রাশিয়া জার্মানিতে স্থায়ীভাবে গ্যাস সরবরাহ বন্ধ করলে যা ঘটবে ইউরোপে
বার্ষিক সংস্কার কাজ শুরু হওয়ায় রাশিয়া থেকে জার্মানিতে গ্যাস সরবরাহের সবচেয়ে বড় পাইপলাইন নর্ড স্ট্রিম-১-এর মাধ্যমে গ্যাস সরবরাহ বন্ধ রাখা হয়েছে।
এ বিষয়ে মস্কো জানিয়েছে, আগামী ১০ দিন এ পাইপলাইনের মাধ্যমে গ্যাস সরবরাহ বন্ধ থাকবে।
তবে, বার্তাসংস্থা রয়টার্সের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ইউক্রেন যুদ্ধ ও নিষেধাজ্ঞার জেরে গ্যাস বন্ধের সময়সীমা আরও বাড়তে পারে বলে আশঙ্কা করছে জার্মানিসহ ইউরোপের অন্যান্য দেশগুলো। এমনকি রাশিয়া জার্মানিতে গ্যাস সরবরাহ একেবারে বন্ধ করে দিতে পারে—এমন আশঙ্কাও আছে।
ফলে বিশ্বের চতুর্থ অর্থনীতির দেশ জার্মানির পাশাপাশি ইউরোপের অন্যান্য দেশগুলোও সব ধরনের সম্ভাব্য পরিস্থিতি মাথায় রেখে প্রস্তুতি নিচ্ছে।
এর কারণ হিসেবে মনে করা হচ্ছে, যদি এ গ্যাসলাইনটির মাধ্যমে স্থায়ীভাবে জার্মানিতে গ্যাস সরবরাহ বন্ধ হয়ে যায়, তাহলে শুধু জার্মানিই নয়, বড় ধরনের বিপাকে পড়বে ইউরোপের বেশ কিছু দেশ।
গ্যাসের অভাবে যা ঘটতে পারে ইউরোপে
নর্ড সিট্রম-১ পাইপলাইন শুধু জার্মানিরই নয়, ইউরোপের বৃহত্তম একক গ্যাস আমদানির পরিকাঠামো। বাল্টিক সাগরের নিচ দিয়ে নর্ড স্ট্রিম-১ পাইপলাইনের মাধ্যমে রাশিয়া থেকে বছরে ৫৫ বিলিয়ন ঘনমিটার (বিসিএম) গ্যাস সরবরাহ করা হয় জার্মানিতে।
রাশিয়া থেকে গ্যাসের প্রবাহ বন্ধ হয়ে গেলে জার্মানির অর্থনীতিতে মন্দা দেখা দিতে পারে।
বাভারিয়া রাজ্যের ভিবিডব্লিউ ইন্ডাস্ট্রি অ্যাসোসিয়েশন থেকে পাওয়া তথ্য মতে, গ্যাস পাওয়া না গেলে বছরের দ্বিতীয়ার্ধে জার্মানির অর্থনীতিতে ১৯৫ বিলিয়ন ডলারের (১৯৩ বিলিয়ন ইউরো) সমপরিমাণ ক্ষতি হতে পারে।
ভিবিডব্লিউ'র ব্যবস্থাপনা পরিচালক বারট্রাম ব্রোসার্ত জানান, রাশিয়া থেকে গ্যাস আমদানি বন্ধ হয়ে গেলে জার্মানির ৫৬ লাখ মানুষ রাতারাতি চাকরি হারাতে পারেন। দেশটির রাসায়নিক, ইস্পাত, কাঁচ ও কাগজ শিল্পে তো বটেই, খাদ্য বা চীনামাটির বাসন উৎপাদন শিল্পেও এর প্রভাব পড়বে।
ইউরোপের দেশগুলো জানিয়েছে, রাশিয়া এই পাইপলাইন রক্ষণাবেক্ষণের সময়সীমা বাড়ালে জার্মানির পাশাপাশি ইউরোপের গ্যাস সরবরাহ আরও বিপর্যস্ত হয়ে পড়বে। এ ধরনের ঘটনা ঘটলে ইউরোপে আসন্ন শীত মৌসুমে বিভিন্ন পরিকল্পনায় বিঘ্ন ঘটবে এবং চলমান গ্যাস সংকট আরও বাড়বে। ফলে বিভিন্ন দেশের সরকারকে দাম বাড়ানোসহ অন্যান্য উদ্যোগ নিতে হবে এবং এর নেতিবাচক প্রভাব পড়বে গ্রাহকদের ওপর। বিশেষ করে শীত মৌসুমটা সামাল দেওয়া চ্যালেঞ্জিং হয়ে পড়বে।
