আহমদ ছফার শ্রেষ্ঠ প্রবন্ধের খোঁজে
আহমদ ছফার সর্বাধিক আলোড়িত প্রবন্ধ 'বাঙালি মুসলমানের মন'। বাংলা সাহিত্যেও বোধ করি এর অবস্থান ঈর্ষণীয়। বিদ্বৎসমাজ ও বুদ্ধিজীবী মহলের প্রতিনিধি স্থানীয়দের কয়েকজন প্রবন্ধটিকে দিয়েছেন শ্রেষ্ঠ প্রবন্ধের তকমা ও মান্যতা। যার সঙ্গে আমার রয়েছে বিস্তর দ্বিমত এবং একমত হতে না পারার সদর্থক অনুযোগ।
'ছফার মতো' এই দেশটাকে যারা কেবল ভালই বাসেন না, সহানুভূতির সঙ্গে আত্ম নিবেদন করেন দেশ ও জনপ্রেমে এবং বুদ্ধিজীবীর ধর্মে রাখেন মনন ও সৃজন চর্চার যাবতীয় চ্যালেঞ্জ গ্রহণের অমিত সাহস, তারা বোধ করি একমত হবেন ছফার শ্রেষ্ঠ প্রবন্ধ 'সাম্প্রতিক বিবেচনা: বুদ্ধিবৃত্তির নতুন বিন্যাস'। এই ছাড়া অন্যকোন প্রবন্ধ কিংবা 'বাঙালি মুসলমানের মন' কে সে কাতারে রাখিনা।
তাহলে কেন অধিকাংশ 'বাঙালি মুসলমানের মন'কেই ছফার প্রতিনিধি জ্ঞান করল এবং চর্চা জারি রাখল সেই প্রশ্নের উত্তর তালাশে করব। বাঙালি মুসলমানের মানস গঠনের দীর্ঘ ভ্রমণকে তিনি ছোট্ট একটা প্রবন্ধের মধ্যে দিয়ে যেভাবে ধরতে পেরেছেন, তা শুধু বিস্ময়কর ও অভূতপূর্ব নয়, তুলনারহিত। মাত্র ২০ পৃষ্ঠার একটা প্রবন্ধ, উত্তর ভূমিকা সমেত ২৮ পৃষ্ঠা। যা লেখা হয়েছিল ১৯৭৬ সালে, গ্রন্থভূক্ত হয়ে প্রকাশিত হয় ১৯৮১ সালে।
স্বল্পায়তনের প্রবন্ধটি হয়ে উঠেছে একটা জাতির বোঝাবুঝির গুরুত্ববহ দলিল বিশেষ। 'বাঙালি মুসলমানের মন' পড়ে আমরা যেন নিজেদেরকেই আবিষ্কার করি। প্রবন্ধটির বয়স পঞ্চাশের কাছাকাছি হয়ে এলেও তার মানস গঠনে কোনো পরিবর্তন কিংবা উন্নতিতো ঘটেইনি বরং অবনমন হয়েছে এবং প্রবন্ধে চিহ্নিত স্বর ও সুর ধরতে হয়েছেন অপারগ, এবং সতত চেষ্টা জারি রাখার যে কোশেশ ও অধ্যবসায় প্রয়োজন তা থেকে রেখেছেন নিরাপদ দূরত্ব ও বিস্তর ব্যবধান। বাঙালির বিদ্বৎ ও বুদ্ধিজীবী সমাজ তারপরেও এই প্রবন্ধকে যেভাবে গ্রহণ করেছেন, 'সাম্প্রতিক বিবেচনা: বুদ্ধিবৃত্তির নতুন বিন্যাস'কে নয়। কারণ এই প্রবন্ধে ছফা ব্যক্তির চেয়ে সমষ্টির দায় ও ব্যর্থতাকে অন্বেষণ করেছেন।
