মূল্যবোধ তাড়িয়ে অবক্ষয় আমদানি

রাজনৈতিকভাবে এলাকার সবচেয়ে ক্ষমতাবান বা বিত্তবান মানুষ ছিলেন না, তবে সবচেয়ে সম্মানিত ও শ্রদ্ধার মানুষ ছিলেন। বলছি শিক্ষকের কথা। উচ্চ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষক নন, তারা ছিলেন মূলত প্রাথমিক ও উচ্চ বিদ্যালয়ের শিক্ষক। তাদের বড় অংশটি ছিল হিন্দু সম্প্রদায়ের মানুষ। তাদের অনেকে ছিলেন ঋষিতুল্য। ধর্ম পালনের মতো করে তারা শিক্ষাদান করতেন। মননে-মগজে ছিলেন রুচিশীল, মার্জিত ও আধুনিক মানুষ। ধর্ম-বর্ণ, জাত-পাতের বহু ঊর্ধ্বের মানুষ ছিলেন।

শিক্ষার্থীরা যতটা তাদের ভয় পেতেন, তারচেয়ে অনেক গুণ বেশি সম্মান-শ্রদ্ধা করতেন, ভালোবাসতেন। বছর ত্রিশেক আগের বাংলাদেশেও তারা ছিলেন। বাংলাদেশের মধ্য বয়সী নাগরিকদের প্রায় সবাই তাদের থেকে শিক্ষা নিয়েছেন। শিক্ষার্থীদের অসীম শ্রদ্ধার শিক্ষক ছিলেন তারা। শিক্ষার্থীদের তারা শাসন করতেন, বেতের ব্যবহারও করতেন। শিক্ষার্থীরা বেতের ভয়ে ভীত থাকতেন, শিক্ষকের প্রতি কোনো অশ্রদ্ধা ধারণ করতেন না।

শাসনের সমান্তরালে স্নেহ-ভালোবাসায় তারা আপন করে নিতেন শিক্ষার্থীদের। নিজের সন্তানের মতো শিক্ষার্থীদের আগলে রাখতেন। শ্রদ্ধা-স্নেহের এক মধুর সম্পর্ক ছিল। শিক্ষার্থীদের অভিভাবকদেরও সমান শ্রদ্ধার মানুষ ছিলেন শিক্ষকেরা। ছাত্র-শিক্ষক-অভিভাবকের সম্পর্কের একটা মানদণ্ড সমাজে দৃশ্যমান ছিল।

 

স্বাধীন বাংলাদেশে পর্যায়ক্রমে দিন বদলে গেছে। ভুল পথের রাজনীতি তাদের জন্যে প্রতিকূল পরিবেশ তৈরি করেছে। পরিণতিতে পর্যায়ক্রমে তারা দেশ ছেড়ে চলে যেতে বাধ্য হয়েছেন। ঋষিতুল্য এসব শিক্ষকের শূন্যস্থান পূরণ হয়নি। ছাত্র-শিক্ষক সম্পর্কের ভঙ্গুরতা তথা আজকে বাংলাদেশের শিক্ষাব্যবস্থায় যে নৈরাজ্য, তার একটা বড় কারণ এমন শিক্ষকের শূন্যতা।

সমাজের প্রতিষ্ঠিত সত্য ছিল এমন যে, প্রশ্নহীনভাবে শিক্ষকরা থাকবেন সম্মানের আসনে। আমরা বলি যে সমাজ বদলে গেছে। কেন বদলে গেছে, কীভাবে বদলে গেছে, তার গ্রহণযোগ্য ব্যাখ্যা বা গবেষণা আমাদের সামনে নেই। একটি সমাজে ধারা বা রীতির মানদণ্ড নির্ধারণে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে মধ্যবিত্ত শ্রেণি।

এদেশে অধিকার আদায়ের আন্দোলন, শিক্ষা সবক্ষেত্রে সব সময় নেতৃত্ব দিয়েছে মধ্যবিত্ত। মধ্যবিত্তের যে মূল্যবোধ, সেই মানদণ্ডেই শিক্ষক-শিক্ষার্থীর স্নেহ-শ্রদ্ধার সম্পর্ক তৈরি হয়েছিল। মধ্যবিত্তের এই মূল্যবোধের পেছনে ছিল রাজনীতি। যে রাজনীতি নিয়ন্ত্রণের ক্ষমতা ছিল মধ্যবিত্তের হাতে। রাজনীতির সঙ্গে অঙ্গাঙ্গীভাবে সম্পৃক্ত ছিল সংস্কৃতি। সেই সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের নেতৃত্বও ছিল মধ্যবিত্তের হাতে। শিক্ষাদানের পাশাপাশি সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড সরাসরি বা প্রত্যক্ষভাবে পরিচালনা করতেন শিক্ষকরা। মধ্যবিত্তর প্রশ্নহীন আনুগত্য বা সম্মান-শ্রদ্ধার আসনে থাকতেন শিক্ষকরা। মধ্যবিত্ত অভিভাবকের এই রীতিই ধারণ করতেন শিক্ষার্থীরা।

