আমাদের সায়ীদ স্যারের জন্মদিনে শ্রদ্ধা-ভালোবাসা

অধ্যাপক আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ

অধ্যাপক আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ, বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের প্রতিষ্ঠাতা হিসেবে তাকে জানতাম। চিনতাম না। চেনার অবকাশ ছিল না। তিনি ঢাকা কলেজে পড়াতেন। আমি পড়েছি সুদূর মফস্বলে।

পত্রিকায় তার লেখা বা বক্তৃতা দেখতাম, পড়তাম। টেলিভিশনে তার কথা শুনেছি। সেটাও তার প্রতি একটা বড় আকর্ষণ। দেশে সামান্য যে কজন মানুষ চিরায়ত আদর্শ আর মূল্যবোধের কথা নিয়ম করে বলেন সায়ীদ স্যার তাদের অন্যতম।

স্যারের কথা শুনে, কিংবা লেখা পড়ে তার প্রতি এক ধরনের মুগ্ধতা কাজ করতো। ততদিনে বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রও দেশের নামী প্রতিষ্ঠান হিসেবে দাঁড়িয়ে গেছে। সেটাও তার প্রতি আকর্ষণের আরেকটি বড় উপলক্ষ।

২০০০ সালের মাঝামাঝি আমি বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রে যোগ দিই। কেন্দ্র ছাড়ি ২০০৬ সালের শেষের দিকে। বলা ভালো সেই সময়টাই আমার জীবনের শ্রেষ্ঠ সময়। জীবনের বড় বাঁক-বদলেরও সময়।

বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রে আমি সায়ীদ স্যারের সঙ্গে যতটা পেরেছি সময় কাটিয়েছি। ঘণ্টার পর ঘণ্টা কেন্দ্রে ও কেন্দ্রের বাইরে সায়ীদ স্যারের সঙ্গে কাটানো সে সময়ে বহুবিধ অভিজ্ঞতা লাভ করেছি। নানা রকমের মানুষের সান্নিধ্য পেয়েছি।

একদিনের কথা মনে আছে। স্যারের জন্য আমরা অপেক্ষা করছি, একটি চিঠি সই করে পাঠাতে হবে সরকারি এক অফিসে। বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের অফিস আওয়ার ছিল দুপুর থেকে রাত অবধি। সায়ীদ স্যার সাধারণত আসতেন সন্ধ্যার দিকে। বাইরে কোনো কাজ না থাকলে মধ্যরাত পর্যন্ত কাটিয়ে যেতেন কেন্দ্রে। অফিসের সব দাপ্তরিক কাজ, পরিকল্পনা, মিটিং ও বাইরের যারা স্যারের সঙ্গে দেখা করতে আসতেন, তাদের সঙ্গে কথা-আড্ডা সবই চলতো এই সময়ের মধ্যে। অনেকটা আধা পেশাদারি, আধা অপেশাদারি কায়দায়।

সায়ীদ স্যার বসতেন কেন্দ্রে দোতলার হাফ রুমটিতে। খোলামেলা এই রুমেই ছিল স্যারের অফিস কাম বসার জায়গা। স্যার আলাদা করে কেন্দ্রে তার জন্য সুনির্দিষ্ট অফিস তখনো চালু করেননি। নিচে আম গাছের কোণায় ছোট যে রুমটিতে আমি বসতাম সেখানেও স্যার দিনের পর দিন তার দাপ্তরিক কাজ চালিয়ে গেছেন। বলা বাহুল্য, বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের আজকের বহুতল ভবন তখনো হয়নি।

তো স্যার আসলেন। স্যারকে চিঠিটা বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের প্যাডে প্রিন্ট করে দেওয়া হলো সই করার জন্য। স্যার তখন চিঠিতে সই করতেন, 'চেয়ারম্যান, বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র' এই পদবি ব্যবহার করে। চিঠিটি সই হলে শাহজাহান ভাই নিয়ে যাবেন। শাহজাহান ভাই ছিলেন মূলত সচিবালয়ে কোনো এক মন্ত্রণালয়ের প্রশাসনিক কর্মকর্তা। বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রে খণ্ডকালীন কাজ করতেন হিসাব বিভাগে।