বাঙালি মুসলমানের এই সীমাবদ্ধতার পেছনে তিনি বাঙালিকেও যেমন দায়ী করেননি তেমনি মুসলমানের ওপরও কোনো প্রকার দোষারোপও দেননি। তিনি বলেছেন, 'বাঙালি মুসলমানের মন যে এখনো আদিম অবস্থায় তা বাঙালি হওয়ার জন্যও নয় এবং মুসলমান হওয়ার জন্যও নয়। সুদীর্ঘকালব্যাপী একটি ঐতিহাসিক পদ্ধতির দরুন তার মনের উপর একটি গাঢ় মায়াজাল বিস্তৃত রয়েছে, সজ্ঞানে তার বাইরে সে আসতে পারে না। তাই এক পা যদি এগিয়ে আসে, তিন পা পিছিয়ে যেতে হয়। মানসিক ভীতিই এ সমাজকে চালিয়ে থাকে। দু' বছরে কিংবা চার বছরে হয়ত এ অবস্থার অবসান ঘটানো যাবে না, কিন্তু বাঙালি মুসলমানের মনের ধরন-ধারণ এবং প্রবণতাগুলো জানার চেষ্টা করলে এ অবস্থা থেকে বেরিয়ে আসার একটা পথ হয়ত পাওয়াও যেতে পারে।'
আমাদের বিদ্বৎসমাজ ও বুদ্ধিজীবী মহল প্রবন্ধটির শেষাশেষি এসে নিজেদের মুক্তি ও আশ্রয় খুঁজে পেয়েছেন। অতীত ব্যর্থতা, কাণ্ডজ্ঞানহীন বুদ্ধিজীবীতা এবং সৃজন ও মনন চর্চার নামে যে বস্তাপচা উৎপাদন-ভাঁড়ামো ও মেরুদণ্ডহীনতায় যাদের লক্ষ্য ও প্রাপ্তি-অর্জনের সর্বোচ্চ মানদণ্ড। তার জন্য নাকি তারা দায়ী নন। দায়ী ছফার ভাষায়, 'সুদীর্ঘকালব্যাপী একটি ঐতিহাসিক পদ্ধতি।' ফলে, বাঙালি মুসলমান আরশিতে নিজেকে না দেখে, নিজের জাতিগত ও ধর্মগত অবস্থানকে অবলোকন না করে, 'ঐতিহাসিক পদ্ধতি'র ওপর সবকিছু চাপিয়ে দিয়ে নিজেকে শুধু দায়হীন ও ভারমুক্ত জ্ঞান করেননি, এক ধরণের আত্মতৃপ্তিতে ভুগেছেন, যার সুযোগ নেই 'সাম্প্রতিক বিবেচনা: বুদ্ধিবৃত্তির নতুন বিন্যাস' প্রবন্ধে। এই অবকাশ এবং বাস্তবতা যদি সত্যিকার অর্থে বেগবান থাকে মূল ধারা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয় তাহলে কোনোদিনই 'বাঙালি মুসলমানের মন' বিকশিত হবে না। যৌক্তিক কাঠামোয়-বিজ্ঞান নির্ভর সমাজ ও রাষ্ট্র গঠনের প্রত্যাশা, কল্যাণ রাষ্ট্র ও মানবতাবাদী সমাজ নির্মাণের স্বপ্ন অধরা থাকবে বছরের পর বছর-হতে পারে শতাব্দকালও। প্রবন্ধের একেবারে শেষাশেষি এসে ছফা যে বলেছেন, 'বাঙালি মুসলমানের মনের ধরন-ধারণ এবং প্রবণতাগুলো জানার চেষ্টা করলে এ অবস্থা থেকে বেরিয়ে আসার একটা পথ হয়ত পাওয়াও যেতে পারে।' 'বাঙালি মুসলমানের মন' প্রবন্ধের চাবিকাঠি এখানেই উপ্ত রয়েছে। যদিও তিনি, সরাসরি বা প্রত্যক্ষরূপে এই বয়ান না রেখে, পরোক্ষেই বলেছেন মূলকথা।
আমরা মনে করি, কোনো ঐতিহাসিক পদ্ধতির ওপর নয় নিজেদের অতীত থেকেই খুঁজে নিতে হবে বর্তমানের চাওয়া-পাওয়া। নির্মাণ করতে হবে সমৃদ্ধ বর্তমান এবং উজ্জ্বল আগামী। 