বীজ কোম্পানির বিরুদ্ধে প্রতারণার অভিযোগ, কৃষকের ক্ষতি ৭০ লাখ টাকা

চাষিরা মিশ্র জাতের বেগুন (নিম্ন ফলনশীল) চারা ক্ষেত থেকে তুলে ফেলছেন। জমিতে ফুল আসা অনেক চারা মারাও গেছে। এ নিয়ে উপজেলার নওগাঁ-প্রভুরামপুরের প্রায় ১২৬ জন কৃষক হতাশা। ছবি: মোস্তফা সবুজ

গাইবান্ধার গোবিন্দগঞ্জ উপজেলার নওগাঁ-প্রভুরামপুর গ্রামের শতাধিক কৃষক একটি কোম্পানির খয়েরি লম্বা জাতের বেগুনের বীজ কিনে প্রতারিত হয়েছেন বলে অভিযোগ করেছেন।

কৃষকদের অভিযোগ, খেতে শিউলি জাতের পাশাপাশি আরও ২-৩ জাতের নিম্ন ফলনশীল দেশি জাতের চারাও পেয়েছেন তারা। নিম্নমানের বীজের কারণে গাছের বয়স দেড় মাস না হতেই অর্ধেক চারা মারা গেছে।

গত ২৯ জুলাই সরেজমিনে দেখা যায়, চাষিরা মিশ্র জাতের বেগুন (নিম্ন ফলনশীল) চারা ক্ষেত থেকে তুলে ফেলছেন। জমিতে ফুল আসা অনেক চারা মারাও গেছে। এ নিয়ে উপজেলার নওগাঁ-প্রভুরামপুরের প্রায় ১২৬ জন কৃষক হতাশা।

তাদের দাবি, এ কারণে প্রায় ৭০-৮০ টাকা ক্ষতি হয়েছে তাদের।

সরেজমিনে দেখতে গেলে কৃষকরা বীজ নিয়ে অভিযোগ করেন। ছবি: মোস্তফা সবুজ

এই গ্রামের বেল্লাল হোসেন (৬০) বলেন, '১০ শতক জমিতে শিউলি (এফ-১) জাতের বেগুনের চারা লাগিয়েছিলাম। দেড় মাস পরে দেখি জমিতে বিভিন্ন জাতের বেগুন হয়েছে। এছাড়া জমিতে অর্ধেক গাছ মারা গেছে।'

প্রভুরামপুরের মাহমুদুল হাসান লিটন (৩০) জানান, তিনি ৩০ শতক জমিতে শিউলি বেগুন লাগিয়েছিলেন। তার জমিরও একই অবস্থা। বিভিন্ন নিম্ন জাতের বেগুনের গাছ হয়েছে।

গ্রামের আরেক কৃষক সামছুদ্দিন প্রামাণিক। তিনিও ৩০ শতক জমিতে একই জাতের বেগুন চাষ করে বিপদে পড়েন। পরে নিম্ন জাতের গাছ জমি থেকে তুলে বাজার থেকে চারা কিনে আবার নতুন করে রোপণ করেছেন।

কার কাছ থেকে এই বীজ সংগ্রহ করা হয়েছে জানতে চাইলে কৃষকরা বলেন, এই গ্রামের দু'জন পরিচিত কৃষক রুবেল হোসেন এবং মামুনুর রশিদের কাছে থেকে তারা শিউলি জাতের বীজ কিনে জমিতে লাগান।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, কৃষাণ সীডস, গত মে মাসের বিভিন্ন সময়ে রুবেল হোসেন এবং মামুনুর রশিদ ১৫০ টাকা দরে প্রায় ৩৮ হাজার টাকার ২৫০ (৫ গ্রামের) প্যাকেট বীজ কুরিয়ারের মাধ্যমে কেনেন এবং সেগুলো গ্রামের শতাধিক কৃষকের কাছে বিক্রি করেন। এই দু'জন কৃষাণ কোয়ালিটি এগ্রো লিমিটেডের (কৃষাণ এগ্রো সার্ভিসের একটি প্রতিষ্ঠান) ময়মনসিংহের প্রধান কার্যালয় থেকে এগুলো সংগ্রহ করে। গ্রামে বীজ পৌঁছেন দেন কোম্পানিটির মার্কেটিং অফিসার কেশব রায়। কেশব রায় তারপর থেকে কৃষকদের ফোন রিসিভ করেন না।

