স্বপ্নভঙ্গের বেদনায় বিমর্ষ আহমদ ছফা

একজন বুদ্ধিজীবী হয়েও বুদ্ধিজীবী সমাজে তিনি বন্ধুহীন হয়ে পড়েছিলেন। এমনকি আজও বন্ধুহীন-ই রয়ে গেলেন। আদতে প্রকৃত লেখকের বন্ধু থাকে না।
ছবি: সংগৃহীত

আহমদ ছফার কাছে মুক্তিযুদ্ধ ছিল মহাসিন্ধুর কল্লোল-ধ্বনি ন্যায়। মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে আমরা প্রায় সবাই স্বাধীন সার্বভৌম একটি স্বতন্ত্র রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছিলাম। প্রায় সাড়ে সাতকোটি বাঙালির প্রত্যাশা ও প্রদীপ্ত প্রত্যয় এমনটাই ছিল। কিন্তু আহমদ ছফার খানিকটা বাড়তি প্রত্যাশা ছিল। মুক্তিযুদ্ধ ছিল তার কাছে মহাসিন্ধুর কল্লোল-ধ্বনির ন্যায়। তিনি চেয়েছিলেন এই কল্লোলধ্বনি থেকে এই দেশে নবজাগরণের সূত্রপাত ঘটবে। অন্তত কিছুটা হলেও পশ্চিমা ধাঁচের মতো করে এই দেশে রেনেসাঁসের সূত্রপাত ঘটবে। 'জাগ্রত বাংলাদেশ' বইটিতে তার এই স্বপ্ন ও স্বাধনার কথা লিপিবদ্ধ রয়েছে। 

বইটি তিনি কলকাতায় বসে লিখেছিলেন এবং চিত্তরঞ্জন সাহার সৌজন্যে স্বাধীনতা অর্জনের অনেক আগেই (জুলাই ১৯৭১) বইটি পাঠকের হাতে পৌঁছে যায়। কলকাতার মুক্তধারা সেদিন এই মহান দায়িত্বটি স্বেচ্ছায় ও সানন্দ্যে স্কঁন্ধে তুলে নিয়েছিল। মহান মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে এটিই সর্বপ্রথম প্রকাশিত পূর্ণাঙ্গ কোনো প্রবন্ধগ্রন্থ। আমার বিবেচনায় এটি কেবল একটি বই নয় এটি স্বপ্নের নাম। সেই স্বপ্নদ্রষ্টা ও স্রষ্টার আক্ষরিক নাম মহামতি আহমদ ছফা।

এক

বিপুল ত্যাগ ও তিতিক্ষার পর আসে মহান বিজয়, আসে ১৬ ডিসেম্বর (১৯৭১) সেই মাহেন্দ্রক্ষণ। দেশের ভেতরে নানা প্রান্ত ও প্রান্তরে, নদী-বিলঝিল-খাল-খানাখন্দের এপারে-ওপারে লুকিয়ে থাকা মানুষজন ঘরে ফিরে। প্রবাসীরাও স্বাধীন স্বদেশে ফিরতে শুরু করে; ফিরে আসে প্রাবাসী সরকার, ফিরে আসে শরণার্থী শিবিরের আশ্রিত মানুষজন; ফিরে আসেন আহমদ ছফা নিজেও। 

সে এক বিপুল বিজয় আনন্দে বাঙালি জাতি তার জীবন ও যৌবন ফিরে পায়। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের (১৯২০-১৯৭৫) স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের (১০ জানুয়ারি, ১৯৭২) মধ্য দিয়ে সেই বিজয়ানন্দ পরিপূর্ণতা লাভ করে। কিন্তু বিধি বাম। সুখ নামক বস্তুটি চিরস্থায়ী নয়। সুখদুঃখ তো দিন ও রাতের মতোই কাছাকাছি অবস্থান করে, পাশাপাশি অবস্থান করে। 