'ঐতিহাসিক পদ্ধতি', 'পরোক্ষ বয়ান', 'অপ্রত্যক্ষ' নির্দেশনা, 'যদি'-'হয়তো'র ব্যবহার এই প্রবন্ধের মূল সুরের উচ্চকিত উপস্থাপনাকে বাধাগ্রস্ত করার পাশাপাশি সপাট ও দ্ব্যর্থবোধক অভিলক্ষ্যকে করেছে কিঞ্চিত বিভ্রান্ত-অনেকাংশে সংশয়িত, যার লেশমাত্র উপস্থিতি নেই 'সাম্প্রতিক বিবেচনা: বুদ্ধিবৃত্তির নতুন বিন্যাস' প্রবন্ধে। এই থাকা না থাকার মধ্যেই ছফার আলোচিত দুই প্রবন্ধের ফারাক ও শ্রেষ্ঠত্ব-প্রিয়তা প্রশ্নের ফায়সালা। বাঙালি মুসলমান ও বাংলাদেশের বিদ্বৎ ও বুদ্ধিজীবী সমাজের গড় যে খাসলত তাতে স্পষ্ট হয়ে যায় তার চয়নের দৌড় এবং বোঝাপড়ার ফায়সালা।
আহমদ ছফার ইহজাগতিক সময়কালটা জানা থাকলে এই আলোচনা হয়ে উঠবে আরও বেশি পরিষ্কার, হৃদয়গ্রাহী ও দ্বিপাক্ষিকতায় ঋদ্ধ। জন্মেছিলেন ১৯৪৩ সালের ৩০ জুন, মারা যান ২৮ জুলাই ২০০১। ষাট বছরেরও কম সময়ের স্বল্পরেখার জীবনকে তিনি রাঙায়িত করেছিলেন ঈর্ষণীয় সব সৃষ্টির উজ্জ্বলতায়। তার সবচেয়ে বড় পরিচয় বুদ্ধিজীবী ধর্ম পালনে তিনি ছিলেন এই ভূখণ্ডে বিরলপ্রজ এক নাম এবং যেখানে তার তুলনা কেবল ছফা নিজেই, আগে পর কেউ নয়, আজও আবির্ভূত হননি।
আহমদ ছফার 'সাম্প্রতিক বিবেচনা: বুদ্ধিবৃত্তির নতুন বিন্যাস' প্রবন্ধটি 'বাঙালি মুসলমানের মন' এর তুলনায় লেখন সময়ের বিচারে জ্যেষ্ঠ এবং অভিনবও বটে। অভিনব এই কারণে যে প্রবন্ধটি যখন লেখা হয় তখন বাংলাদেশ নামক দেশটি সদ্য স্বাধীন হয়েছে। ৪৩ পৃষ্ঠার এই প্রবন্ধটির লেখা ও প্রকাশ ১৯৭২ সালে। মাত্র একটা প্রবন্ধের এই বইয়ের ভূমিকা লিখেছেন বদরুদ্দীন উমর ও আহমদ শরীফ। ১৯৯৭ সালে তখন বাংলাদেশের স্বাধীনতার রজতজয়ন্তী সময়, বইটিরও। ছফা বইটি নতুন ভাবে প্রকাশ করলেন। এবং ওই প্রবন্ধের মূল শক্তি ও উদ্দিষ্ট বিষয়ের সঙ্গে সঙ্গতি লেখে রচনা করলেন দীর্ঘ একটা ভূমিকা যা কেবল একটা বইয়ের নতুন সংস্করণের ভূমিকার মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকল না হয়ে উঠলো পৃথক একটা প্রবন্ধ, ঠিক পৃথক নয় বলা যায়, একটা প্রবন্ধের ২৫ বছর বয়সকে দেখার ও যুঝাযুঝির বর্ধিতায়োজন। ছফার দীর্ঘ ভূমিকা লেখার অভ্যাস-আগ্রহ ও পক্ষপাত নতুন নয়।
'বাঙালি মুসলমানের মন' এর উত্তর ভূমিকা লিখেছিলেন আট পৃষ্ঠার কলেবরে। কিন্তু এবার লিখলেন ৩৬ পৃষ্ঠার দীর্ঘ এক লেখা। যার নাম দিলেন, 'পরবর্ধিত সংস্করণের ভূমিকা: সাম্প্রতিক বিবেচনা।' পরিবর্ধিত সংস্করণ প্রকাশ করতে গিয়ে পরিবর্তন ঘটালেন বইয়ের নামেও-রাখলেন, 'সাম্প্রতিক বিবেচনা: বুদ্ধিবৃত্তির নতুন বিন্যাস।' এই প্রবন্ধকে অনায়াসে বলা যেতে পারে আহমদ ছফার সিগনেচার প্রবন্ধ। কারণ ছফা যেমন ছিলেন, স্বপ্ন