তিস্তাপাড়ের কান্না

তিস্তা
লালমনিরহাট সদর উপজেলার খুনিয়াগাছ ইউনিয়নের কালমাটি গ্রামের কৃষক আব্দুল হাকিম। ছবি: এস দিলীপ রায়/স্টার

হতাশায় দিন কাটছে তিস্তাপাড়ের কৃষক আব্দুল হাকিমের (৬৮)। নদীভাঙনে গত কয়েক বছরে তার ১৬ বিঘা আবাদি জমি চলে গেছে তিস্তার উদরে। তাকে ১৪ বার বসতভিটা পরিবর্তন করতে হয়েছে। সবশেষ ৮ শতাংশ জমির বসতভিটায় প্রায় ১০ বছর ধরে বসবাস করছেন।

তিস্তার বুকে ১৬ বিঘা আবাদি জমির মধ্যে ৪-৫ বিঘায় চাষাবাদ করতে পারেন বছরে একবার। শুষ্ক মৌসুমে তিস্তায় পর্যাপ্ত পানি না থাকায় সেচের অভাবে আশানুরূপ ফসল পান না।

লালমনিরহাট সদর উপজেলার খুনিয়াগাছ ইউনিয়নের কালমাটি গ্রামের কৃষক আব্দুল হাকিমের দুঃখের শেষ নেই। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ভারত সফরে তিস্তা চুক্তি হবে এমন আশায় বুক বেঁধে আছেন তিস্তাপাড়ের মানুষ।

আব্দুল হাকিম দ্য ডেইলি স্টারকে বলে, 'আমরা তিস্তায় অসময়ে পানি পাই। কিন্তু, প্রয়োজনে পানি পাই না।'

তিস্তা
শুষ্ক মৌসুমে তিস্তা। ছবি: স্টার ফাইল ফটো

তিনি জানান, শুধু বর্ষা মৌসুমে ৩-৪ মাস তিস্তায় পানি থাকে। শুষ্ক মৌসুমে বিশেষ করে জানুয়ারি থেকে এপ্রিল মাসে তিস্তায় পানি না থাকায় সেচের জন্য নদীর বুকে ডিজেলচালিত শ্যালো মেশিন বসাতে হয়।'

'বছরজুড়ে তিস্তায় পানি থাকলে আমরা চরের জমিতে আশানুরূপ ফসল ফলাতে পারতাম। সেচের জন্য বাড়তি খরচ করতে হতো না,' যোগ করেন তিনি।

একই গ্রামের কৃষক হাবিবুর রহমান (৭০) ডেইলি স্টারকে বলেন, 'বর্ষায় এতো পানি আসে যে তিস্তাপাড়ে বন্যা হয়। ফসল ডুবে যায়। ঘর-বাড়ি ভাসিয়ে নিয়ে যায়। পানি নামার সঙ্গে সঙ্গে ভাঙন দেখা দেয়।'

'তিস্তাপাড়ে খুবই দুঃখ-কষ্ট নিয়ে বাস করছি।'

হাবিবুর রহমানের ১৪ বিঘা জমি এখন তিস্তার বুকে। তিনি জানান, বছরে একবার ৩-৪ বিঘা জমিতে চাষ করা যায়। শুষ্ক মৌসুমে তিস্তায় পানি না থাকায় সেচের জন্য তাকে বাড়তি খরচ করতে হয়।

লালমনিরহাট সদর উপজেলার তিস্তা গ্রামের মৎস্যজীবী শুকারু দাস (৭৬) ডেইলি স্টারকে বলেন, 'শুষ্ক মৌসুমে প্রায় ৮-৯ মাস তিস্তায় পানির প্রবাহ থাকে না। সে সময় নদীতে মাছও পাওয়া যায় না। বছরে শুধু ৩-৪ মাস তিস্তায় মাছ ধরতে পারি।'

তিস্তা নদীকে ঘিরে প্রায় ২০ হাজার মৎস্যজীবী পরিবার রয়েছে উল্লেখ করে তিনি আরও বলেন, 'বছরের অধিকাংশ সময় তিস্তায় প্রবাহ না থাকায় অধিকাংশ মৎস্যজীবী পৈতৃক পেশা ছেড়ে দিতে বাধ্য হয়েছেন। এখন দিনমজুরিসহ অন্যান্য কাজ করছেন।'

তার মতে, 'তিস্তায় সারা বছর প্রবাহ না থাকায় মাছের প্রজননও ঘটছে না। এখন বর্ষাকালেও আশানুরূপ মাছ ধরতে পারছি না। ঋণ নিয়ে সংসার চালাতে হয়। তিস্তায় সারা বছর পানি থাকলে মৎস্যজীবীদের পৈতৃক পেশা টিকে থাকতো।'

আদিতমারী উপজেলার গোবর্ধান এলাকার মাঝি কাদের মন্ডল (৫৫) ডেইলি স্টারকে বলেন, 'বছরে ৪-৫ মাস লোকজন খেয়াখাটের নৌকায় পারাপার হন। বাকি সময় তারা পায়ে হেঁটে চলাচল করেন। কারণ তিস্তায় প্রবাহ থাকে না। শুষ্ক মৌসুমে কোথাও এক ফুট পানি আবার কোথাও ২ ফুট পানি থাকে। অনেক মাঝি পেশা ছেড়ে দিয়েছেন। আমরা কয়েকজন মাত্র আছি। কোনরকমে জীবিকা নির্বাহ করছি।'

'তিস্তায় সারা বছর প্রবাহ থাকলে আমাদের পেশা টিকে থাকতো।'

