‘ধরা-ছোঁয়ার বাইরে’ যারা তাদের ধরার সময় এসেছে

অপরাধী ৩ ধরনের— যারা আইন ভাঙে, যারা আইন বিকৃত করে ও যারা আইন পরিবর্তন করে। শেষের দলটির সরকারের ওপর এতটাই প্রভাব রয়েছে যে, তারা নিজেদের উপযোগী করে আইন তৈরিতে সক্ষম। তাদের অপরাধগুলোকে অপরাধ হিসেবে দেখা হয় না, বরং তাদেরকে আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল নাগরিকের ছদ্মবেশ ধারণের সুযোগ দেওয়া হয়। এই সুযোগ ব্যবহার করে তারা আমাদের মাঝে থেকেই ধ্বংস করে চলেছে আমাদের অর্থনীতি। আমাদের ব্যাংকিং খাত চলে গেছে এ ধরনের 'আইন ভঙ্গকারীদের' হাতে।

বাংলাদেশের উন্নয়নের গল্পটি অনুপ্রেরণাদায়ক। কিন্তু আমাদের ওপর চাপিয়ে দেওয়া হয়েছে একটি শক্তিশালী, দুর্নীতিগ্রস্ত, স্বার্থপর ও রাজনীতি ঘনিষ্ঠ গোষ্ঠীর খেলাপি ঋণের চাপ। স্বল্পোন্নত দেশের (এলডিসি) তালিকা থেকে আমাদের উত্তরণের শক্তিশালী অধ্যায়কেও কলঙ্কিত করেছে এই খেলাপি ঋণ।

আমাদের জিডিপির পরিমাণ, মাথাপিছু আয়, রপ্তানি, অবকাঠামোগত উন্নয়ন, কৃষি খাতের উল্লেখযোগ্য অবদান প্রকৃতপক্ষেই আমাদের অনুপ্রাণিত করে তুলেছে। তারপরও একজন সাহসী ও সফল প্রধানমন্ত্রী পরিচালিত একটি শক্তিশালী সরকার কেন কিছু সংখ্যক অত্যন্ত ধনী (কীভাবে তারা ধনী হয়েছেন, সেই প্রশ্ন থেকেই যায়) ঋণখেলাপিকে ক্ষমতার কাছাকাছি থেকে ক্ষমতার অপব্যবহার করার, ব্যাংকিং নীতি শিথিল করার মতো রাজনৈতিক সংশ্লিষ্টতার এবং এসব স্বভাবসিদ্ধ ও বড় খেলাপিদের যেন ঋণের অর্থ ফেরত দিতে না হয়, সে বিষয়ে ক্রমাগত অসত্য তথ্য দিয়ে নীতি-নির্ধারকদের বিভ্রান্ত করার সুযোগ দিচ্ছে?

ঋণখেলাপিদের ২টি দল রয়েছে। একটি দল 'ইচ্ছাকৃত'ভাবেই ঋণখেলাপি। তারা পরিকল্পিতভাবে প্রথম থেকেই এমন কৌশল গ্রহণ করে, যাতে তাদের ঋণ পরিশোধ করতে না হয়। আরেকটি দল হলো, যারা প্রকৃতপক্ষে ব্যবসায়িক কারণে ঋণখেলাপি হয়ে পড়েন। এই দলকে ঋণখেলাপি থেকে বেরিয়ে আসতে সাহায্য করা উচিত। যারা ইচ্ছাকৃতভাবে নিজেদের 'কৌশলের' অংশ হিসেবে ঋণখেলাপি হয়েছেন, তাদের শাস্তি হওয়া উচিত। আর আজকের কলামের বিষয় প্রথম এই দলটিই।

এটা অবিশ্বাস্য যে, অর্থ মন্ত্রণালয়ের অধীনে পরিচালিত বাংলাদেশ ব্যাংক কীভাবে বারবার তাদের নিয়ম পরিবর্তন করেছে এবং আমাদের ব্যবসায়ী সম্প্রদায়ের একটি অংশের সীমাহীন লালসা মেটাতে গিয়ে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক ব্যাংকিং নিয়মের লঙ্ঘন করেছে। এই সুবিধাভোগী গোষ্ঠীর কাছে ব্যাংক নিছকই টাকা সরবরাহের একটি যন্ত্র, যেখানে থেকে আমানতকারীদের বা জাতির স্বার্থের কথা বিবেচনা না করেই ইচ্ছামতো টাকা নেওয়া যায়।

