামায়া দেব বর্মণ জানান, নতুন স্কুলভবন নির্মাণ সংক্রান্ত উপজেলা প্রাথমিক শিক্ষা বিভাগের একটি প্রস্তাবনা জেলা এলজিইডিতে অপেক্ষমাণ আছে।
এ বিষয়ে জেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তা নবেজউদ্দীন সরকার ডেইলি স্টারকে বলেন, 'নতুন জমিতে বিদ্যালয়টির পাকা ভবনের নির্মাণকাজ শিগগির শুরু হবে।'
এই শিক্ষা কর্মকর্তা বলেন, 'প্রাথমিক বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার জন্য সরকারের জমি কেনার কোনো বিধান নেই; বরং তা স্থানীয়দেরই ব্যবস্থা করতে হয়। এজন্য জগদীশ চন্দ্র রায়ের মতো মহৎপ্রাণ মানুষদের বড় বেশি প্রয়োজন।'
Comments