অধ্যক্ষের গলায় জুতার মালা: শিক্ষক-শিক্ষাবিদদের ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন

নড়াইলের মির্জাপুর ইউনাইটেড ডিগ্রি কলেজের ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ স্বপন কুমার বিশ্বাসের গলায় প্রকাশ্যে জুতার মালা পরিয়ে দেওয়ার দৃশ্য সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়েছে। বিষয়টি নিয়ে দেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের আনুষ্ঠানিকভাবে প্রতিবাদ করতে দেখা যায়নি। তবে ব্যক্তিগতভাবে অনেকেই করেছেন।

একজন শিক্ষককে প্রকাশ্যে এভাবে নিপীড়ন করার পরেও কেন দেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলো আনুষ্ঠানিকভাবে কোনো প্রতিবাদ করছে না—তা জানতে দ্য ডেইলি স্টার কথা বলেছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক সমিতির সভাপতি অধ্যাপক মো. রহমত উল্লাহ, সাধারণ সম্পাদক অধ্যাপক নিজামুল হক ভূঁইয়া, পদার্থ বিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক কামরুল হাসান মামুন, গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের অধ্যাপক ড. কাবেরী গায়েন এবং রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের অধ্যাপক সেলিম রেজা নিউটনের সঙ্গে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক সমিতির সভাপতি অধ্যাপক রহমত উল্লাহ বলেন, 'দেশে আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি দুর্বল। নৈতিকতা, মূল্যবোধ, সহিষ্ণুতা কমে গেছে। দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি হচ্ছে না, জবাবদিহিতা নেই। আইনের শাসন না থাকলে এসব ঘটনা ঘটতেই থাকবে। আমরা কেউ নিরাপদে থাকতে পারবো না। রাষ্ট্রের এই বিষয়ে নজর দেওয়া উচিত।'

বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক সমিতিগুলো শিক্ষক নিপীড়নের বিরুদ্ধে কার্যকর ভূমিকা রাখছে কি না—জানতে চাইলে তিনি বলেন, 'এই ধরনের সংগঠনগুলো রাজনৈতিক বিবেচনায় কাজ করায় অনেকটা দুর্বল হয়ে পড়েছে। শিক্ষক সমিতিগুলো যে লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যে প্রতিষ্ঠিত সেখান থেকে সরে এসেছে। যতটা কাজ করার কথা তা করছে না। নিজেদের স্বার্থে সবসময় কাজ করে। আমি নিজেই একজন নিপীড়িত শিক্ষক। আমিও শিক্ষক সমিতিকে আমার পাশে পাইনি। স্বপন কুমার বিশ্বাসের বিষয়টি নিয়ে আমার সাধারণ সম্পাদকের সঙ্গে আজ কথা বলবো।'

এ বিষয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক সমিতির সাধারণ সম্পাদক অধ্যাপক নিজামুল হক ভূঁইয়া বলেন, 'আমি বিষয়টি সম্পর্কে জানি না। আপনার কাছেই প্রথম শুনলাম। তবে কোনো শিক্ষককে জুতার মালা পড়ানো হলে সেটি অত্যন্ত দুঃখজনক। অবশ্যই এটি নিয়ে শিক্ষক সমাজের প্রতিবাদ করা উচিত।'

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক সমিতি এ বিষয়ে এখন পর্যন্ত কোনো প্রতিবাদ করেনি কেন—জানতে চাইলে তিনি বলেন, 'আমরা বিষয়টি নিয়ে আলোচনা করে সিদ্ধান্ত নেব। আমরা তো আর বেশি কিছু করতে পারি না। শুধু প্রতিবাদ করতে পারি, মানববন্ধন করতে পারি। আমাদের আর কিছু করার নেই। বাকিটা আইনি প্রক্রিয়া।'