লালমনিরহাটের হাতীবান্ধা উপজেলার পারুলিয়া গ্রামের ব্যবসায়ী নাদির হোসেন (৬৬) ডেইলি স্টারকে বলেন, '৪০-৪৫ বছর আগে তিস্তায় নৌকা দিয়ে মালামাল পরিবহন করা হতো। খুব কম খরচে নদীপথে দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে মালামাল আনা-নেওয়া করা হতো। শুষ্ক মৌসুমে তিস্তায় পর্যাপ্ত পানি না থাকায় নৌকা চলাচল করতে পারে না। সে কারণে নৌকা দিয়ে মালামাল পরিবহন বন্ধ হয়ে যায়।'

'নৌকা দিয়ে মালামাল পরিবহনের সঙ্গে অসংখ্য মানুষ জড়িত ছিলেন। সেই দিনগুলো এখন শুধুই স্মৃতি।'

কুড়িগ্রামের রাজারহাট উপজেলার গতিয়াশ্যাম গ্রামে তিস্তাপাড়ের কৃষক মেহের আলী (৬৫) ডেইলি স্টারকে বলেন, 'বর্ষাকালে মোকাবিলা করতে হয় বন্যা আর ভাঙন। শুষ্ক মৌসুমে পানির অভাবে চরম কষ্ট পোহাতে হয়। নদীর বুকে মাইলের পর মাইল চরে জেগে উঠে। পায়ে হেঁটে চলতে হয়। আমাদের পানি দরকার শুষ্ক মৌসুমে। কিন্তু, পানি পাই বর্ষাকালে, যা আমাদের শুধু ক্ষতিই করে।'

কৃষি বিভাগ সূত্র জানায়, তিস্তার বুকে প্রায় ৮৫-৯০ হাজার হেক্টর আবাদি জমি রয়েছে। শুষ্ক মৌসুমে এসব জমিতে বাদাম, পেঁয়াজ, রসুন, গম, ধান, পাট, মরিচ, ভুট্টা, শাক-সবজি, আলুসহ নানা রকম ফসল উৎপাদন করা হয়।

শুষ্ক মৌসুমে তিস্তায় প্রবাহ না থাকায় সেচের পানির অভাবে ৬০-৬৫ শতাংশ জমিতে ফসল উৎপাদন সম্ভব হয় না।

'তিস্তা বাঁচাও, নদী বাঁচাও সংগ্রাম পরিষদ'র কেন্দ্রীয় কমিটির সাধারণ সম্পাদক শফিয়ার রহমান ডেইলি স্টারকে বলেন, 'তিস্তার ভাঙন, বন্যা ও খরায় এ নদীপাড়ের মানুষের জীবনে চরম দুর্যোগ ও দুর্দশা নেমে এসেছে। উজান থেকে পানি আসলে বন্যা দেখা দেয়। শুষ্ক মৌসুমে তিস্তা শুকিয়ে মরা নদীতে পরিণত হয়।'

'তিস্তা কোথাও এক কিলোমিটার, কোথাও ৩ কিলোমিটার আবার কোথাও কোথাও ৮-১০ কিলোমিটার প্রশস্ত' উল্লেখ করে তিনি আরও বলেন, 'প্রতিবছর বন্যা, খরা ও ভাঙনে কয়েক হাজার কোটি টাকা ক্ষতি হচ্ছে। সহস্রাধিক পরিবার ভূমিহীন হচ্ছে।'

তিস্তাকে 'রংপুর অঞ্চলের দুঃখ ও দরিদ্রতার অন্যতম কারণ' হিসেবে মনে করেন তিনি। বলেন, 'সরকার তিস্তাপাড়ের মানুষের দুঃখ ঘুচাতে তিস্তা মহাপরিকল্পনা প্রকল্পের ঘোষণা দিয়েও কোন কার্যকর উদ্যোগ নিচ্ছে না।'

তিনি জানান, লালমনিরহাট, কুড়িগ্রাম, নীলফামারী, গাইবান্ধা ও রংপুর জেলার ১৩ উপজেলায় তিস্তার তীরে ৩৩ ইউনিয়নের কয়েক লাখ মানুষ এ নদীর কারণে দরিদ্র হয়েছেন। মৎস্যজীবী ও মাঝিরা তাদের পেশা ছেড়ে দিচ্ছেন। কৃষক হয়ে যাচ্ছেন দিনমজুর।

'তিস্তায় সারা বছর পানি থাকুক—এটা আমাদের দাবি।'

ডালিয়া পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী আসফা উদ দৌলা ডেইলি স্টারকে বলেন, 'মধ্য জুন থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত তিস্তায় পানি পাওয়া যায়। সে সময় নদীতে ৬০-৬৫ হাজার কিউসেক পানি প্রবাহ থাকে। অক্টোবর থেকে পানি কমতে শুরু করে। ডিসেম্বরে তিস্তা শুকিয়ে যায়।

'জানুয়ারি থেকে মে পর্যন্ত তিস্তায় ১২০০-১৫০০ কিউসেক পানি থাকে। সে সময় সেচের জন্য তিস্তায় কমপক্ষে ৫ হাজার কিউসেক পানি থাকা দরকার।'

'গত ৫ বছর ধরে তিস্তায় শুষ্ক মৌসুমে ১২০০-১৫০০ কিউসেক পানি পাচ্ছি,' যোগ করেন তিনি।

Comments

The Daily Star  | English

Enforced disappearances: Eight secret detention centres discovered

The commission raised concerns about "attempts to destroy evidence" linked to these secret cells

1h ago