রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের দর্শন প্রতিফলনে রবীন্দ্র বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূমিকা
আজ ২২শে শ্রাবণ। বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ৮১তম প্রয়াণ দিবস। রবীন্দ্রনাথ বাংলা সাহিত্য-সংস্কৃতিকে তুলে ধরেছিলেন বিশ্ব দরবারে, পেয়েছিলেন বিশ্বকবির সম্মান। তিনি বাঙালির সর্বশ্রেষ্ঠ কবি।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বাংলা ১২৬৮ সালের ২৫ বৈশাখ পশ্চিমবঙ্গের কলকাতার জোড়াসাঁকোর ঠাকুর পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন এবং ১৩৪৮ সালের ২২ শ্রাবণ কলকাতায় পৈতৃক বাসভবনে ইহলোক ত্যাগ করেন।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের স্মৃতিবিজড়িত সিরাজগঞ্জের শাহজাদপুরে প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে রবীন্দ্র বিশ্ববিদ্যালয়। ২০১৭-১৮ শিক্ষাবর্ষ থেকে সেখানে পাঠদান কার্যক্রম শুরু হয়েছে।
রবীন্দ্র বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্য কী ছিল এবং সেই উদ্দেশ্য বাস্তবায়নে কতটুকু ভূমিকা রাখতে পেরেছে তা জানতে দ্য ডেইলি স্টার কথা বলেছে বিশ্ববিদ্যালয়ের বর্তমান উপাচার্য অধ্যাপক ড. মো. শাহ্ আজমের সঙ্গে।
অধ্যাপক ড. মো. শাহ্ আজম মনে করেন, রবীন্দ্র বিশ্ববিদ্যালয় এখনো প্রারম্ভিক পর্যায়ে আছে। তবে ছন্দে ফেরার জন্য চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন তারা।
দ্য ডেইলি স্টার: রবীন্দ্র বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্য কী ছিল?
অধ্যাপক ড. মো. শাহ্ আজম: রবীন্দ্র বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন হয় ২০১৫ সালে। বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্য ছিল রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের চেতনা, সৃষ্টিকর্ম ছড়িয়ে দেওয়া, তরুণদের উদ্বুদ্ধ করা। মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় উজ্জীবিত করতে রবীন্দ্রনাথের সাহিত্য কর্ম যে কাজে লাগতে পারে সেরকম একটি চেতনার জায়গা থেকে এই বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করা হয়।
২০১৭ সাল থেকে এখানে একাডেমিক কার্যক্রম শুরু হয়। রবীন্দ্রনাথের নিদর্শন, সৃষ্টিকর্ম, চিন্তা, দর্শনের প্রেরণা, সৃষ্টি অম্লান রাখার উদ্দেশ্য থেকেই এই বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করা হয়।
রবীন্দ্রনাথের প্রতি জনগণের যে প্রেম-ভালোবাসা, সেই জায়গা থেকেই প্রতিষ্ঠা পায় এই বিশ্ববিদ্যালয়। এটি একটি সাধারণ বিশ্ববিদ্যালয় যেখানে কলা, চারুকলা, সমাজ বিজ্ঞান, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি, কৃষি ইত্যাদি বিষয়ের পাশাপাশি রবীন্দ্রনাথের সৃষ্টিকর্ম অম্লান রাখার কথা বলা হয়েছে।
ডেইলি স্টার: শুরুতেই রবীন্দ্রনাথকে জানার জন্য রবীন্দ্র অধ্যয়ন নামে একটি বিষয় ছিল। সেটির নাম পরিবর্তন করে বাংলা বিভাগ করা হলো কেন?
