গ্যাস সংকটে চরম দুর্ভোগ

প্রতীকী ছবি | সংগৃহীত

গত ২৯ মে কক্সবাজারের এলএনজি রিগ্যাসিফিকেশন টার্মিনাল বন্ধ হয়ে যাওয়ার পর সরবরাহ কমে যাওয়ায় দুই সপ্তাহ ধরে চলা গ্যাস সংকটের প্রভাব পড়েছে বাড়িঘর, কারখানা ও যানবাহন খাতে।

রাজধানীর অনেক এলাকার মানুষ বাসায় রান্না করতে হিমশিম খাচ্ছেন। গ্যাসের চাপ কমে যাওয়ায় কিছু কারখানা বন্ধ হয়ে গেছে। রাজধানীর প্রায় সব সিএনজি ফিলিং স্টেশনে যানবাহনের দীর্ঘ সারি দেখা গেছে।

অনেক কেন্দ্র বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য গ্যাস ব্যবহার করায় গ্রামীণ অঞ্চলে বিদ্যুৎ সরবরাহের পরিস্থিতিরও অবনতি হয়েছে।

সরকার এবারের গ্রীষ্মে দৈনিক ১৭ হাজার ৮০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদনের পরিকল্পনা করলেও এখন পর্যন্ত তারা সর্বোচ্চ উৎপাদন করতে পেরেছে গত ৩০ এপ্রিল ১৬ হাজার ৪৭৭ মেগাওয়াট।

বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের তথ্য অনুযায়ী, এপ্রিল-মে সময়ে গড় উৎপাদন ছিল ১৩ থেকে ১৫ হাজার মেগাওয়াট।

ডলার সংকটের কারণে জ্বালানি তেলের ঘাটতিকে এই উৎপাদনের এর জন্য দায়ী করেছেন সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা।

পল্লী এলাকায় বিদ্যুৎ সরবরাহের দায়িত্বে থাকা বাংলাদেশ পল্লী বিদ্যুতায়ন বোর্ডকে (আরইবি) গত ২৭ মে থেকে প্রতিদিন এক হাজার ১০০ মেগাওয়াট পর্যন্ত লোডশেডিং করতে হয়েছে। সবচেয়ে বেশি বিদ্যুৎ বিচ্ছিন্ন হয়েছে ময়মনসিংহ, টাঙ্গাইল, ঢাকা, নারায়ণগঞ্জ, নরসিংদী ও নোয়াখালী।

গত ২৭ মে ঘূর্ণিঝড় রিমালের সময় কক্সবাজারের মহেশখালীতে এলএনজি রিগ্যাসিফিকেশন ইউনিট ক্ষতিগ্রস্ত হয়। ৫ জুন এক বিবৃতিতে সামিট জানায়, সামিট গ্রুপ পরিচালিত ইউনিটটি মেরামতের জন্য গত সপ্তাহে বিদেশের একটি ড্রাই ডকে নিয়ে যাওয়া হয়।

আগামী তিন সপ্তাহের মধ্যে এলএনজি টার্মিনালটি চালু করা হবে বলে আশা করা হচ্ছে।

দৈনিক এক হাজার ১০০ মিলিয়ন ঘনফুট (এমএমসিএফডি) গ্যাস প্রক্রিয়াজাতকরণের সক্ষমতা সম্পন্ন দুটি ফ্লোটিং স্টোরেজ রিগ্যাসিফিকেশন ইউনিট (এফএসআরইউ) থেকে দেশে এলএনজি আসে। একটি বন্ধ হওয়ায় সরবরাহ কমে দাঁড়িয়েছে ৬০০ এমএমসিএফডিতে।

পেট্রোবাংলা বর্তমানে তিন হাজার ৮০০ এমএমসিএফডি চাহিদার বিপরীতে প্রায় দুই হাজার ৬০০ এমএমসিএফডি সরবরাহ করতে পারছে।

জানুয়ারির তথ্য অনুযায়ী, ২০১৬ সালে দেশের স্থানীয় গ্যাস উৎপাদন বার্ষিক গড় দুই হাজার ৪৪৮ এমএমসিএফডি থেকে কমে দুই হাজার ৩৯ এমএমসিএফডিতে নেমে এসেছে।

