বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রলীগের রাজনীতি নিয়ে উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা

জঙ্গি কার্যক্রম মোকাবিলা, জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের আদর্শ ও প্রগতিশীলতার চর্চা করতে সম্প্রতি ৩৯টি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে কমিটি গঠন করা হয়েছে বলে জানিয়েছে ছাত্রলীগ।

বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রলীগের কমিটি ঘোষণার পর থেকে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর কর্তৃপক্ষ, শিক্ষক, শিক্ষার্থী ও তাদের অভিভাবকদের মধ্যে উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা পরিলক্ষিত হয়েছে। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রলীগের রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড পরিচালনায় ক্ষমতাসীন সরকার ও আওয়ামী লীগের যে সমর্থন আছে, তা বোঝা যায় শিক্ষামন্ত্রী ডা. দীপু মনির বক্তব্য থেকে।

গতকাল সোমবার শিক্ষামন্ত্রী দীপু মনি সচিবালয়ে সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের উত্তরে বলেছেন, 'বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে ছাত্র রাজনীতি করতে দেওয়া হবে কি হবে না, সে সিদ্ধান্ত শিক্ষা প্রতিষ্ঠান নেবে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ছাত্র রাজনীতি নিষিদ্ধ করার ফলাফল সাধারণত ভালো হয় না। এটা বিবেচনা করা উচিত। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ছাত্র রাজনীতির বিষয়ে মানুষের ভিন্ন মত আছে। কিন্তু আমরা যদি গণতান্ত্রিক সমাজ আশা করি, তাহলে রাজনৈতিক চেতনার বিকল্প নেই।'

পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে চলছে মূলত ছাত্রলীগের একক আধিপত্য। দখল, সন্ত্রাস, ছাত্রী নিপীড়ন, চাঁদাবাজি, ঠিকাদারি, গেস্টরুম বহুবিধ অভিযোগ ছাত্রলীগের বিরুদ্ধে। সামনে কি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতেও এমন চিত্র দেখা যাবে?


 
পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রদলকে ঢুকতে দেওয়া হয় না। ছাত্রদল ক্যাম্পাসে ঢুকলে 'সন্ত্রাসী' আখ্যা দিয়ে হামলা করে ছাত্রলীগ। এখন যদি নর্থ সাউথ বা ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রলীগের রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড চলে, ছাত্রদলও যদি কমিটি দেয় বা রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড চালাতে চায়, তখন কী ঘটবে? নির্বিঘ্নে কর্মকাণ্ড চালাতে পারবে, না হামলা করা হবে? সংঘর্ঘ ছড়িয়ে পড়বে ২ দলের মধ্যে যেভাবে ছড়িয়ে পড়ে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে? বিষয়গুলো নিয়ে কথা বলার জন্যে গত ৩ দিনে টেলিফোনে ও সরাসরি চেষ্টা করেও ছাত্রলীগের সভাপতি আল নাহিয়ান খান জয় ও সাধারণ সম্পাদক লেখক ভট্টাচার্যের সঙ্গে যোগাযোগ করা সম্ভব হয়নি।

বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ছাত্র রাজনীতির চর্চা, কমিটি গঠনের প্রয়োজনীয়তা, উদ্দেশ্য ও পরিণতির বিষয়ে জানতে—দ্য ডেইলি স্টার কথা বলেছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থ বিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক কামরুল হাসান মামুন, ইউনিভার্সিটি অব লিবারেল আর্টস বাংলাদেশের (ইউল্যাব) উপাচার্য অধ্যাপক ইমরান রহমান, আহছানউল্লা বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক মুহাম্মদ ফাজলী ইলাহী ও বাংলাদেশ ছাত্রলীগের সম্মিলিত বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় শাখার সাধারণ সম্পাদক মো. আজিজুল হাকিম সম্রাটের সঙ্গে।

এ বিষয়ে অধ্যাপক কামরুল হাসান মামুন বলেন, 'আমাদের কয়েকটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় মাত্রই ভালো করা শুরু করেছে। র‌্যাঙ্কিংয়ে আসতে শুরু করেছে। ব্র্যাক ও নর্থ সাউথ বেশ ভালো করছে। ৫-৬ বছর আগেও যাদের অস্তিত্ব ছিল না, সেই জায়গা থেকে বর্তমানে একটা জায়গায় এসে পৌঁছেছে। অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়গুলোও মোটামুটি এগিয়ে যাচ্ছে। তারা স্থায়ী ক্যাম্পাস করছে, বিশ্ববিদ্যালয়ের রূপ ধারণ করছে মাত্র। এই সময়টাতে এ ধরনের কাজ করা মানেই তারা পিছিয়ে পড়ার দিকে যাবে। তার কারণ, ছাত্র রাজনীতিকে আমরা বাংলাদেশে যেভাবে দেখি, সেই ধরনের ছাত্র রাজনীতি পৃথিবীর কোথাও নেই। আমাদের দেশের ছাত্র রাজনীতি আসলে ছাত্র রাজনীতি নয়।'
 
