প্রত্যয় পরিকল্পনা কেন প্রত্যাখ্যান করছেন শিক্ষকরা?
বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক হিসেবে যোগ দিয়েছি ২০১৬ সালে। এরপর বিভিন্ন ফোরাম, আলোচনা সভা, চায়ের টেবিল ও অ্যাকাডেমিক আড্ডায় অনুভব করেছি—প্রজাতন্ত্রের আমলাদের সঙ্গে বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকদের একটি অলিখিত বিরোধ রয়েছে। এই দ্বন্দ্বটি বেশ গভীর ও গুরুতর। ২০১৪-১৫ সালে জাতীয় বেতন স্কেল চূড়ান্ত হওয়ার আগে এই বিরোধ প্রবলভাবে মাথাচাড়া দিয়েছিল। বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ও সচিবরা একেবারে মুখোমুখি অবস্থানে চলে গিয়েছিলেন। বেতন গ্রেড ও টাইম স্কেল নিয়ে দুই শিবিরে তৈরি হয়েছিল ধুন্ধুমার পরিস্থিতি। শিক্ষকরা লাগাতার আন্দোলনে ছিলেন, বিভিন্ন বিষয়ে ছাড় দিতে প্রশাসনের কর্তাব্যক্তিরাও ছিলেন অটল।
২০১৫ সালে আমি একটি বেসরকারি টেলিভিশনে জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদকের কাজ করতাম। আমার কাজের ক্ষেত্র ছিল সচিবালয়। তখন বেতন স্কেলের দ্বন্দ্ব নিয়ে সংবাদ সংগ্রহের জন্য বেশ কয়েকজন সচিবের সঙ্গে আলাপ হয়েছিল। আমার স্পষ্ট মনে আছে তাদের অনেকেরই বদ্ধমূল ধারণা, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা অত্যন্ত ফাঁকিবাজ। ক্লাসে পড়ানোকে পাশ কাটিয়ে মাস্টার মশাইরা পরামর্শদাতা (কনসালটেন্ট) হিসেবে বিপুল অর্থ আয় করেন। বিশ্ববিদ্যালয়ে সময় দেন না, টেলিভিশনে টক শো করে বেড়ান।
আর বিপরীতে সচিবরা সপ্তাহে পাঁচ দিন ৯-৫টা অফিস করেন। তাই গ্রেড-১ ও সিলেকশন গ্রেড নিয়ে শিক্ষকদের দাবি যৌক্তিক নয়। বিশ্ববিদ্যালয়ে আট বছরের শিক্ষকতা জীবনের অভিজ্ঞতা থেকে বলতে পারি, সচিবদের এই ধারণা পুরোপুরি সত্য নয়। হ্যাঁ, শিক্ষকদের অতি ক্ষুদ্র একটি অংশ অবশ্যই দায়িত্ব অবহেলা করে পরামর্শকের কাজ করেন। কিন্তু সেই সংখ্যা খুবই সামান্য। আর ঢাকার বাইরে এই ধরনের কাজে যুক্ত হওয়ার সুযোগ নেই বললেই চলে। আমার মূল্যায়ন সিংহভাগ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকই অত্যন্ত নিষ্ঠা ও একাগ্রতার সঙ্গে তাদের ওপর অর্পিত দায়িত্ব সংবেদনশীল হৃদয়ে পালন করেন। বিপরীতে রাষ্ট্রের কাছে প্রত্যাশা করেন সম্মানজনক পদবি ও সম্মানি।
মূল প্রসঙ্গে আসা যাক। ২০১৪-১৫ সালের পর বাংলাদেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর শিক্ষকরা আবার আন্দোলনে। মানববন্ধন, আংশিক কর্মবিরতির ধাপ শেষ। ১ জুলাই থেকে শুরু হবে সর্বাত্মক কর্মবিরতি। বাংলাদেশ বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতি ফেডারেশনের ঘোষণা অনুযায়ী, এ দিন থেকে ক্লাস-পরীক্ষা, প্রশাসনিক কার্যক্রম সব বন্ধ থাকবে। সোজা কথা সর্বাত্মক ধর্মঘট। শিক্ষকদের দাবি, সর্বজনীন পেনশন পরিকল্পনায় প্রত্যয় স্কিম অবশ্যই প্রত্যাহার করতে হবে। শিক্ষকদের জন্য পেনশনের এই স্কিম নিয়ে প্রবল অসন্তোষ শুরু হয় চলতি বছরের মার্চে। গত ১৩ মার্চ অর্থ মন্ত্রণালয় থেকে দেওয়া এক প্রজ্ঞাপনে পুরোনো পেনশন ব্যবস্থাপনার অধীনে থাকা স্বশাসিত, স্বায়ত্তশাসিত বা আধা-সরকারি প্রতিষ্ঠানের নতুন কর্মীদের জন্য ১ জুলাই থেকে বাধ্যতামূলকভাবে প্রত্যয় স্কিম চালুর ঘোষণা দেওয় হয়, যা নিয়েই বিপত্তি।