যেমন দেখতেন, লেখক-কবি-সাহিত্যিক-অধ্যাপক-সাংবাদিক-সম্পাদক-সমাজ সংস্কারক-সংস্কৃতি কর্মী-ধর্ম প্রচারক সর্বোপরি বুদ্ধিজীবীর ভূমিকাকে যেমন জ্ঞান করতেন, রাজনৈতিক, ক্ষমতাধর-প্রশাসক-অর্থনীতিক-ব্যবসায়ীর কাছে যেমন দেশপ্রেমের নজির প্রত্যাশিত ছিলেন, তার সবটাই হাজের নাজেল ছিল আলোচ্য প্রবন্ধে। যার প্রথম অংশে ছিল স্বাধীনতা পূর্বকালের ঘটন-অঘটনের নানান ফিরিস্তি। ৪৭ থেকে ৭১ সময়কালকে যদি নির্মোহভাব চকিতে দেখে নিতে হয় তাহলে সেই দেখার শ্রেষ্ঠ আয়নাটার নাম আহমদ ছফার প্রবন্ধ 'বুদ্ধিবৃত্তির নতুন বিন্যাস'। আবার ৭১ থেকে ৯৭ সময়কালের বাংলাদেশ রাষ্ট্র ও তার প্রতিনিধিস্থানীয় ব্যক্তি ব্যক্তি-প্রতিষ্ঠান ও সংগঠন সমূহের ভূমিকাকে যদি বুঝতে হয় তাহলে সেই ক্ষেত্রে ব্যবহারযোগ্য সবচেয়ে উৎকৃষ্ট ও স্বচ্ছ চশমাটার নাম হবে আহমদ ছফার 'সাম্প্রতিক বিবেচনা: বুদ্ধিবৃত্তির নতুন বিন্যাস' প্রবন্ধের প্রথমাংশ 'সাম্প্রতিক বিবেচনা'।
'বুদ্ধিবৃত্তির নতুন বিন্যাস' এর শুরুটা তিনি করেছেন এভাবে, 'বুদ্ধিজীবীরা যা বলতেন, শুনলে বাংলাদেশ স্বাধীন হতো না। এখন যা বলছেন, শুনলে বাংলাদেশের সমাজ-কাঠামের আমূল পরিবর্তন হবে না।' এরপর নিশ্চয় বুঝতে বাকি থাকে না কেন, আলোচ্য প্রবন্ধ শ্রেষ্ঠত্বের শিরোপা পায়নি। কেননা শিরোপা দিতে হলে, বিষয়টা সর্বাগ্রে ধারণ করতে হয়, যাতে আমাদের দেশের বুদ্ধিজীবীদের খর্বকায় রূপ প্রকাশিত হয় পুরো আরশিজুড়ে। ছফা এরপর লিখছেন, 'আগে বুদ্ধিজীবীরা পাকিস্তানি ছিলেন, বিশ্বাসের কারণে নয়- প্রয়োজনে। এখন অধিকাংশ বাঙালি হয়েছেন- সেও ঠেলায় পড়ে। কলাবরেটরদের মধ্যে এমন অনেকে আছে, যারা অন্ধভাবে হলেও ইসলাম, পাকিস্তানকে সত্যি সত্যি বিশ্বাস করে। আবার স্বাধীন বাংলাদেশে চতুঃস্তম্ভের জয়ধ্বনি দিচ্ছেন, এমন অনেক বুদ্ধিজীবী রয়েছেন, যারা সারাজীবন কোনকিছুতে যদি নির্দ্বিধায় বিশ্বাস করতে পেরেছেন- সে বস্তুটির নাম সুবিধাবাদ।'
আহমদ ছফা বাংলাদেশের বুদ্ধিজীবী সমাজ সম্পর্কে যে বয়ান দিয়ে শুরু করেছন আলোচ্য প্রবন্ধ, এর চেয়ে ঢের সত্য আর কিছুই নয়। তিনি বুদ্ধিজীবীদের ভূমিকাকে ভরকেন্দ্রে রেখে সমাজ-রাষ্ট্রের চালিকাশক্তি যেসব ব্যক্তি- প্রতিষ্ঠান- সংগঠন, তাদের সবার ভূমিকা ও স্বরূপ নিয়ে আলোচনা করেছেন। এবং এই আলোচনা কোনো প্রকার অপ্রত্যক্ষ, ইংগিতবাহী, ঘুরিয়ে পেঁচিয়ে নয় সরাসরি এবং কোনো প্রকার রাখঢাক ব্যতিরেকেই। সত্য প্রকাশে তার ছিল না কোনো প্রকার অবগুণ্ঠন কিংবা আড়াল-আবডালের ফন্দি-ফিকির।