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থ বিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক কামরুল হাসান মামুন বলেন, 'বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক সমিতিগুলোর লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য হলো কীভাবে সরকারকে শান্তিতে রাখা যায়। সরকার অখুশি হবে এমন কোনো বিষয়ে তারা বিবৃতি দেয় না। এসব ঘটনায় তারা কানে তুলা দিয়ে থাকে। কিন্তু সরকারকে বিব্রত করে এমন কেউ কিছু বললে তারা সক্রিয় হয়। শিক্ষক সমিতির প্রতিনিধিরা দেশের শিক্ষা ব্যবস্থার উন্নতির জন্য কথা বলে না, শিক্ষার মান বাড়ানোর জন্য কাজ করে না। কীভাবে নিজেদের সুযোগ-সুবিধা বাড়ানো যায় তা নিয়েই ব্যস্ত থাকে।'

অধ্যাপক কাবেরী গায়েন বলেন, '২০১৬ সালে নারায়ণগঞ্জের পিয়ার সাত্তার লতিফ উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক শ্যামল কান্তি ভক্তকে এক সংসদ সদস্যের সামনে কান ধরে উঠ-বস করানো হয়। সেই ঘটনায় সংসদ সদস্যের তেমন কোনো বিচার হয়নি। শিক্ষক হৃদয় মণ্ডলের ঘটনায় জড়িতদের বিরুদ্ধেও তেমন কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। নওগাঁয় হিজাব বিতর্ক নিয়ে আমোদিনী পালকে নানাভাবে হেনস্থা করা হলো। এভাবে একটার পর একটা ঘটনা ঘটছে কিন্তু জড়িতদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি না হওয়ায় এসব ঘটনার পুনরাবৃত্তি হচ্ছে।'

এসব ঘটনায় পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক সমিতিগুলোর ভূমিকা সম্পর্কে জানতে চাইলে তিনি বলেন, 'বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক সমিতিগুলো জোরালো কোনো প্রতিবাদ করছে না। প্রতিবাদ করলেও কিছু ফ্যাশনেবল প্রতিবাদ হয়, যা কার্যকর না। এর মূল কারণ হলো বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা নিজেদের ব্রাহ্মণ মনে করেন। অন্য শিক্ষকদের তেমনভাবে গুরুত্ব দেন না। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক সমিতিগুলো সরকারের পক্ষ থেকে কোনো সাড়া না পেলে আন্দোলন করে না, মানববন্ধন করে না, প্রতিবাদ করে না।'

তিনি বলেন, 'শিক্ষক সমিতিগুলো বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের প্রতিনিধিত্ব করে বলে আমার মনে হয় না। শিক্ষকদের নেতৃত্ব তো দূরের কথা, তাদের নিজেদের মধ্যে নানা সমস্যা থাকে। নিজেদের মধ্যে ভাগ-বাটোয়ারা, সুবিধা নেওয়া, ক্ষমতার অপপ্রয়োগ—এগুলো নিয়েই থাকেন তারা। কেউ এককভাবে প্রতিবাদ করলে বা অন্যায়ের বিরুদ্ধে কথা বললে বরং সেই শিক্ষককে নানাভাবে হয়রানি করা হয়। বর্তমানে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক সমিতিগুলোর কার্যকারিতা আছে বলে আমি মনে করি না। সরকারের উচ্চ পর্যায় থেকে কোনো বার্তা না আসলে এই ঘটনাগুলো বারবার ঘটবে।'

রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের অধ্যাপক সেলিম রেজা নিউটন বলেন, 'বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক সমিতিগুলো নামকাওয়াস্তে আছে। আমাদের সমস্যা রাষ্ট্রীয় ম্যাকানিজমে। রাষ্ট্র অনেক অন্যায়কে প্রশ্রয় দেয়। রাষ্ট্রের মূল কাঠামো নিয়ে ভাবা দরকার। রাষ্ট্রের যে হাওয়া বইছে সেই হাওয়ার বিরুদ্ধে কেউ কথা বলে না। কারণ তারা জানে এই হাওয়ার বিরুদ্ধে কথা বললে বিপদে পড়তে হবে। এই হাওয়া অনেকদিন থাকায় তা ঘন হয়ে গেছে। শুধু শিক্ষক নয়, সব নাগরিকের সঙ্গেই এখন বিভিন্ন নিপীড়ন করা হচ্ছে। এটি কাম্য নয়।'

Comments

The Daily Star  | English

Family reunited after 18 years

Stranded in Malaysia, man finally comes back home

20m ago