পরদিন মন্ত্রণালয়ে পাঠাতে হবে চিঠিটি, ফলে সবারই তাড়া ছিল। স্যার চিঠিটি পড়লেন, এবং কিছু কারেকশন দিলেন। প্রিন্ট করে স্যারকে দেওয়া হলে, আবারও কারেকশন দিলেন। পরেরবার বললেন, 'আজ থাক, বাসায় পাঠিয়ে দাও, কালকে দেখবো।'

তখন স্যার কেন্দ্রে আগত এক অতিথির সঙ্গে বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের ভবিষ্যৎ নিয়ে আলোচনায় মগ্ন। স্যারের এই মগ্নতা ছিল আমার জন্য এক নতুন অভিজ্ঞতা। শিশুর মতো সারল্যে গভীরতর আনন্দে সায়ীদ স্যার এই মগ্নতায় ডুবে যেতেন। চিঠিটি পরের দিনও পাঠানো গেল না। স্যারের বারংবার কারেকশনের পরও চিঠিটা চূড়ান্তভাবে সই করা গেল না বলে হিসাব বিভাগের লোকজন উদ্বিগ্ন হয়ে উঠলেন।

আমি গেলাম চিঠিটি সই করানোর জন্য। আমার হাত থেকে চিঠিটি নিয়ে স্যার আবার মনোযোগের সঙ্গে পড়লেন। নতুন নতুন শব্দ যোগ করলেন। এভাবে চলতেই থাকল। একসময় আমি একটু বিরক্ত হয়ে বললাম, 'স্যার একটা চিঠি পাঠাতেই যদি আমরা এতো সময় নেই, তাহলে তো কাজ সব বন্ধ হয়ে যাবে।'

আমার বিরক্তি স্যারের কাছে গোপন থাকল না। স্যার স্বরটা একটু চড়া করেই বললেন, 'চিঠিটা কার স্বাক্ষরে যাবে, তোমার না আমার?' বললাম, 'আপনার!'

তিনি বললেন, 'তাহলে তো একটু দেখেই দেওয়া দরকার, তাই না। এটার সঙ্গে আমার ভাবমূর্তি জড়িত। এই চিঠিতে যদি একটা শব্দও ভুল থাকে, তাহলে সবাই পরিহাস করে বলবে দেখো, এ ভদ্রলোক নাকি আলোকিত মানুষ বানায়! আমার সারা জীবনের সবচেষ্টা এক মুহূর্তে মাটিতে লুটিয়ে পড়বে!'

আমি হতবুদ্ধি হয়ে পড়েছি। কোনো কথাই বললাম না। স্যার সেটা খেয়াল করে চিঠিটা সই করে দিয়ে গলার স্বরটা নামিয়ে একটা মায়াবী কণ্ঠে বললেন, 'দেখো, এটা হচ্ছে পারফেকশনের প্রশ্ন। আমি কোন ছার! রবীন্দ্রনাথের পাণ্ডুলিপি দেখবে, পারফেকশন কাকে বলে? এক লেখা কতবার কাটাকুটি করেছেন!'