বরং শ্রেয়জ্ঞান করেছেন এমত বিশ্বাস যে, এভাবে ঝুঁকি নিয়ে-চ্যালেঞ্জকে অবশ্যম্ভাবী জ্ঞান করার পরও যদি তাদের কোনো প্রকার পরিবর্তন হয়-বোধোদয় ঘটে, তাহলে আখেরে তো এই দেশ ও জাতির কল্যাণই হবে। একারণে ব্যক্তিগত লাভ-লোকসানকে শিকেয় তুলে রেখেই তিনি সত্যের প্রশ্নে, বুদ্ধিজীবীদের ভূমিকা কীরূপ হওয়া উচিত তার চুলচেরা বিশ্লেষণে নিজের বুদ্ধিজীবীতার সঙ্গে আপস করেননি একরত্তি পরিমাণও। এর জন্য তাকে কম খেসারত দিতে হয়নি। যে কথার উল্লেখ পাওয়া যায় ছফার বয়ানেই। তিনি লিখেছেন, 'মাঝে মাঝে এমন চিন্তাও আমার মনে আসে, লেখাটি (বুদ্ধিবৃত্তির নতুন বিন্যাস) যদি না লিখতাম, হয়ত আমার জীবন অন্যরকম হতে পারত। এই লেখাটির জন্যই আমাদের দেশের মধ্যবিত্ত শ্রেণিভুক্ত এক শ্রেণির বুদ্ধিজীবীর রোষ আমাকে পেছন থেকে অভিশাপের মতো তাড়া করেছে। অদ্যাবধি আমি জীবনে স্বস্তি কি বস্তু তার সন্ধান পাইনি। আগামীতে কোনদিন পাব, সে ভরসাও করিনে।'
'অভিশাপ' পাওয়ার পর, 'স্বস্তি' হারানোর মধ্যে দিয়েও যদি বুদ্ধিজীবী সমাজের পরিবর্তন ঘটত, তাহলেও বোধ করি ছফার এক ধরনের প্রাপ্তি ঘটত এবং এতকিছুর পরও সব থেকে বেশি খুশি হতেন আহমদ ছফা নিজেই। কেননা তিনি বাংলাদেশের কল্যাণ চেয়েছিলেন, বাঙালি জাতির মুক্তি কামনা করেছিলেন আর খুব বেশি করে চেয়েছিলেন সাধারণ মানুষের কল্যাণ, স্বাভাবিকভাবে খেয়ে পরে বেঁচে থাকার নিশ্চয়তা ও সামাজিক নিরাপত্তা। দুঃখজনক হলেও সত্যি এবং সকরুণ বাস্তবতা যে, আজও সেসব অধরা রয়ে গেছে। কেবল কাগজে কলমে আর সংখ্যার গোলক ধাঁধায় আটকে রয়েছে। এ যেন 'কাজীর গরু কেতাবে আছে গোয়ালে নেই' এর মতো বাস্তবতা।
আহমদ ছফা 'বুদ্ধিবৃত্তির নতুন বিন্যাস' এর পর 'সাম্প্রতিক বিবেচনা' লিখেছিলেন ২৫ বছর পর। তার পর আরও ২৫ বছর পেরিয়ে গেছে। পেরিয়েছে স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীর ক্ষণ। কিন্তু যে দুঃখ দূর করার জন্য ছফা 'অভিশাপ' দগ্ধ হয়েছিলেন, 'স্বস্তি' হারিয়েছিলেন আজীবনের তরে, সেই দুঃখ ঘোচেনি। বুদ্ধিজীবীর ধর্ম সদর্থক অর্থে প্রতিষ্ঠিত হয়নি আজও। যে সমাজে-রাষ্ট্রে বুদ্ধিজীবীরা ব্যক্তি লাভালাভে থাকে আসক্ত, পদ-পদবি-পুরস্কারের প্রতি মোহাবিষ্ট থাকায় যাদের জীবনের ধ্যান-জ্ঞান ও অভীষ্ট লক্ষ্য, সেই সমাজের দুঃখ দূর হওয়ার নয়, সেই সমাজের নৈতিক ভিত্তি শক্তভাবে দাঁড়াতে পারে না। সেই সমাজ যুক্তি নির্ভর-বিজ্ঞানভিত্তিক হয়ে উঠতে পারে না। সেই সমাজের সাধারণ মানুষের মুক্তি ও কল্যাণ অধরা থেকে যাওয়ায় সঙ্গত ও নিয়তি লিখন হিসেবে বিবেচ্য।