অধ্যাপক শাহ্ আজম: শুরুতে এখানে রবীন্দ্র অধ্যয়ন, সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য ও বাংলাদেশ স্টাডিজ, মিউজিক বিভাগ ছিল। এই বিভাগগুলোর প্রেরণা ছিল, রবীন্দ্রনাথ যেন সেগুলোর মধ্যে থাকেন। তবে বিভাগগুলো চালু করার সময় বহির্বিশ্বের শিক্ষার সঙ্গে কোনো সংসর্গ আছে কি না সেই বিষয়টি তেমনভাবে খেয়াল করা হয়নি। কিংবা এর মাধ্যমে বৈশ্বিক মানদণ্ড অনুযায়ী শিক্ষা দেওয়া যায় কি না, কিংবা বর্তমান চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করা যায় কি না সেগুলো না ভেবেই বিভাগগুলো তৈরি করা হয়।
আমি দায়িত্ব নেওয়ার পর রবীন্দ্রনাথের দর্শনের প্রতিফলন কিংবা রবীন্দ্র দর্শনকে চালিকা শক্তি হিসেব ব্যবহৃত হচ্ছে এমন জায়গাটি দেখতে পাইনি।
দায়িত্ব নেওয়ার পর বিভিন্ন জনের প্রত্যাশা জানার চেষ্টা করেছি। অনেকে শুধু কলা ও চারুকলা রাখার পরামর্শ দেন, অনেকে আবার এখানে জ্ঞান-বিজ্ঞানের চর্চার জন্য বলেন। বিভিন্ন জনের প্রত্যাশার পরিপ্রেক্ষিতে আধুনিক জ্ঞান-বিজ্ঞানের চর্চা, মতপ্রকাশের স্বাধীনতার চর্চা এবং দেশীয় সংস্কৃতির চর্চা করার চেষ্টা করছি।
রবীন্দ্র অধ্যয়ন বিষয়টির নাম পরিবর্তন করা হয়েছে বাংলা বিভাগ। কারণ স্নাতক পর্যায়ে রবীন্দ্রনাথকে অধ্যয়ন করা সম্ভব না। আমরা রবীন্দ্র অধ্যয়ন নামে একটি গবেষণা কেন্দ্র করার কথা ভাবছি। যেখানে রবীন্দ্রনাথের দর্শন ও জীবনকে নিয়ে গবেষণা হতে পারে। রবীন্দ্র অধ্যয়ন নামে যে কোর্স ডিজাইন করা হয়েছিল সেখানে স্নাতক পর্যায়ে রবীন্দ্রনাথকে গ্রহণ করে তার দর্শন চিন্তা ধারণ করার মতো আউটকাম পাইনি।
তাছাড়া শিক্ষার্থীদের মধ্যে এক ধরনের হতাশা ছিল, দেশে কোথাও আর এমন বিষয় নেই। তারা এই বিষয়ে পড়ে কোন ধরনের চাকরি করবে। তাই বিভাগটির নাম পরিবর্তন করা হয়েছে।
ডেইলি স্টার: রবীন্দ্রনাথের দর্শন, সাহিত্য, চিন্তাধারা জানতে গত ৬ বছরে কী কী উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে? যেগুলো কী যথাযথ বলে মনে করেন?
অধ্যাপক শাহ্ আজম: বিশ্ববিদ্যালয়ের শুরুতে অনেক চ্যালেঞ্জ থাকে। ক্লাস কোথায় হবে, কারা থাকবেন, কারা ক্লাস নেবেন। শেখার ধারা জনভেদে ভিন্ন। শুরুর দিকে রবীন্দ্রনাথ শুধু পঠন-পাঠনের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল, যা আমার কাছে যথেষ্ট মনে হয় না। আমি যোগদানের পর ক্লাসরুমের বাইরের শিক্ষার দিকে জোর দেওয়ার চেষ্টা করি, বিভিন্ন সংগঠনকে উৎসাহিত করেছি, রবীন্দ্র বিশ্ববিদ্যালয় সংস্কৃতি কেন্দ্র তৈরি করা হয়েছে, ফিল্ম সোসাইটি, থিয়েটার, ফটোগ্রাফিক সোসাইটিসহ বিভিন্ন সংগঠন করেছি। রবীন্দ্রনাথের আচার, কৃষ্টি-কালচার সম্পর্কে জানার জন্য নানা উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। অনেক ইভেন্ট বাড়ানো হয়েছে, সেমিনার কনফারেন্স করা হয়েছে, রবীন্দ্রনাথের বিভিন্ন নাটক শিক্ষার্থীদের দিয়ে মঞ্চায়ন করা হচ্ছে, বিভিন্ন অনুষ্ঠানে রবীন্দ্র সংগীত গাওয়া হচ্ছে, রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে বিশেষ লেকচারের আয়োজন করা হচ্ছে।
আমরা রবীন্দ্রনাথের ভাষা চিন্তা নিয়ে একটি বড় সেমিনার করেছি। একটি কনফারেন্সে করেছি পল্লী উন্নয়ন একাডেমিতে। সেখানে রবীন্দ্রনাথের দর্শন, সাহিত্য, ভাষা নিয়ে আলোচনা করেছেন রবীন্দ্র গবেষক অধ্যাপক শফি আহমেদ। রবীন্দ্র গবেষক সনৎ কুমার সাহাকে আমরা আমন্ত্রণ করেছিলাম। তিনি রবীন্দ্রনাথের নানা বিষয় নিয়ে আলোচনা করেছেন। আমাদের শিক্ষকরা রবীন্দ্রনাথের সাহিত্য দর্শন, চিন্তাধারা নিয়ে গবেষণা করছেন। এর আউটকামগুলো শিক্ষার্থীদের মধ্যে ছড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে।
সবমিলিয়ে আমরা একটি ছন্দময় পরিবেশ সৃষ্টি করার পথে। আমাদের যে সুযোগ-সুবিধা আছে সেগুলো নিয়েই আমরা এগিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছি। পঠন-পাঠনের বাইরে আমাদের কাজকর্ম দিয়ে রবীন্দ্র দর্শন, সাহিত্য, চেতনা, সংগীত, বাঙালি চেতনা, সংস্কৃতি, মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ছড়িয়ে দেওয়ার চেষ্টা করছি। একটি নতুন ধারা তৈরি করার পথে আছি।
ডেইলি স্টার: আপনি বলছেন রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে গবেষণা, আলোচনা হয়। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয়ের ওয়েবসাইটে তো এর তেমন কোনো প্রতিফলন দেখা যাচ্ছে না। কারণ কী?