সিঙ্গাপুরে আড়াই মাস রক্ষণাবেক্ষণের পর এপ্রিলের মাঝামাঝি সময়ে সামিটের এফএসআরইউ পুনরায় কার্যক্রম শুরু করে। ওই সময়েও দেশে গ্যাস সরবরাহ পরিস্থিতি একই রকম ছিল এবং জনগণকে গ্যাস সংকটে ভুগতে হয়েছিল।

রাজধানীর পূর্ব শেওড়াপাড়ার কলেজ শিক্ষার্থী সাবাকাত সাবরি জানান, প্রায় এক সপ্তাহ ধরে তারা তীব্র গ্যাস সংকটে ভুগছেন।

দ্য ডেইলি স্টারকে তিনি বলেন, 'আমরা এখানে ১৫ বছর ধরে বসবাস করছি, কিন্তু গ্যাস সরবরাহের এত খারাপ পরিস্থিতি আগে কখনো দেখিনি।'

সাবরি আরও বলেন, সকালে গ্যাস প্রায় থাকে না বললেই চলে। আমার পরিবারের কেউ কাজে যাওয়ার আগে বাসায় নাশতা করতে পারে না। দুপুরের পরেও গ্যাসের চাপ বাড়ে না। এজন্য আমরা দুপুরের খাবারও দেরি করে খাই।'

রোববার থেকে তারা বৈদ্যুতিক চুলা ব্যবহার শুরু করেছেন বলে জানান তিনি।

গত কয়েকদিনে রাজধানীর পাঁচটি সিএনজি ফিলিং স্টেশন ঘুরে এই প্রতিবেদক দেখতে পান, গাড়ি ও সিএনজিচালিত অটোরিকশার দীর্ঘ সারি।

শনিবার মধ্যরাতে মগবাজারের অনুদীপ সিএনজি ও এলপিজি ফিলিং স্টেশনে যানবাহনের দীর্ঘ সারি দেখা যায়।

অটোরিকশাচালক হোসেন মিয়া গতকাল দুপুরে সাতরাস্তা এলাকার একটি ফিলিং স্টেশনের সামনে দেড় ঘণ্টা ধরে অপেক্ষা করছিলেন। গত কয়েকদিন ধরেই গ্যাস নিতে তার অন্তত দুই ঘণ্টা সময় লেগেছে।

'দিন হোক বা রাত, সময় বেশি লাগছে। গ্যাসের চাপ কম থাকায় সিএনজি সিলিন্ডার ভর্তিও করা যাচ্ছে না। সেজন্য চালকদের স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি ফিলিং স্টেশনে যেতে হচ্ছে', বলেন হোসেন।

বাংলাদেশ সিএনজি ফিলিং স্টেশন অ্যান্ড কনভার্সন ওয়ার্কশপ ওনার্স অ্যাসোসিয়েশনের সেক্রেটারি ফারহান নূর বলেন, গ্যাসের স্বাভাবিক চাপ প্রতি বর্গ ইঞ্চিতে (পিএসআই) ১৫ পাউন্ড থাকার কথা থাকলেও এখন দিনের বেশিরভাগ সময় তা দুই থেকে তিন পিএসআই থাকে।

গ্যাস সরবরাহ নির্বিঘ্ন করার দাবিতে শনিবার ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কে বিক্ষোভ করেছেন নারায়ণগঞ্জের সিদ্ধিরগঞ্জবাসী।

এর আগে গত ৫ জুন নারায়ণগঞ্জ, নরসিংদী, গাজীপুর, মাওনা, সাভার, আশুলিয়া, টঙ্গী, শ্রীপুরসহ বিভিন্ন শিল্প এলাকায় গ্যাস সরবরাহ বাড়ানোর দাবিতে পেট্রোবাংলার চেয়ারম্যানকে চিঠি দেন বাংলাদেশ টেক্সটাইল মিলস অ্যাসোসিয়েশনের (বিটিএমএ) সভাপতি মোহাম্মদ আলী খোকন।