সায়ীদ স্যার নিজের কাজের ব্যাপারে বিশেষ করে বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের বিষয়ে এতটাই সজাগ ও সাবধান থাকতেন। তার কোনো কাজের বিষয়ে কেউ যাতে প্রশ্ন তুলে বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের ভাবমূর্তি নিয়ে সংশয় না জাগায় সে বিষয়ে স্যার থাকতেন সদাসতর্ক। আবার কাউকে কোনো কারণে চড়া কথা বলতে হলেও, পরক্ষণেই এমনভাবে মমতা নিয়ে তার সঙ্গে কথা বলতেন যে অপরপক্ষের মনের সব বিষণ্ণতা কেটে যেত। তার আচরণে কেউ রুষ্ট হচ্ছেন বা যিনি কষ্ট পাচ্ছেন তার মনের ভার লাঘবের বিষয়টাকে এতটা কেয়ার করতে খুব কম মানুষকেই দেখেছি।

আরেকদিনের কথা মনে পড়ছে। আমি আর স্যার যাচ্ছি সাভারের দিকে কোন একটা কাজে। গাড়ি চালাচ্ছেন সায়ীদ স্যার নিজেই। স্যারের খুব পুরনো সিলভার কালারের ছোটখাটো একটা টয়োটা গাড়ি ছিল। বহুদিন সেটাই স্যার ব্যবহার করেছেন। গাড়িটি প্রায়ই পথিমধ্যে বন্ধ হয়ে যেত। সহযাত্রীদের সেটা ঠেলতে হতো। কেন্দ্রে একটা কথা চালু ছিল যে, 'কেন্দ্রে স্যারের এই গাড়ি ঠেলেনি কে?'

দেশের অনেক সেলিব্রেটিই, যারা সায়ীদ স্যারের এই গাড়িতে বিভিন্ন সময়ে সফরসঙ্গী হয়েছেন তাদের সবাইকেই এই গাড়ি কোনো না কোনো সময় ঠেলতে হয়েছে। তবে একটা কথা বলা যায়, সায়ীদ স্যার খুব ভালো গাড়ি চালাতেন। প্রায় ৫ দশকের বেশি সময় ধরে তিনি গাড়ি চালিয়েছেন। গাড়ির কলকব্জা কিংবা অটোমোবাইল সম্পর্কে স্যারের ধারণাও ছিল খুব স্পষ্ট। গাড়ির যে কোনো সমস্যা তিনি ধরতে পারতেন সহসাই। এ বিষয়ে গাড়ির মেকানিকদের চাইতেও স্যার ছিলেন এক কাঠি সরেস।

যা হোক, আমি আর স্যার কথা বলতে বলতে চলেছি। গাড়িটি আশুলিয়ার ফ্যান্টাসি কিংডমের কাছাকাছি। রাস্তা বেশ ফাঁকা। হঠাৎ একটা ছাগল এসে গেল গাড়ির সামনে কোনো নোটিশ ছাড়াই। স্যার খুব জোরে ব্রেক কষলেন। দুর্ঘটনা ছাড়াই আমরা থামলাম। ছাগলটাও নির্বিঘ্নে রাস্তা পার হয়ে গেল।

সায়ীদ স্যার গাড়িটা এক পাশে থামালেন। স্টার্ট বন্ধ করে অনেকক্ষণ গাড়ির স্টিয়ারিংয়ে মাথা দিয়ে চোখ বন্ধ করে রাখলেন। মনে হল পুরো ঘটনায় স্যার খুব ডিপ্রেসড। আমি বিষয়টা হালকা করতে বললাম, 'স্যার এত ভাবছেন কেন? এখানে তো আপনার দোষ নাই। কোন দুর্ঘটনাও তো ঘটে নাই।' স্যার একটু মুচকি হাসলেন আমার কথায়। বললেন, 'এ দেশের মানুষকে তো এখনো চেন নাই। কিছু একটা হলে আগামীকাল পত্রিকায় হেডিং দেখতে, 'আলোকিত মানুষ গড়ার কারিগরের হাতে ছাগলের মৃত্যু'! আমার সারাজীবনের সব চেষ্টা এক লহমায় ধূলিসাৎ হয়ে যেত!!'