বীজ কেনার রশিদ ও বীজের প্যাকেট। ছবি: স্টার

রুবেল হোসেন এবং মামুনুর রশিদের কাছে জানতে চাইলে তারা দ্য ডেইলি স্টারকে জানান, গত ৩-৪ বছর ধরে তারা শিউলি (এফ-১) জাতের বীজ কৃষাণ সীডস থেকে সংগ্রহ করে ভালো ফলন পেয়েছেন। কিন্তু, এবার চিত্র ভিন্ন। নিম্নমানের দেশি জাতের বীজ দিয়ে প্যাকেট ভরা।

রুবেল হোসেন বলেন, 'বীজ থেকে চারা প্রস্তুত করে জমিতে লাগানো হয়। গাছের দেড় মাস বয়স হতে না হতেই জমির অর্ধেক চারা গাছ মারা যায়। বাকি গাছে ফুল আসতে শুরু করলে কৃষক দেখতে পান যে, তাদের প্রায় ৩ ধরণের নিম্নমানের জাতের বীজ দেওয়া হয়েছে। আমি নিজেও এবার ৬৫ শতক জমিতে এই শিউলি জাতের বেগুন লাগিয়েছি।'

মামুনুর রশিদ বলেন, 'দেড় মাস বয়সে জমিতে হাইব্রিড জাতের শিউলি (এফ-১) জাতের বেগুন ছাড়াও ছোট সাদা এবং গোলাপি জাতের নিম্নজাতের বেগুন ধরছে, যার ফলন এবং দাম খুবই কম। শিউলি ছাড়া অন্য জাতের বেগুন কৃষকরা জমি থেকে তুলে ফেলেছেন এবং বাজার থেকে ২-৩ টাকা দরে নতুন চারা রোপণ করছেন।'

কৃষকদের দাবি, এ বছর প্রায় ৩০ একর জমিতে ১২৬ জন কৃষক শিউলি জাতের বেগুনের আবাদ করেছেন। যার সব বীজই তারা কৃষাণ সীডস থেকে সংগ্রহ করেছেন। প্রতি বিঘা জমিতে কৃষকের জমি প্রস্তুতসহ খরচ হয়েছে ৩০-৪০ হাজার টাকা। সেই হিসাব ৩০ একর জমিতে কৃষকের এ পর্যন্ত ক্ষতি হয়েছে ৪০-৫০ লাখ টাকা। যে চারাগুলো মারা গেছে এবং তুলে ফেলেছে সেখানে যে নতুন চারা কিনছেন তার মূল্য আরও ২০ লাখ টাকা। ফলে, সব মিলিয়ে নওগাঁ-প্রভুরামপুরের কৃষকরা প্রায় ৭০-৮০ লাখ টাকার ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছেন।

কৃষকদের হাতে বীজ কোম্পানির বীজের প্যাকেট। ছবি: মোস্তফা সবুজ

কৃষকরা বলছেন, এই বিষয়টি নিয়ে তারা স্থানীয় কৃষি কর্মকর্তার কাছে অভিযোগ দিয়েও কোনো ফল পাননি। কৃষি কর্মকর্তা বীজ কোম্পানির বিরুদ্ধে মামলা করতে বলেছেন। এ ছাড়া, তারা বীজ কোম্পানির কর্মকর্তাদের সঙ্গেও একাধিকবার যোগাযোগ করেছেন। প্রথমে কোম্পানির কর্মকর্তা ফোন রিসিভ করলেও পরে আর ফোন ধরেন না বলে অভিযোগ তাদের।