দেখতে দেখতে জাতির কপালে দুর্ভোগ নেমে আসে। একদিকে কিছু মানুষ তার সহায়সম্পদ হারাতে থাকে বিশেষত সংখ্যালঘুরা। অপরদিকে কিছু মানুষ আঙ্গুল ফুলে কলাগাছ হতে থাকে। চারদিকে চুরি-ডাকাতি-লুটপাট বেড়ে যায়; বেড়ে যায় দুর্নীতি ও জনদুর্ভোগ। এসময় ন্যায় ও সত্য বলার মতো সৎ ও সাহসী কাউকে খুঁজে পাওয়া যায়নি। এই জনদুর্যোগ ও দুর্ভোগে আহমদ ছফা নিদারুণভাবে হতাশ হয়েছিলেন। আরও হতাশ হয়েছিলেন বুদ্ধিজীবী সমাজের রহস্যময় নীরবতা ও নিস্ক্রিয়তায়। এই সময় তিনি তার ঐতিহাসিক দায়িত্ব পালনে এগিয়ে এসেছিলেন, লিখেছিলেন 'বুদ্ধিবৃত্তির নতুন বিন্যাস' (১৯৭২)।

'বুদ্ধিবৃত্তির নতুন বিন্যাস' লেখার পরেও তার অনেক কথাই জমে ছিল। সেই সব কথা বলা ও লেখার জন্য প্রতীক ও সংকেতের প্রয়োজন ছিল, প্রয়োজন ছিল কবিতার। সঙ্গতকারণেই এই সময়ে কবিতার জগতে ডুব দেন তিনি। এই সময়ে হৃদয়ের অন্তহীন বেদনা ফুল হয়ে ফুটে উঠতে থাকে, কবিতা হয়ে ফুটে উঠতে থাকে।

বইটিতে তিনি বুদ্ধিজীবী সমাজের ব্যাপক সমালোচনা করেছিলেন। এবং এই সময় ও রাষ্ট্রের নীতিনৈতিক অবক্ষয়ের জন্য বুদ্ধিজীবী সমাজের নীরবতাকেও তিনি খানিকটা দায়ী করেছিলেন। এজন্য আহমদ ছফাকে কম মূল্য দিতে হয়নি। একজন বুদ্ধিজীবী হয়েও বুদ্ধিজীবী সমাজে তিনি বন্ধুহীন হয়ে পড়েছিলেন। এমনকি আজও বন্ধুহীন-ই রয়ে গেলেন। আদতে প্রকৃত লেখকের বন্ধু থাকে না।

দুই

'বুদ্ধিবৃত্তির নতুন বিন্যাস' বইটি লিখে আহমদ ছফা মূলত ব্যাপক আলোচনা-সমালোচনায় চলে আসেন। এই সময় তার সাহিত্যিক পরিচিতি ব্যাপক বৃদ্ধি পায়। বইটি বুদ্ধিজীবী কিংবা ক্ষমতাবানদের বিপক্ষে গেলেও কোনো বুদ্ধিজীবীর সঙ্গে কিংবা ক্ষমতাবানদের সঙ্গে তার ব্যক্তিগত শত্রুুতা কিংবা দ্বন্দ্ব ছিল না। সেদিন সত্য ও সুন্দরের পক্ষেই কলম ধরেছিলেন তিনি, কথা বলেছিলেন জনমানুষের পক্ষে, ন্যায় ও ন্যায়্যতার পক্ষে। তবু তার নিরাপত্তার ঝুঁকি বেড়ে যায়। সেদিন (১৯৭৫) নিউমার্কেটে পেছন দিক থেকে আহমদ ছফাকে ধাওয়া করার বিষয়টি আমাদের অনেকেরই জানা। তবু সত্য ও সততার পথ থেকে এতোটুকু সরে যাননি আহমদ ছফা। 

'বুদ্ধিবৃত্তির নতুন বিন্যাস' লেখার পরেও তার অনেক কথাই জমে ছিল। সেই সব কথা বলা ও লেখার জন্য প্রতীক ও সংকেতের প্রয়োজন ছিল, প্রয়োজন ছিল কবিতার। সঙ্গতকারণেই এই সময়ে কবিতার জগতে ডুব দেন তিনি। এই সময়ে হৃদয়ের অন্তহীন বেদনা ফুল হয়ে ফুটে উঠতে থাকে, কবিতা হয়ে ফুটে উঠতে থাকে। এ সময় সমসাময়িক সময়, সমাজ ও রাষ্ট্রচিন্তা নিয়ে চমৎকার কিছু কবিতা লিখে ফেলেন তিনি।