স্বাধীন বাংলাদেশে পর্যায়ক্রমে রাজনীতির পরিবর্তন হয়েছে। রাজনীতি থেকে সততা ক্রমে নির্বাসিত হয়েছে। মধ্যবিত্তের নেতৃত্বদানকারীদের বড় একটি অংশ অসৎ রাজনীতির পেছনে হাঁটতে শুরু করেছে। আদর্শভিত্তিক যে বামধারার রাজনীতি-সংস্কৃতির চর্চা প্রতিটি আঞ্চলিক শহরে ছিল, তাও পর্যায়ক্রমে দুর্বল হয়েছে। বামধারার রাজনীতিক-সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্বরা ভোটের রাজনীতিতে প্রভাবশালী ছিলেন না। তবে মধ্যবিত্তর রুচি-মূল্যবোধ নির্মাণে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতেন। তারা যাপিত জীবনে সততা-মূল্যবোধ ধারণ করতেন। ফলে মধ্যবিত্তের কাছে তারা ছিলেন অনুকরণীয়-অনুস্মরণীয়। 
বামধারার সেই চিন্তা প্রায় বিলুপ্ত হয়ে গেছে। ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠান ও সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের সহাবস্থান ছিল। এখন ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠানের আধিক্য বেড়েছে, বাড়ানো হয়েছে। সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের জন্যে প্রতিকূল পরিবেশ তৈরি করা হয়েছে।

সেই অনুকরণীয় ব্যক্তিত্বদের অনেকে হতাশায় ডুবে গেছেন। অনেকের চারিত্রিক স্খলন ঘটেছে। ফলে সমাজ বিনির্মাণের কারিগর মধ্যবিত্ত হয়ে পড়েছে বিভ্রান্ত। মধ্যবিত্তের যে নেতৃত্বদানকারী শ্রেণি, তারা অসৎ রাজনীতির পথ ধরে আর্থিকভাবে শ্রেণি উত্তরণ ঘটিয়েছেন। মধ্যবিত্তের যে চিরন্তন মূল্যবোধ, তা আর তারা ধারণ করেন না। কিন্তু মধ্যবিত্ত শ্রেণির নেতৃত্ব থেকে গেছে তাদের হাতেই।

আজকে যখন সমাজের অসঙ্গতি নিয়ে কথা হয়, তখনো সেই কথা বলেন মধ্যবিত্ত শ্রেণির এই নেতৃত্বদানকারীরা। তারা বলেন, সমাজ থেকে মূল্যবোধ হারিয়ে গেছে, সমাজে অবক্ষয় দেখা দিয়েছে। তারা 'মূল্যবোধ' ও 'অবক্ষয়' শব্দ দুটিকে বায়বীয় শব্দে পরিণত করেছেন। এই মূল্যবোধ চলে যায়নি, তাকে যে তাড়িয়ে দেওয়া হয়েছে, একথা বলার লোক নেই সমাজে। অবক্ষয় নেমে আসেনি, অবক্ষয় যে আমদানি করা হয়েছে, সে কথাও আমরা বলি না।

রাজনীতির পথ ধরে শ্রেণিচ্যুত মধ্যবিত্ত নেতৃত্বকে প্রশ্ন করার কোনো প্ল্যাটফর্ম গড়ে ওঠেনি। সুবিধাবাদী রাজনীতি মধ্যবিত্তের নেতৃত্বদানকারী শ্রেণিকে সঙ্গে নিয়ে মূলধারার শিক্ষাব্যবস্থাটাকে প্রায় ধ্বংস করে দিয়েছে। সাম্প্রতিককালে চতুর রাজনৈতিক নেতৃত্ব শিক্ষা পরিচালনার নেতৃত্ব তুলে দিয়েছিলেন একদা আদর্শভিত্তিক রাজনীতির চেনা মুখের হাতে। তাকে নেতৃত্বের আসনে বসিয়ে অসততার সুযোগ করে দিয়েছেন। তাকে দিয়ে শিক্ষার সবচেয়ে বড় ক্ষতিকর কাজগুলো করানো হয়েছে। শিক্ষকদের অলিখিত নির্দেশ দিয়ে শিক্ষার হার বাড়ানোর জন্যে ফেল করা শিক্ষার্থীকে পাস করানো হয়েছে। প্রশ্ন ফাঁস ও তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা না নিয়ে অস্বীকার করার রীতি চালু করা হয়েছে। উচ্চ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষকদের সামনে পদ-পদবির মুলা ঝুলিয়ে দেওয়া হয়েছে। তারা শিক্ষক-বুদ্ধিজীবী পরিচয়ে অনবরত অসত্য বলেন। দৃশ্যমানভাবেই তারা মূল্যবোধহীন অবক্ষয়ে নিমজ্জিত।

আজকে সমাজে শিক্ষক নিগৃহীত, রাজনীতিক শিক্ষককে কান ধরে ওঠবস করায়, পুলিশের উপস্থিতিতে শিক্ষকের গলায় জুতার মালা পরায়, শিক্ষার্থী শিক্ষকের গায়ে হাত দেয়-হত্যা করে, এর কোনোকিছুই সমাজের বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়। আমরা যে সমাজ তৈরি করেছি, এসব তার অনিবার্য ফলাফল। টোটকা চিকিৎসায় এর কোনো সমাধান নেই।

ছাত্র-শিক্ষক সম্পর্ক কেন এমন হলো? কেন ছাত্র শিক্ষককে শ্রদ্ধা করে না? কেন ছাত্র শিক্ষককে হত্যা করে? এসব প্রশ্নের বিচ্ছিন্ন বা সহজ-সরল উত্তরে এর সমাধান নেই। এডহক-ভিত্তিক কোনো সমাধান নেই। একদিনে এই পরিবেশ তৈরি হয়নি। বছরের পর বছর ধরে তৈরি করা হয়েছে। আন্তরিকভাবে উত্তরণ চাইলে উদ্যোগ নিতে হবে আজ থেকে। ধ্বংস করতে যত সময় লেগেছে, বিনির্মাণে তারচেয়ে বেশি সময় লাগবে।

s.mortoza@gmail.com

Comments

The Daily Star  | English

New uniform, monogram sans boat on the cards for police

According to police sources, a new monogram for the Bangladesh Police has already been determined. It will no longer feature a boat

6m ago