শিক্ষকদের শঙ্কা, এই স্কিম চালু হলে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, কর্মকর্তা-কর্মচারীদের অবসরকালীন সুযোগ-সুবিধা অনেকখানি কমে যাবে। তৈরি হবে অনাকাঙ্ক্ষিত অনিশ্চয়তা। ফলে দেশের উচ্চশিক্ষা ও গবেষণা খাতে যুক্ত হতে মেধাবীরা ভবিষ্যতে আর আগ্রহী হবেন না। এ ছাড়া এই পেনশন পরিকল্পনায় অবসরভোগীরা যে পরিমাণ অর্থ প্রতি মাসে পাবেন, তা নির্দিষ্ট নয়। শিক্ষকদের আরেকটি বড় দাবি, এই পেনশন পরিকল্পনা কোনো অবস্থাতেই সর্বজনীন নয়। যদিও নাম সর্বজনীন পেনশন স্কিম।
সরকারের তিনটি অতি গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠান সামরিক ও বেসামরিক আমলাতন্ত্র ও বিচার বিভাগ এই স্কিমের আওতাভুক্ত নয়। যে কারণে এই স্কিমকে কোনো অর্থেই সর্বজনীন বলতে নারাজ শিক্ষকরা। শিক্ষকদের যুক্তি, এই পরিকল্পনা যদি এতই ভালো তাহলে সামরিক-বেসামরিক আমলাতন্ত্র ও বিচার বিভাগ এর বাইরে থাকবে কেন? এ ছাড়া বর্তমান ব্যবস্থায় শিক্ষকরা অবসরকালে তাদের অভোগকৃত ছুটির একটি অংশ নগদায়ন বা টাকায় পরিণত করতে পারেন, যার সুযোগ প্রত্যয় পরিকল্পনায় নেই।
পাশাপাশি বর্তমান নিয়ম অনুযায়ী বিশ্ববিদ্যালয়ে পাঁচ বছর চাকরি করলেই একজন শিক্ষকের পরিবারের সদস্যরা নির্ধারিত হারে মাসিক পেনশন প্রাপ্য হন, যা নতুন প্রত্যয় পরিকল্পনায় নেই। নতুন পরিকল্পনায় এই সময় ১০ বছর। শিক্ষকরা মনে করছেন, এতে তাদের পরিবারের ভবিষ্যৎ সুরক্ষা অনিশ্চিত হয়ে পড়বে। এ ছাড়া পেনশনভোগীর উত্তরসূরি নির্ধারণ নিয়েও অনেক জটিলতা রয়েছে। যা নিয়ে শিক্ষকরা দ্বিধা-দ্বন্দ্ব ও শঙ্কায় ভুগছেন। একইসঙ্গে প্রত্যয় পরিকল্পনায় আরেকটি বিষয় খুবই অস্পষ্ট। সাধারণত বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রতিটি পদোন্নতি এক একটি সম্পূর্ণ নতুন নিয়োগ। তাই প্রশ্ন হলো—একজন শিক্ষক যখন সহকারী অধ্যাপক থেকে সহযোগী অধ্যাপক হবেন, সেটাতো নতুন নিয়োগ। তাহলে কি তখন ওই শিক্ষক স্বয়ংক্রিয়ভাবে প্রত্যয় স্কিমে চলে যাবেন? এ প্রশ্নের উত্তর শিক্ষকরা জানেন না।
এই স্কিম নিয়ে আরও একটি বিষয় আলাপ জরুরি। আমি অনেকের সঙ্গে কথা বলে জেনেছি, শিক্ষকরা প্রত্যয় পরিকল্পনায় না যেতে চাওয়ার অন্যতম প্রধান কারণ প্রভাবশালী আমলাতন্ত্র ও বর্তমান আর্থিক ব্যবস্থাপনার ওপর অনাস্থা। তারা মনে করেন, বর্তমানে ব্যাংকিং খাতসহ বেশ কিছু খাতে যে ধরনের অনিয়ম ও অব্যবস্থাপনার কথা শোনা যায়, তাতে এই পরিকল্পনায় আস্থা রাখা কঠিন। তাদের আরও ভয় এই পরিকল্পনার মাধ্যমে শিক্ষকদের সুযোগ-সুবিধা আরও সংকুচিত হতে পারে।
এ ছাড়া এখানে নতুন করে মাথাচাড়া দিয়েছে পুরনো সেই বিরোধ। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের অনেকেই মনে করেন, প্রভাবশালী আমলারা নিজেদের নিরাপদে রেখে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের ওপর নতুন এই পেনশন পরিকল্পনা চাপিয়ে দিচ্ছেন। কারণ ২০২৩ সালে যখন সর্বজনীন পেনশন প্রক্রিয়া বাস্তবায়ন শুরু হয়, তখন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা এর বাইরে ছিলেন।
যাই হোক, শেষ কথা হলো চলমান এই বিরোধ সারা দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে অচলাবস্থা তৈরি করতে চলছে। এখন দেখার বিষয় ১ জুলাইয়ের আগে এ বিষয়ে কোনো সমঝোতা হয় নাকি শুরু হয় লাগাতার অচলাবস্থা। যাতে নিশ্চিতভাবেই সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হবেন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা। সেদিকে সংবেদনশীল হৃদয়ে নজর দেওয়া সবচেয়ে জরুরি।
রাহাত মিনহাজ: সহকারী অধ্যাপক, গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়
Comments