সংখ্যার বিচারে গল্পটি বিস্ময়কর। ১৯৯০ সালে মোট খেলাপি ঋণের পরিমাণ ছিল ৪ হাজার ৬৪৬ কোটি টাকা। বর্তমানে এর পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ১ লাখ ৩৪ হাজার ৩৯৬ কোটি টাকায়। অর্থাৎ ৩২ বছরে খেলাপি বেড়েছে ২৯ গুণ। এই খেলাপি ঋণের সমপরিমাণ টাকায় আরও অন্তত ৫টি পদ্মা সেতু নির্মাণ করা সম্ভব। এই খেলাপি ঋণের পরিমাণ আমাদের মোট বকেয়া ঋণের ৯ দশমিক ৩৬ শতাংশ। অর্থাৎ আমাদের ব্যাংকগুলোর যে ঋণ প্রদানের সক্ষমতা, তার প্রায় ১০ শতাংশ এই গোষ্ঠীর হাতে জিম্মি। শ্রেণিভেদে ঋণের ১০০, ৫০ ও ২০ শতাংশ অর্থ 'প্রভিশনিং' (যে পরিমাণ অর্থ ব্যাংক অন্য কাউকে ঋণ দিতে পারবে না) হিসেবে সরিয়ে রাখতে হয় ব্যাংকগুলোকে। এটা স্বাভাবিক ব্যবসা পরিচালনায় ব্যাংকের সুযোগ আরও সীমিত করেছে।

ইচ্ছাকৃত খেলাপিদের গল্পে বারবার দেখা যায়, বড় ব্যবসার পক্ষে এবং ক্ষুদ্র ও মাঝারি ব্যবসার ক্ষতি করতে কীভাবে আর্থিক নিয়মগুলো বারবার সংশোধন করা হয়েছে। সেখানে দেখা গেছে, কীভাবে সৎ ব্যবসাকে নিরুৎসাহিত করা হয়েছে, দক্ষ উদ্যোক্তাদের প্রাপ্য সহায়তা পর্যন্ত দেওয়া হয়নি এবং কীভাবে 'ব্যাংকের ঋণ পরিশোধ না করা' একটি শ্রেণির অভ্যাসে পরিণত হয়েছে। অবিশ্বাস্য মনে হলেও এটি ক্ষমতার এক ধরনের বিকৃত প্রতীকে পরিণত হয়েছে। সবচেয়ে বড় কথা, এর মাধ্যমে বহু পুরনো ব্যাংকিং নীতি লঙ্ঘনের সংস্কৃতি তৈরি করেছে, যা সার্বিকভাবে আমাদের ব্যাংকিং ব্যবস্থাকে দুর্বল করে দিয়েছে। ঋণখেলাপিদের দায়মুক্তি দিয়ে ওইসব ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানের সঙ্গে উপহাস করা হয়েছে, যারা সততার সঙ্গে ব্যাংক ঋণ পরিশোধ করেছে এবং করছে।

বড় ঋণগ্রহীতারা যখন বারবার ঋণ পরিশোধের তারিখ পুনর্নির্ধারণের সুযোগ পায়, তখন তাদের সঙ্গে রাজনৈতিক সংযোগের বিষয়টি স্পষ্ট হয়। একইসঙ্গে এই বার্তাও পাওয়া যায় যে, ব্যবসায়িক দক্ষতার চেয়ে সঠিক সময়ে সঠিক ব্যক্তির সঙ্গে সঠিক সম্পর্ক রাখা খুবই গুরুত্বপূর্ণ।

স্পষ্টভাবে বলতে গেলে, বাংলাদেশে খেলাপি ঋণের ইতিহাস নতুন নয়। তবে দুঃখের বিষয় হলো, একটি সরকার দেশের অর্থনীতির ব্যাপক ক্ষতি করেও এই গোষ্ঠীকে অনৈতিক সহায়তা দিচ্ছে এবং বারবার তাদের ছাড় দিয়ে চলেছে। আর্থিক খাতে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনার কথা বলে সরকার কেন্দ্রীয় ব্যাংকের মাধ্যমে যেসব ব্যবস্থা গ্রহণ করেছে, তা এই গোষ্ঠীকে সাহায্য করার জন্যই। এর পরিণতিতে আমাদের অর্থনীতির এই অবস্থা।

খেলাপি ঋণ অর্থপাচারের সুযোগ তৈরিতেও সাহায্য করে, যা আমাদের অর্থনীতির জন্য একটি ভয়ংকর পরিণতি ডেকে এনেছে। ওয়াশিংটনভিত্তিক গ্লোবাল ফিন্যান্সিয়াল ইন্টিগ্রিটির (জিএফআই) গত ডিসেম্বরের প্রতিবেদন অনুযায়ী, 'কর ফাঁকি ও বিদেশে অবৈধভাবে টাকা পাচারের উদ্দেশ্যে ব্যবসায়ীদের আমদানি-রপ্তানি পণ্যের মিস-ইনভয়েসিংয়ের কারণে বাংলাদেশ ২০০৯ থেকে ২০১৮ সালের মধ্যে প্রতি বছর গড়ে ৮ দশমিক ২৭ বিলিয়ন মার্কিন ডলার হারিয়েছে।' এই তথ্য অনুযায়ী, আমরা ৯ বছরে প্রায় ৭৪ বিলিয়ন মার্কিন ডলার হারিয়েছি।