আহমদ ছফার 'সাম্প্রতিক বিবেচনা : বুদ্ধিবৃত্তির নতুন বিন্যাস' এর কাছে এদেশের বুদ্ধিজীবীদের ফিরে আসতেই হবে, ফিরে আসা ব্যতীত মুক্তি নেই। কেননা, বুদ্ধিজীবীর ধর্ম কেমন ছিল, কেমন হওয়া উচিত, তার জাতীয়তাবাদ-আন্তর্জাতিকতাবাদের দৈর্ঘ্য-প্রস্থ, কীরূপে ও কীভাবে সংহত ও সমুন্নত ভাবে সেসবের পবিত্র উচ্চারণ ও দিকনির্দেশনা রয়েছে এই প্রবন্ধে। এতে বুদ্ধিজীবীরা নাখোশ হতে পারেন-নিজেদেরকে উম্মুল ও দিগম্বর ভাবতে পারেন। কিন্তু এর সবটাই যে সত্য তা অস্বীকার, উপেক্ষা কিংবা আড়াল করার সুযোগ নেই। আর যদি সেটা করা হয় তাহলে সেটা হবে আত্মঘাতী এবং নিজের ছায়াকে অস্বীকারের শামিল। এতে হয়তো সাময়িক মুনাফা ভারী হতে পারে, কিন্তু আখেরে মুক্তি নেই। কেননা নিজেকে বুদ্ধিজীবী জ্ঞান করব-ভাবব-সুযোগ সুবিধা লুটব আর তার ধর্ম পালন করব না, তাতো হতে পারে না। তেমনটা হলে সেটা হবে নিজেকেই নিজে ধোঁকা দেওয়ার আত্মবিধ্বংসী এক খেলা।
যে পথ ছিল আহমদ ছফার বুদ্ধিজীবীতার ধর্ম-একজীবনের সাধনা সেই পথ নির্মাণ করতে পারলেই দেশ ও দশের মুক্তি হবে। 'সাম্প্রতিক বিবেচনা: বুদ্ধিবৃত্তির নতুন বিন্যাস', আমাদের সেই পথের দিশা দেয়, বুদ্ধিজীবীর ধর্ম শেখায়।
লেখার শুরুতে উল্লেখ হয়েছে, 'আহমদ ছফার মতো দেশকে ভালবাসার কথা'। সেটা কেমন বলে শেষ করব এই লেখা। হুমায়ূন আহমেদ লিখেছেন, 'আমি আমার যৌবনে হন্টন পীরের মতো একজনকে পেয়েছিলাম। আমরা দল বেঁধে তার পেছনে হাঁটতাম। তিনি যদি কিছু বলতেন মুগ্ধ হয়ে শুনতাম। গভীর রাতে নীলক্ষেত এলাকায় তিনি হাঁটতে হাঁটতে আবেগে অধীর হয়ে দুই হাত তুলে চিৎকার করে বলতেন, 'আমার বাংলাদেশ। আমার বাংলাদেশ।''
আমরা কি তার মতো করে বাংলাদেশকে একবুক আবেগ ও উচ্ছ্বাস দিয়ে ভালবাসতে পেরেছি?
কাজল রশীদ শাহীন: সাংবাদিক, সাহিত্যিক ও গবেষক
kazal123rashid@gmail.com
(দ্য ডেইলি স্টারের সম্পাদকীয় নীতিমালার সঙ্গে লেখকের মতামতের মিল নাও থাকতে পারে। প্রকাশিত লেখাটির আইনগত, মতামত বা বিশ্লেষণের দায়ভার সম্পূর্ণরূপে লেখকের, দ্য ডেইলি স্টার কর্তৃপক্ষের নয়। লেখকের নিজস্ব মতামতের কোনো প্রকার দায়ভার দ্য ডেইলি স্টার নেবে না।)
Comments