গতকাল দ্য ডেইলি স্টারের সঙ্গে আলাপকালে তিনি বলেন, পরিস্থিতির কোনো উন্নতি হয়নি।

'শত শত কারখানায় গ্যাস না থাকায় উৎপাদন ব্যাহত হয়ে লোকসান হচ্ছে', বলেন তিনি।

নারায়ণগঞ্জের ফতুল্লার এমবি নিট ফ্যাশন লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোহাম্মদ হাতেম জানান, গত সপ্তাহে চারদিন তাদের উৎপাদন বন্ধ ছিল।

সাভারের উলাইল এলাকায় গ্যাসের অভাবে গত ১ জুন থেকে বন্ধ রয়েছে মধুমতি টাইলস লিমিটেড।

কারখানার মহাব্যবস্থাপক (অ্যাকাউন্টস অ্যান্ড ফিন্যান্স) মো. সেলিম খলিফা বলেন, 'গত দেড় বছর ধরে আমাদের এখানে গ্যাসের চাপ ছিল তিন থেকে পাঁচ পিএসআই গ্যাস পাচ্ছিলাম। কিন্তু চলতি মাসের শুরু থেকে তা কমে দাঁড়িয়েছে শূন্য দশমিক পাঁচ পিএসআইতে। ৪০০ শ্রমিককে ছুটিতে পাঠানো ছাড়া আমাদের আর কোনো উপায় ছিল না।'

তিতাস গ্যাস ট্রান্সমিশন অ্যান্ড ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি লিমিটেডের সাভার জোনাল অফিসের ব্যবস্থাপক আবু সালেহ মোহাম্মদ খাদেমউদ্দিন বলেন, 'আমাদের সোর্স সাপ্লাই লাইনে চাপ ৫০ পিএসআই থাকার কথা থাকলেও এখন তা ২০ পিএসআইয়ের আশপাশে।'

এ বিষয়ে পেট্রোবাংলার চেয়ারম্যান জনেন্দ্র নাথ সরকার ও তিতাস গ্যাসের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. হারুনুর রশীদ মোল্লাহ্‌র সঙ্গে যোগাযোগ করা সম্ভব হয়নি। গতকাল তাদের ফোন করলেও তারা ধরেননি।

এ মাসে গ্যাস সরবরাহ বাড়বে না বলে জানিয়েছেন নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক পেট্রোবাংলার এক কর্মকর্তা।

কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) জ্বালানি উপদেষ্টা অধ্যাপক এম শামসুল আলম বলেন, প্রাকৃতিক দুর্যোগে ভাসমান টার্মিনাল থেকে গ্যাস সরবরাহ বিঘ্নিত হবে বলে আশঙ্কা করা হয়েছিল।

তিনি বলেন, এ ধরনের ঝুঁকিপূর্ণ অবকাঠামো জ্বালানি নিরাপত্তার জন্য উপযোগী নয়। এলএনজি রিগ্যাসিফিকেশন ইউনিট যখন উৎপাদন বন্ধ করে দেয়, তখন এর কোনো বিকল্প থাকে না।

স্থানীয় গ্যাস অনুসন্ধানের চেয়ে আমদানি করা এলএনজির ওপর সরকারের নির্ভরতার বিষয়টি স্পষ্ট উল্লেখ করে তিনি বলেন, সরকার তিন বছরে ৪৮টি গ্যাসকূপ অনুসন্ধানের পরিকল্পনা ঘোষণা করেছে। তবে প্রস্তাবিত বাজেটে এ পরিকল্পনার কোনো প্রতিফলন নেই।

'এমনকি সরকার গ্যাস উন্নয়ন তহবিলের বরাদ্দও গ্যাস অনুসন্ধানের জন্য ব্যয় করতে ব্যর্থ হয়েছে', বলেন অধ্যাপক এম শামসুল আলম।

(প্রতিবেদনটি তৈরিতে দ্য ডেইলি স্টারের সাভার সংবাদদাতাও তথ্য দিয়েছেন)

Comments

The Daily Star  | English
Awami League corruption Bangladesh

The trials and tribulations of preparing the white paper

After three months of rigorous work, a white paper panel on the state of the economy revealed all the fault lines that had formed across Bangladesh during the 15 years of rule under the Awami League government, which held power from 2009 until it was ousted by a mass uprising on August 5 this year.

14h ago