এই সব কবিতা 'জল্লাদ সময়' ও 'দুঃখের দিনের দোহা' ইত্যাকার কবিতাগ্রন্থে লিপিবদ্ধ রয়েছে। সমাজ ও রাষ্ট্রের পচনের জন্য 'বুদ্ধিবৃত্তির নতুন বিন্যাস' গ্রন্থে বুদ্ধিজীবী সমাজকে দায়ী করলেও কবিতায় এসে তিনি সময়কেই দায়ী করলেন। সমসাময়িক সময়কে তিনি 'জল্লাদ' নামে অভিহিত করলেন। মূলত প্রান্ত ও পীড়িত মানুষের কাঁধে কাঁধ রেখে জনমানুষের দুঃখদুর্দশা দূর করার মতো একজন জননায়ক প্রত্যাশা করেছিলেন তিনি। কিন্তু সেই নায়ক অধরাই থেকে যায়। কারো কাছে অভিযোগ দাখিল করার মতো জায়গা ছিল না; দুঃখকথা বলার মতো জায়গা অবশিষ্ট ছিল না।

তাই তিনি প্রকৃতির কাছে ফিরে গিয়েছিলেন; লিখেছিলেন 'একটি প্রবীণ বটের কাছে প্রার্থনা'। মূলত প্রবীণ বটবৃক্ষের মতো তিনি জননায়ক দেখতে চেয়েছিলেন; যে নায়ক বটবৃক্ষের ন্যায় দাঁড়িয়ে জনমানুষকে ছায়ায় শীতল করে দেবে। সেই নায়কের দেখা পাওয়া গেল না। কাগজকলমে সামাজিক ও ন্যায় বিচার অর্থে সমাজতন্ত্র বহাল থাকলেও আহমদ ছফার সাধের সমাজতন্ত্র অধরাই থেকে গেল। তাই তিনি লিখলেন- 'লেনিন ঘুমোবে এবার'। 

তিন

আহমদ ছফার যাপিত জীবন ও সাহিত্য সাধনার দিকে তাকালে দেখা যায়, তার অস্থিমজ্জায় মানববাদ ও জাতীয়তাবাদ রক্তমাংসের ন্যায় মিলেমিশে একাকার ছিল। যেখানেই মানববাদ ভুলুণ্ঠিত হয়েছে সেখানেই তিনি হাজির হয়েছেন। যতটুকু সাধ্য ও সামর্থ্য তাই নিয়ে তিনি সিংহসমান বুক নিয়ে নির্ভয়ে দাঁড়িয়ে গিয়েছেন। রক্ষিবাহিনী জাফর ইকবালের পরিবারকে বরাদ্দকৃত বাসা থেকে নামিয়ে দিলে প্রতিবাদে আহমদ ছফা সেদিন কেরোসিন তেল গয়ে ঢেলে আত্মহত্যা করতে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হয়েছিলেন। পরে সিকান্দার আবু জাফরের (১৯১৯-১৯৭৫) মধ্যস্থতায় বিষয়টি সমাধান হয়। জাফর ইকবালের পরিবারকে ঐ বরাদ্দকৃত বাড়িটি ফিরিয়ে দেয়া হয়। এই ঘটনা আমাদের অনেকেরই জানা। আহমদ ছফা কেবল লেখালেখির মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকতেন না। প্রয়োজনে মাঠেও নেমে আসতেন। নিজের জীবনটাও বিলিয়ে দিতে প্রস্তুত থাকতেন। 

চার

বাংলা কথাসাহিত্যও আহমদ ছফা অনন্য। সেখানেও তাকে একই ভূমিকায় তাকে দেখতে পাই। ভাষা আন্দোলন নিয়ে 'ওঙ্কার' (১৯৭৫) লিখলেও মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে উপন্যাস লিখতে তিনি বেশ সময় নিয়েছেন। অবশেষে কলকাতা শরণার্থী জীবনের নানা সংকট ও সম্পর্ক নিয়ে লিখলেন 'অলাতচক্র' (১৯৯৩)। এই দীর্ঘ সময় তিনি প্রস্তুতি নিয়েছেন। নিজের দেখা জীবনের সঙ্গে মিলিয়ে তিনি এই উপন্যাস লিখলেন। প্রবাসী সরকারের নীতি ও নৈতিকতার বিষয়গুলোও এ উপন্যাসে স্পর্শ করলেন। 'মরণবিলাস' (১৯৮৯) উপন্যাসে রাজনৈতিক পচনের মধ্যেও তিনি মনুষত্ব্যের জয়ই দেখিয়েছেন। 