অধ্যাপক শাহ্ আজম: যখন মানুষের অস্তিত্ব সংকটাপন্ন হয় তখন মানুষকে জানানোর বিষয়টি মুশকিল। আমরা নানা সংকটের মধ্য দিয়ে যাচ্ছি। ওয়েবসাইটটি এখনো ঠিক করা হয়নি। অনেক কিছু সেখানে নেই। আসলে আমাদের কাজকর্ম সেখানে থাকা উচিত। আমরা দ্রুত ওয়েবসাইটটি আপডেট করার ব্যবস্থা করবো।
ডেইলি স্টার: আপনি আসার পর অনেক উদ্যোগ নিয়েছেন। আগে যারা উপাচার্যের দায়িত্বে ছিলেন তারা কী কী করেছেন?
অধ্যাপক শাহ্ আজম: আমার আগে যারা দায়িত্বে ছিলেন তারা কী করেছেন সেটি তো বলা কঠিন। আমি আসার পর কনফারেন্স, বইমেলা, সাংগঠনিক কার্যক্রম করেছি, অংশীজন সভা করেছি, শুদ্ধাচার পুরস্কার দিয়েছি, লেকচার থিয়েটার করেছি, কম্পিউটার ল্যাব করেছি, সংগীত চর্চার জন্য একটি সমৃদ্ধ থিয়েটার করা হয়েছে। এর সবকিছুই নাকি এখানে প্রথমবারের মতো হয়েছে। তাহলে এর আগে কী হয়েছি সেটি আমারও প্রশ্ন।
শিক্ষকদের প্রশিক্ষণের আওতায় আনা হয়েছে। গত ২৬ জুলাই বিশ্ববিদ্যালয় দিবস পালন করা হয়েছে, সেটিও নাকি প্রথম। সুতরাং আগে যারা বিশ্ববিদ্যালয়ের দায়িত্বে ছিলেন তারা কী করেছেন এটি আপনারই বুঝে নিন।
ডেইলি স্টার: বর্তমানে বিশ্ববিদ্যালয়ের চ্যালেঞ্জগুলো কী কী?
অধ্যাপক শাহ্ আজম: আমাদের চ্যালেঞ্জ দ্বিমুখী। শিক্ষার্থীদের সময় যেন নষ্ট না হয়, তারা যাতে সঠিক সময় কোর্স সম্পন্ন করতে পারে সেই ব্যবস্থা করা। আমাদের মূল ক্যাম্পাস নেই। দ্রুত এর ব্যবস্থা করা দরকার। ক্যাম্পাস যেখানে হবে সেটি জলাশয় ও নিম্নভূমি। সেই নিম্নভূমি ক্যাম্পাসের উপযোগী করে গড়ে তোলা বড় চ্যালেঞ্জ। মূল ক্যাম্পাসে রবীন্দ্রনাথের চিন্তাধারার প্রতিফলন যাতে ঘটে সেটি নিশ্চিত করতে হবে।
ডেইলি স্টার: রবীন্দ্রনাথের প্রয়াণ দিবস উপলক্ষে কী উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে?
অধ্যাপক শাহ্ আজম: আমরা বিভিন্ন কর্মসূচী হাতে নিয়েছি। রবীন্দ্রনাথের ঠাকুরের প্রতিকৃতে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানানো হয়েছে, কবিগুরুর ওপর আলোচনা এবং সংগীত, আবৃত্তি ও নৃত্যের আয়োজন করা হয়েছে।
ডেইলি স্টার: সার্বিকভাবে রবীন্দ্র বিশ্ববিদ্যালয় এখন কোন অবস্থানে আছে?
অধ্যাপক শাহ্ আজম: আমাদের এখন চিন্তা করতে হবে আমরা হামাগুড়ি দিচ্ছি, নাকি একটু দাঁড়ানোর চেষ্টা করছি। প্রকৃত অর্থে এখনো প্রারম্ভিক পর্যায়ে আছি। যে ক্যাম্পাসে যাবো সেই জমির অধিগ্রহণ এখনও সম্পন্ন হয়নি। সেই অর্থে বিশ্ববিদ্যালয়টি আসলে এখনো শুয়েই আছে, হামাগুড়িও দিতে পারেনি। জমি অধিগ্রহণের পর পরিকল্পনা, ক্যাম্পাস, অর্থছাড় তারপর সবকিছু হবে।
আমিও এখানে নতুন উপাচার্য। আরও কিছুদিন সময় লাগবে সবকিছু বুঝে উঠতে। আমি যোগদানের পর জমি অধিগ্রহণের কাজ দ্রুত গতিতে এগুচ্ছে, এটুকু বলতে পারি। আমাদের অনেক কিছু এখন আগের চেয়েও বেশি দৃশ্যমান, অনেক গতিশীল। তবে সামগ্রিকভাবে কিছুটা পিছিয়ে থাকলেও আমরা অনেকটা এগিয়ে যাচ্ছি।
Comments