একদিন বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রে সায়ীদ স্যারের সঙ্গে নানা বিষয় নিয়ে কথা হচ্ছে। আমার তখন নিন্দা-প্রবণতার ঝোঁক প্রবল। সবকিছুকেই দেখি রাজনীতির উত্তেজনায়। শুধু আমার কেন চারপাশে তখন সেটাই চলনসই হাওয়া। সবাইকে তুচ্ছ করে খারিজ করে দেওয়ার বাসনা। আমি সেই ঢংয়ে নানা সমালোচনা তুলে অধ্যাপক কবীর চৌধুরীর নিন্দামন্দ করছি। তাকে বুদ্ধিজীবী হিসেবে অতিপ্রশংস দৃষ্টিতে দেখা হয়, সেটা ছিল আমার অভিযোগ। অনুযোগের সুরেই কথাটা তুললাম। স্যার মনোযোগ সহকারে শুনলেন।

তারপর বললেন, 'একজন মানুষ নানা কারণেই তোমার অপছন্দ হতেই পারেন। তার অনেক কাজ বা চিন্তার সঙ্গে তোমার ভাবনার অমিল থাকতেই পারে। কিন্তু, তাই বলে একজন মানুষের সারাজীবনের সাধনাকে তুড়ি মেরে খারিজ করে দেবে! এই যে কবীর চৌধুরী স্যার বছরের পর বছর ধরে প্রতিদিন টেবিলে আট-নয় ঘণ্টা করে বসে বিদেশি সাহিত্য অনুবাদের কাজ করে গেলেন সেটার কী কোনো মূল্য নেই?'

'আমাদের এখানে বিদেশি লেখকদের চিরায়ত নানাবিধ লেখার অনুবাদ কাজে কবীর চৌধুরী স্যার যে ভূমিকা রেখে গেলেন সেটা কি খুবই নগণ্য বলে মনে হয়, তোমার! এভাবে মানুষকে দেখতে হয় না। খারাপ-ভালো মিশিয়েই মানুষ। নিজের শরীরের দিকে তাকিয়ে দেখ। মানুষের মুখ, অবয়ব কত সুন্দর। অথচ এই মানুষই শরীরে মল-মূত্র-বর্জ্য বহন করছে নিত্য। কাজেই তোমার বিবেচনায় একজন মানুষের কিছু দোষের জন্য মানুষটির সব ভালো গুণ অগ্রাহ্য বিবেচনা কোনো ন্যায়সঙ্গত বিচার হতে পারে না।'

সায়ীদ স্যারের এই কথাটি আমাকে খুব নাড়া দিয়েছিল। তারপর থেকে স্যারের মানুষ-বিচারের এই তরিকায় আমি খুবই প্রভাবিত হয়েছি।

সায়ীদ স্যার শিশুর মতো সারল্য নিয়ে মানুষের গুণের কদর করেছেন। মানুষের গুণ ও শক্তির প্রতি স্যারের একটা অসম্ভব প্রিয়তা আছে।

স্যারের সঙ্গে তার কাজ নিয়ে ভিন্ন মত পোষণ করে তারই সামনে বসে তার বহু স্নেহভাজনকে ঘণ্টার পর ঘণ্টা বিতর্ক চালিয়ে যেতে দেখেছি। একজন সত্যিকার উদার হৃদয়ের মানুষের মতো তিনি বহু ক্ষেত্রেই সহিষ্ণুতা দেখিয়েছেন।

সবচেয়ে বড় কথা সায়ীদ স্যার কখনো হতাশার চাষবাস করেন নাই। আশায় তার বসতি, মানুষের শক্তিতেই তার আস্থা। মানুষপ্রেমী, মানুষভজা সায়ীদ স্যারের জন্মদিনে তার জন্য ভালোবাসা ও শ্রদ্ধা।

শুভ কিবরিয়া: সিনিয়র সাংবাদিক, বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের সাবেক সমন্বয়কারী

kibria34@gmail.com

Comments

The Daily Star  | English
compensation for uprising martyrs families

Each martyr family to get Tk 30 lakh: Prof Yunus

Vows to rehabilitate them; govt to bear all expenses of uprising injured

3h ago