শিক্ষক ও শিক্ষা সমাজের ভদ্রচেহারার অন্তরালে কতিপয় শিক্ষক ও শিক্ষা প্রশাসন যে কতটা অভদ্র ও লোভী প্রকৃতির তা তিনি 'গাভী বিত্তান্ত' (১৯৯৫) উপন্যাসে দেখিয়ে দিলেন। সর্বশেষ 'পুষ্পবৃক্ষ ও বিহঙ্গপুরাণ' (১৯৯৬) উপন্যাসে আমরা আহমদ ছফাকে দেখি, মানুষের সঙ্গে সম্পর্ক তার আরও সুগভীর, আরও ঘনিষ্ঠ হচ্ছে। 

এককভাবে নয়, তিনি সবার মুক্তির কথা ভেবেছেন। তিনি সকলের মধ্যে নিজেকে ছড়িয়ে দিয়েছেন। নিজের মধ্যেও সকলকে ধারণ করেছেন। মহামতি গৌতম বুদ্ধ কিংবা পদাবলির সাহিত্যের কবি চণ্ডীদাসের মতো করে তিনি নিজেও মানুষকে গভীরভাবে আপন করে নিয়েছেন। এই উপন্যাসের শেষের দিকে তিনি লিখছেন- 'সকলে আমার মধ্যে রয়েছে আমি সকলের মধ্যে রয়েছি।' এই উপন্যাসটি পাঠশেষে কবি কামিনী রায় (১৮৬৪-১৯৩৩) লিখিত ঐ কাব্যচরণটির কথা মনে পড়ে- 'সকলের তরে সকলে আমরা / প্রত্যেকে আমরা পরের তরে।' আহমদ ছফা এই 'পরের তরে'র লেখক। কাউকে তিনি পর ভাবতেন না। সবাইকে তিনি আপন করে নিতে পারতেন; আপন করে নিতেন। 

পাঁচ

আহমদ ছফার যাপিত জীবন ও সাহিত্য জগতের দিকে তাকালে দেখব, একটি মহৎ লক্ষ্য নিয়ে তিনি সাহিত্য রচনা করতেন। তিনি মানুষে-মানুষে মানবপ্রীতির এক অনিঃশেষ বন্ধন দেখতে চাইতেন, তিনি চাইতেন তার স্বজাতি, স্বদেশ ও স্বভাষা আন্তজার্তিক পরিম-লে বিচরণ করুক। জ্ঞানসাধনা, বিদ্যাবুদ্ধি, বিবেকবিবেচনা, মনুষ্যত্ববোধ ও অসাম্প্রদায়িক চিন্তাচেতনার মধ্য দিয়ে বাঙালি জাতির মধ্যে তিনি বিপ্লব দেখতে চেয়েছেন, দেখতে চেয়েছিলেন যুগান্তর। এই স্বপ্ন ভেঙ্গে যাওযায় তিনি বারবার আহত হয়েছেন। তাই বলে তিনি ফিরে আসেননি ঐ পথ থেকে। ঐ পথেই তিনি নিজেকে সর্বশেষ পর্যন্ত মেলে দিয়েছেন। ফুল গাছের পরিচর্চা, পাখি পোষা, আহত পাখিকে নিয়ে হাসপাতালে দৌড়ানো কিংবা মৃত্যুবরণ করলে মানুষের মতো দাফন করা- এ সবই তার মায়ার প্রকাশ। 

এইভাবে তিনি এই দেশ ও দেশের মানুষকে, এই সময় ও সমাজের মানুষকে ভালোবাসতেন, তার জীবন ও জনপদকে ভালোবাসতেন। সেই ভালোবাসার কথাই তিনি তার কবিতা, গল্প-উপন্যাস, প্রবন্ধনিবন্ধসহ সাহিত্যের নানা শাখাপ্রশাখায় তুলে ধরেছেন। তাই বলে আহমদ ছফার সাহিত্যকর্মে কেবল বাস্তবতা নয়, বরং কল্পনার প্রাচুর্য্য লক্ষ্য করা। কল্পনা ও বাস্তবতা হাত ধরাধরি করে তার সাহিত্যে তার জীবন ও জনপদের দিকে এগিয়ে যায়। আহমদ ছফার সেই ভালোবাসার কথা, সেই কাব্যকবিতা ও সাহিত্য শিল্পের সাধনা মানুষ ভুলে যায়নি। আজও রাজু ভাস্কর্যে তরুণেরা আহমদ ছফার 'গাভী বিত্তান্ত' নিয়ে মানববন্ধনে দাঁড়িয়ে যায়। লেখকের জন্মদিনে আমার এই নিবেদন।    

Comments