জিএফআই স্পষ্টতই আমাদের আমদানি-রপ্তানি বাণিজ্যের দিকে আঙুল তুলেছে। এই সমস্যার সমাধান করা কি খুব কঠিন? অন্যান্য দেশ কি আমদানি-রপ্তানি করে না? পাচারের কারণে তারাও কি আমাদের মতোই কোটি কোটি টাকা হারায়? নাকি একটি নির্দিষ্ট শ্রেণির উপকার হচ্ছে বলে কেবল আমরাই বিষয়টি উপেক্ষা করছি? ('ট্রান্সফার প্রাইসিং সেল' স্থাপনের বিষয়ে এনবিআরের পরিকল্পনার কী হলো? এ ধরনের সেল বিশ্ব বাজারের সর্বশেষ দাম ট্র্যাক করতে পারে এবং এর ফলে পণ্যের অতিরিক্ত দাম বা কম দাম দেখিয়ে চালান তৈরি বন্ধ করতে পারে। এর জন্য একটি দামি সফটওয়্যার প্রয়োজন। যেখানে আমরা প্রতি বছর ৮ দশমিক ২৭ বিলিয়ন মার্কিন ডলার হারাচ্ছি, সেই তুলনায় ব্যয়বহুল হলেও সফটওয়্যারটি কেনাই কি যৌক্তিক নয়?)

এর সঙ্গে যদি আমরা অন্যান্য পথে পাচার হওয়া অর্থ, হুন্ডিসহ অন্যান্য মাধ্যমে ক্ষতি হওয়া রেমিট্যান্স যোগ করি, তাহলে আমাদের অর্থনীতিতে ক্ষতির পরিমাণ আরও কয়েক বিলিয়ন ডলার। আজ আমরা সাড়ে ৪ বিলিয়ন ডলার ঋণের জন্য আইএমএফ এবং ১ বিলিয়ন ডলার ঋণের জন্য বিশ্বব্যাংকের দরজায় ধরনা দিচ্ছি। তারপরও আমরা উপরে উল্লেখিত বিশাল ক্ষতি রোধে কিছুই করিনি। আমরা যদি এই পরিমাণ ক্ষতির একটি অংশও প্রতিরোধ করতে পারতাম, তাহলে দেশের অর্থনীতি কতটা শক্তিশালী হতে পারতো, সেটা হিসাব করে দেখছি না।

হলমার্ক, বেসিক ব্যাংক (রাজনৈতিক কারণে কীভাবে একটি ভালো ব্যাংক খারাপ হয়ে যায়, তার দুঃখজনক উদাহরণ), পদ্মা ব্যাংক (সাবেক ফারমার্স ব্যাংক), ক্রিসেন্ট গ্রুপ ও বিসমিল্লাহ গ্রুপের মতো বড় কেলেঙ্কারির ঘটনায় কাউকে শাস্তির আওতায় আনা হয়নি। তারা সবাই বিদেশে নিরাপদে অর্থ পাচার করেছে বলে সন্দেহ করা হচ্ছে। অর্থ পাচারকারী, বাড়তি বা কম দাম দেখিয়ে 'চালান তৈরিকারী', ঋণখেলাপি ও তাদের শক্তিশালী জোটের অন্যান্য সদস্যরা সময়ের সঙ্গে সঙ্গে 'ধরা ছোঁয়ার বাইরে' চলে গেছে। তারা প্রবেশ করেছে আমাদের রাজনীতি ও শাসন ব্যবস্থার সর্বস্তরে, বিশেষ করে আমাদের সংসদ, রাজনৈতিক দল, আমলাতন্ত্র, আইন প্রয়োগকারী সংস্থা, সরকার ও মিডিয়ার কথা উল্লেখ না করলেই নয়। এই জোট আমাদের নাড়িভুঁড়ি খুবলে খাচ্ছে। বাংলাদেশ যা কিছু অর্জন করেছে, এই গোষ্ঠী তা ভেতর থেকে খেয়ে ফেলছে।

শান্ত সমুদ্রে নয়, উত্তাল সমুদ্রে ঝড় মোকাবিলা করে জাহাজ কীভাবে চলছে, সেই হিসাবে একটি দেশের অর্থনীতির অবস্থা পরিমাপ করা হয়। আমাদের অর্থনীতিকে ভেতর থেকে দুর্বল করে দিয়ে 'ধরা ছোঁয়ার বাইরে' চলে যাওয়া এই গোষ্ঠিী আন্তর্জাতিক ঝড়ের মোকাবিলা আরও কঠিন করে তুলছে। এবার সময় এসেছে, 'ধরা ছোঁয়ার বাইরে' চলে যাওয়া এই গোষ্ঠীকে ধরার।

মাহফুজ আনাম: সম্পাদক ও প্রকাশক, দ্য ডেইলি স্টার

অনুবাদ করেছেন মুনীর মমতাজ

Comments

The Daily Star  | English

People will have to take to the streets for voting rights: Fakhrul

People will have to take to the streets like they did on August 5 to realise their voting rights, said BNP Secretary General Mirza Fakhrul Islam Alamgir today

1h ago