রাশিয়া থেকে ইউরোপের অন্যান্য দেশে গ্যাস পাঠানোর জন্য এরচেয়ে বড় কিছু পাইপলাইন থাকলেও সেগুলোতেও ধারাবাহিকভাবে গ্যাসের প্রবাহ কমছে।
রুবলে গ্যাসের দাম পরিশোধের দাবি না মানায় রাশিয়া বেশ কয়েকটি ইউরোপীয় দেশে গ্যাসের প্রবাহ পুরোপুরি বন্ধ করে দিয়েছে। ফলে ইউরোপে বেড়ে গেছে গ্যাসের দাম।
রুশ গ্যাসের প্রবাহ থমকে গেলে সার্বিকভাবে ইউরোপে গ্যাসের দাম আরও বেড়ে যাবে, যা ইতোমধ্যে শিল্পপ্রতিষ্ঠান ও ব্যক্তিগত ব্যবহারের ক্ষেত্রে সমস্যা সৃষ্টি করেছে। ইউরোপের মানদণ্ড হোলসেল ডাচ গ্যাস প্রাইস গত বছরের জুলাইর তুলনায় ৪০০ শতাংশ বেড়েছে।
নেদারল্যান্ডের জ্বালানি বিষয়ক মন্ত্রী রব ইয়েত্তেন বলেছেন, নর্ড স্ট্রিমের গ্যাস সরবরাহ বন্ধ হয়ে গেলে এর প্রভাব পড়বে পুরো উত্তর-পশ্চিম ইউরোপজুড়ে।
সিএনবিসির প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ইউরোপীয় ইউনিয়নভুক্ত দেশগুলোতে প্রায় ৪০ শতাংশ গ্যাস রুশ পাইপলাইনের মাধ্যমে সরবরাহ করা হয়। ফলে গ্যাস বন্ধ হওয়ার আশঙ্কা থেকে ইতোমধ্যে রুশ গ্যাসের ওপর নির্ভরশীলতা কমানোর বিকল্প উপায় খুঁজতে শুরু করেছে ইইউ।
'জার্মানির মতো একই পরিস্থিতি পড়বে ইউরোপের বাকি অংশ'
ইউরেশিয়া গ্রুপের জ্বালানী, জলবায়ু ও সম্পদ বিষয়ক পরিচালক হেনিং গ্লোইস্টাইন সিএনবিসিকে বলেছেন, 'এ ধরনের পদক্ষেপ একটি 'সর্বোচ্চ অর্থনৈতিক যুদ্ধ' পরিস্থিতির প্রতিনিধিত্ব করবে।'
তার কারণ, গ্যাস সংকট নিয়ে বর্তমানে জার্মানিতে যে পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে তা ইউরোপীয় ইউনিয়নের জন্য গুরুত্বপূর্ণ।
গ্লোইস্টেইন বলেছেন, 'জার্মানি সমগ্র ইউরোপীয় ইউনিয়নের জন্য একটি হটস্পট হয়ে উঠেছে। জার্মানি ইউরোপের বৃহত্তম জনসংখ্যা, অর্থনীতি এবং গ্যাস ব্যবহারকারী দেশ।
তা ছাড়া দেশটি রাশিয়ান গ্যাসের একক আমদানিকারক হিসেবে অন্যতম এবং ৯টি স্থল সীমান্ত থাকার কারণে জার্মানিতে যা ঘটবে, ইউরোপের বাকি অংশেও তা ছড়িয়ে পড়বে।'
সিএনবিসি জানিয়েছে, এত কিছুর মধ্যে ইউরোপের জন্য একটি ভালো খবর হচ্ছে, ইইউর গ্যাস ট্যাঙ্কগুলো এখন প্রায় ৬০ শতাংশ পূর্ণ। সেখানে প্রায় ৬০ বিসিএম গ্যাস সঞ্চিত আছে, যা এক বছর আগের চেয়ে বেশি।
তবে, ইউরোপের সবগুলো দেশ সমানভাবে গ্যাস মজুত করতে পারেনি। বুলগেরিয়া, রোমানিয়া ও হাঙ্গেরির মতো দেশগুলোতে গ্যাস মজুদ আছে ৫০ শতাংশ বা তারও নিচে। সামনের শীতে অস্বাভাবিক ঠান্ডায় বেশ বিপদের মুখে পড়বে এসব দেশ।
Comments