ছাত্র রাজনীতি কাকে বলে আগে বুঝতে হবে উল্লেখ করে তিনি বলেন, 'ছাত্র রাজনীতি হলো ছাত্রদের জন্য, ছাত্রদের দ্বারা অর্থাৎ ছাত্রদের কল্যাণে যারা কাজ করে। এটা অনেকটা সামাজিক-সাংস্কৃতিক সংগঠনের মতো। আমাদের দেশে যেটা হয় সেটা ছাত্র রাজনীতি নয়, এটা জাতীয় রাজনীতি। জাতীয় রাজনৈতিক নেতাদের প্রহরী। তাদের তোষামোদি। তাদের কাজ হলো কোনো একটি দল ক্ষতায় আসলে তাদের কীভাবে ক্ষমতায় রাখা যায়, অথবা অন্য কাউকে কীভাবে ক্ষমতায় নেওয়া যায়; সে রকম দলের একটি প্রহরী।' 

'পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলো তো সরকারি ব্যাংক, অফিসের মতো হয়ে গেছে। যেহেতু সরকার বেতন দেয়। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা সরকারের তল্পিতল্পাবাহক হয়ে গেছে। এখন এই কাজটা যদি আমরা প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ে নিয়ে যাই, তাহলে যে প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়গুলো মাত্র দাঁড়াতে চেষ্টা করছে, তাকে আবার খোঁড়া বানিয়ে দেওয়া হবে। সে আর জীবনেও দাঁড়াতে পারবে না।'

বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রলীগের কমিটি ঘোষণার উদ্দেশ্যের বিষয়ে কামরুল হাসান মামুন বলেন, 'তার কারণ সামনে নির্বাচন। বেশি প্রহরী দরকার। বিনা পারিশ্রমিকে মাগনা প্রহরী আর কীভাবে পাওয়া যায়, একমাত্র ছাত্র রাজনীতি ছাড়া। এই যে আমাদের বড় দলগুলো যেভাবে ছাত্রদের ব্যবহার করে, সেটা অমানবিক, অস্বাস্থ্যকর ও দেশের জন্য ক্ষতিকর। তারা দেশের শত্রু, তারা নিজেদের সন্তানকে বিদেশে পাঠিয়ে গ্রামের কৃষক-শ্রমিক ও সাধারণ মানুষের সন্তানদের নিয়ে এভাবে রাজনীতি রাজনীতি খেলার মাধ্যমে আমাদের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের মান (এমনিতে নেই) যতটুকু আছে, সেটুকু নষ্ট করছে।'

এ বিষয়ে ইউল্যাবের উপাচার্য অধ্যাপক ইমরান রহমান বলেন, 'এটা আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের কোনো উদ্যোগ না। এটা মেনে নেব, কি নেব না সেটা আমাদের সিদ্ধান্ত। এটা শিক্ষার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট কিছু না। এ ক্ষেত্রে বাইরের কোনো সংগঠনের রাইট নেই হুট করে কিছু বলবে আর সেটা মেনে নিতে হবে। এটা আমাদের অনুমোদন ছাড়া হবে না।'

এই মুহূর্তে এ ধরনের কমিটির কোনো উপযোগিতা দেখছি না উল্লেখ করে তিনি বলেন, 'আমি ১৬ বছর ধরে ইউল্যাবে আছি। এখানে জঙ্গিবাদের মতো কোনো ঘটনা ঘটেনি। নর্থ সাউথে একবার হয়েছে, সেটা নিয়ে এখনো তারা কথা বলে। এ ধরনের পরিস্থিতি যাতে তৈরি না হয় সে জন্য আমাদের নিজেদের সিস্টেম আছে, পিলিসি আছে। এর জন্য বাইরের কোনো সংগঠনের প্রয়োজন নেই। সেটা আমাদের নিজেদের করতে হবে, নিজেরাই করছি।'  

'আমরা শিক্ষার্থীদের কোনোভাবেই রাজনৈতিক চর্চার বাইরে রাখছি না। রাজনীতি করার জন্য দরকার ভালো শিক্ষা, বিশ্লেষণী ক্ষমতা। এ ক্ষেত্রে রাজনৈতিক সংগঠনের চেয়ে একজন শিক্ষক ভালোভাবে মূল বিষয়গুলো শেখাতে পারেন। তা ছাড়া আমাদের ছাত্ররা বাইরে গিয়ে তাদের পছন্দের সংগঠনে যুক্ত হতে পারে। সেটা তাদের ব্যক্তিগত বিষয়। এ ব্যাপারে আমার কিছু বলার নেই।'

৯৯.৯৯ শতাংশ শিক্ষার্থী, তাদের বাবা-মা ও বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা ছাত্ররাজনীতি চান না বলে উল্লেখ করে ইউল্যাব উপাচার্য বলেন, 'অনেক শিক্ষার্থী আমাকে ই-মেইল করেছে। স্যার, আমি ভয় পাচ্ছি। তারা এসব কথা বলেছে।'

বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে ছাত্র রাজনীতি না চাওয়ার কারণ জানতে চাইলে তিনি বলেন, 'গত ১০-১২ বছর ধরে কেউ ছাত্র রাজনীতির কোনো ইতিবাচক কিছু দেখেছে? ছাত্রলীগ, ছাত্রদল, ছাত্র শিবির- এদের সম্পর্কে আমি যতদূর জানি কোনো প্রগ্রেসিভ কিছু দেখি না। তাদের ক্যাম্পাসে এনে কী সুবিধাটা হবে, সাধারণ শিক্ষার্থীরা তাদের কাছ থেকে কী শিখবে, তার কিছুই আমি দেখছি না। উল্টো তাদের ক্যাম্পাসে আনা মানে আমাদের যে সুষ্ঠু পরিবেশ আছে, সেটা শেষ হবে।'
 
আহছানউল্লা বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য মুহাম্মদ ফাজলী ইলাহী বলেন, 'এ বিষয়ে ইতোমধ্যে বিভিন্ন জায়গা থেকে প্রতিক্রিয়া এসেছে। অনেকে অভিভাবক এ বিষয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন। তারা বলেছেন, দেশে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার পরিবেশ ক্ষতিগ্রস্ত হবে, সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর মতো বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতেও সংঘর্ষ-মারামারি হবে। তা ছাড়া আমি মনে করি না এর প্রভাব বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর জন্য খুব একটা ভালো হবে। সে জন্য এ বিষয়ে আরেকটু চিন্তা-ভাবনা করা উচিত।'

বিভিন্ন বিষয়ে চর্চার জন্য কোনো রাজনৈতিক সংগঠনের প্রয়োজন নেই উল্লেখ করে তিনি বলেন, 'অনেক ধরনের ক্লাব আছে, অনেক সোসাইটি আছে। তারা নানা ধরনের এক্সট্রা কারিকুলার অ্যাক্টিভিটিস করছে। সেটা ভালোই চলছে। তা ছাড়া আমরা পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলো থেকে ছাত্র রাজনীতির বিষয়ে যা দেখছি, তাতে আমরা কিছুটা ভীত। এতে শিক্ষার পরিবেশের ওপর প্রভাব পড়তে পারে।' 

বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ছাত্রলীগের কমিটি ঘোষণার উদ্দেশ্য সম্পর্কে তিনি বলেন, 'তারা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসগুলোতে প্রভাব বিস্তার করতে চায়। তারা জঙ্গিবাদের কথা বলছে। এই অভিযোগটা খুব সরলিকরণ। তাছাড়া এটা দেখার জন্য তো আমাদের আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী আছে। এটা প্রতিরোধে আরেকটা গ্রুপ তৈরি করার দরকার আছে বলে মনে করি না। আমি শুধু আমার বিশ্ববিদ্যালয়ের কথা বলতে পারি। এখানকার অবস্থা ভালো। একাডেমিক কার্যক্রমগুলোও ভালোভাবে চলছে। আপতত কোনো উদ্বেগের কারণ নেই। তবে, উদ্বেগ না থাকার কারণে যদি নতুন করে উদ্বেগ তৈরি করা হয়, সেটা ভালো হবে না।'

এ বিষয় সম্মিলিত বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগের সদ্য বিদায়ী সাধারণ সম্পাদক মো. আজিজুল হাকিম সম্রাট কমিটি ঘোষণার প্রয়োজনিয়তা সম্পর্কে দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'দেশের বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে প্রায় ২০ লাখ শিক্ষার্থী রয়েছেন। এই বিপুল সংখ্যক শিক্ষার্থীকে মূলধারার রাজনীতির বাইরে রেখে আগামীর বাংলাদেশ গঠন করা সম্ভব না। আপনারা হোলি আর্টিজান দেখেছেন, বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রতিক্রিশীল গোষ্ঠীর যে আস্ফালণ সেটা আপনারা দেখেছেন। সে জায়গা থেকেই আমাদের এই উদ্যোগ।'

ছাত্রদলও যদি কমিটি দেয় তবে কি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়েও তাদের ওপর আক্রমণ করা হবে? উত্তরে সম্রাট বলেন, 'পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর ক্ষেত্রে আমরা যে বিষয়গুলো দেখি, সেখানে নানা ধরনের চাওয়া-পাওয়ার যে দ্বন্দ্বটা থাকে, তার কারণে তাদের অনেক কিছুর সম্মুখীন হতে হয়। এখানে হল নেই, ফলে হল বাণিজ্য, সিট বাণিজ্য বা অন্য কোনো ধরনের ব্যক্তিগত সুবিধা নেওয়ার জায়গা খুব সীমিত। এখানে সবাই আদর্শিক চর্চাটাকে সামনে রাখার চেষ্টা করে।'
 

Comments

The Daily Star  | English

Economic expectations: Did govt fall short?

When an interim government was sworn into office following the ouster of the Awami League regime just 100 days ago, there was an air of expectation that the Prof Muhammad Yunus-led administration would take steps to salvage a scam-ridden financial sector and rescue an ailing economy.

8h ago