ইউনিয়ন উপ-সহকারী কৃষি কর্মকর্তা নূর মোহাম্মদ দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'আমি ঈদের এক সপ্তাহ পরে কৃষকদের জমিতে গিয়েছে। পরিদর্শনকালে দেখেছি, সেখানে মিশ্র জাতের চারা ছিল এবং নিম্নমানের বীজ দেওয়ার জন্য গাছ মারা যাচ্ছে। কৃষকদের আমি উপজেলা অফিসে লিখিত অভিযোগ দিতে বলেছিলাম, কিন্তু তারা দেননি।'

জানতে চাইলে গোবিন্দগঞ্জ উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা সৈয়দ রেজা-ই-মাহমুদের বলেন, 'এ বিষয়ে কৃষকরা আমার কাছে লিখিত বা মৌখিক কোনো অভিযোগ দেননি। কৃষকরা অভিযোগ দিলে আমি বীজ কোম্পানির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে পারতাম। তবে কৃষকরা এখনো যদি উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার মাধ্যমে ক্ষতিপূরণের আবেদন করেন, তাহলে আমরা ক্ষতিপূরণ আদায় করে দিতে পারব।'

কৃষাণ কোয়ালিটি এগ্রোর প্রোগ্রাম-কোঅর্ডিনেটর জাহাঙ্গীর হোসেন মুঠোফোনে বলেন, 'প্রভুরামপুর গ্রামের কৃষকরা এই বিষয়ে আমাদের জানিয়েছেন। এটা নিয়ে কথাবার্তা চলছে। আমরা যাব বলেছি, কিন্তু এখনো যেতে পারিনি। এমডি স্যার বিষয়টি জানেন। ওই এলাকার উপ-সহকারী কৃষি কর্মকর্তাও বিষয়টি আমাদের জানিয়েছেন।'

তিনি আরও বলেন, 'কীভাবে সেখানে খারাপ বীজ গেল সেটা তদন্ত করে দেখতে হবে। সারা দেশে আমরা বীজ সাপ্লাই দেয়। ওই গ্রাম ছাড়া এখনো কোনো অভিযোগ পাইনি। আমরা খুব দ্রুত সেখানে লোক পাঠাব।'

কৃষাণ এগ্রো সার্ভিসের মালিক এবং ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) শামীম আহমেদ দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'আমরা ওই গ্রামের একজন কৃষক মামুনুর রশিদকে ১৮১ প্যাকেট বীজ দিয়েছি। যা দিয়ে মাত্র ৫ একর জমি লাগানো যাবে। আমাদের লোকবল কম থাকায় সময় মতো কৃষকদের জমিতে পাঠাতে পারিনি। তবে সম্প্রতি একজনকে পাঠিয়েছিলাম।'

কী কারণে চারা মারা গেছে এবং মিশ্র জাতের বিষয়ে জানতে চাইলে শামীম আহমেদ বলেন, 'হাইব্রিড জাতে ১০ শতাংশ বীজ মিশ্র জাতের (সেগ্রিগেশন) থাকতে পারে। এটি কৃষিবিদরা জানেন, কিন্তু কৃষকরা জানেন না। আমি নিজেও একজন কৃষিবিদ। চারা বিভিন্ন কারণে মরতে পারে। বীজের কারণেও মরতে পারে। তবে আমি কৃষকদের বলেছি, যদি বীজের কারণে চারা মারা যায় তাহলে তারা যেন চারা পরিবর্তন করে জমিতে লাগায়। খরচ যা লাগে তা আমরা দেব। মাত্র ৫ একর জমির চারার দায়িত্ব আমরা নিতে পারব না, এমন কোম্পানি আমরা না। আমরা দীর্ঘদিন ধরে বীজের ব্যবসা করি।'

Comments

The Daily Star  | English

‘Shockingly insufficient’

"The proposed decision to allocate USD 250 billion per year for all developing countries is shockingly insufficient," said the adviser

1h ago