শ্যামল কান্তি থেকে স্বপন বিশ্বাস: শিক্ষক নিপীড়নের হাতিয়ার ‘ধর্ম অবমাননা’

সম্প্রতি দেশে ধর্ম অবমাননার অভিযোগ এনে কয়েকজন শিক্ষককে হেনস্থা ও নিপীড়ন করা হয়েছে। এমন ৪টি ঘটনা যাচাই করে দেখা গেছে, ৩ জন শিক্ষকের বিরুদ্ধেই ধর্ম অবমাননার কোনো প্রমাণ পাওয়া যায়নি। আরেকজনের বিরুদ্ধে আগামীকাল বৃহস্পতিবার তদন্ত প্রতিবেদন জমা দেওয়ার কথা।

গত ১৮ জুন নড়াইল সদর উপজেলার মির্জাপুর ইউনাইটেড কলেজের ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ স্বপন কুমার বিশ্বাসের গলায় জুতার মালা পরানো হয়। সেসময় আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা কলেজে উপস্থিত ছিল। স্বপন কুমার বিশ্বাসের বিরুদ্ধে অভিযোগ ছিল তিনি 'ধর্ম অবমাননা' করে ফেসবুকে পোস্ট দেওয়া এক শিক্ষার্থীর পক্ষ নিয়েছেন।

এই ঘটনায় গঠিত তদন্ত কমিটির একজন নাম প্রকাশ না করা শর্তে আজ বুধবার দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'আমরা ঘটনাস্থলে উপস্থিত থাকা স্থানীয় কয়েকজন এবং কলেজের কয়েকজন শিক্ষক ও সভাপতির সঙ্গে কথা বলেছি। বিভিন্ন ছবি ও ভিডিও সংগ্রহ করেছি। আমরা আরও কাজ করছি। আশা করছি আগামীকালের মধ্যেই তদন্ত প্রতিবেদন জমা দেওয়া হবে।'

অধ্যক্ষ স্বপন কুমার বিশ্বাসের বিরুদ্ধে আনিত অভিযোগের প্রাথমিক কোনো প্রমাণ পেয়েছেন কি না, জানতে চাইলে তিনি বলেন, 'যেহেতু তদন্ত প্রতিবেদন এখনো জমা দেওয়া হয়নি, তাই সেটি বলা যাচ্ছে না। প্রতিবেদন জমা দেওয়ার পর বলা যাবে।'

চলতি বছরের এপ্রিলে নওগাঁর মহাদেবপুর উপজেলার দাউল বারবাকপুর উচ্চ বিদ্যালয়ের শিক্ষক আমোদিনী পালের বিরুদ্ধে 'সাম্প্রদায়িক বিতর্ক' তোলা হয়। শিক্ষার্থীরা হিজাব পরে স্কুলে আসায় তাদেরকে মারধর করা হয় বলে অভিযোগ আনা হয়। পরবর্তীতে প্রমাণ হয়, আমোদিনী পাল হিজাব পরে আসার জন্য কোনো শিক্ষার্থীকে মারধর করেননি। বরং তার বিরুদ্ধে তোলা সাম্প্রদায়িক বিতর্কের পেছনে ছিল স্কুল কর্তৃপক্ষের একটি অংশের দীর্ঘদিনের দুর্নীতি ধামাচাপা দেওয়ার চেষ্টা।

আমোদিনী পাল আজ টেলিফোনে ডেইলি স্টারকে বলেন, 'আমাকে যারা হয়রানি করেছে, তারা এখনো প্রকাশ্যে ঘুরে বেড়াচ্ছে। মামলা করার পরেও প্রকৃত আসামিদের গ্রেপ্তার করা হচ্ছে না। ন্যায়বিচার পাব বলে আশা করি না। আমরা যারা সংখ্যালঘু, তারা নিরাপত্তাহীন। সরকার আমাদের নিরাপত্তা দেয়নি এবং এখনো দিচ্ছে না। আমরাও এ দেশের নাগরিক। আমরা নিরাপত্তা চাই।'

তিনি বলেন, 'গতকাল মামলার বিষয়ে ওসির সঙ্গে কথা বলেছি। আসামিরা যে প্রকাশ্যে ঘুরে বেড়াচ্ছে, সেটা তাকে জানিয়েছি। ওসি বলেছেন, "দেখছি"।'

এ বিষয়ে জানতে চাইলে মহাদেবপুর থানার ওসি আজম উদ্দীন মাহমুদ টেলিফোনে ডেইলি স্টারকে বলেন, 'আমোদিনী পালের সঙ্গে গতকাল কথা হয়েছে। মামলাটি এখনো তদন্তাধীন আছে। আসামিদের মধ্যে ৪ জন জেলে আছেন। সম্ভবত একজন বাইরে আছেন।'

তদন্ত কবে শেষ হবে জানতে চাইলে তিনি বলেন, 'কখন শেষ হবে, তা এখনো বলতে পারছি না। শেষ হলেই আমরা প্রতিবেদন দাখিল করব।'

চলতি বছরের ২০ মার্চ মুন্সিগঞ্জ সদর উপজেলার বিনোদপুর রামকুমার উচ্চ বিদ্যালয়ের বিজ্ঞানের শিক্ষক হৃদয় চন্দ্র মন্ডলের বিরুদ্ধে শ্রেণিকক্ষে পাঠদান করার সময় ধর্ম অবমাননার অভিযোগ আনা হয়।

শ্রেণিকক্ষে শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের কথাবার্তা গোপনে ভিডিও করে তা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে দেওয়া হয়। পরদিন কিছু শিক্ষার্থী স্কুলের প্রধান শিক্ষক আলাউদ্দিন আহমেদের কাছে হৃদয় চন্দ্র মন্ডলের বিরুদ্ধে ধর্ম অবমাননার অভিযোগ করে।

অভিযোগের ভিত্তিতে হৃদয় চন্দ্র মন্ডলকে কারণ দর্শানোর নোটিশ দেওয়ার পাশাপাশি সাময়িকভাবে বরখাস্ত করা হয়। ২২ মার্চ তার বাড়িতে আক্রমণ করা হয়। একই দিনে তার বিরুদ্ধে মামলা করা হয় এবং সেদিনই তাকে গ্রেপ্তার করা হয়। পরে তাকে কারাগারে পাঠানো হয়। বর্তমানে তিনি জামিনে আছেন এবং নিয়মিত পাঠদান করছেন।

হৃদয় চন্দ্র মন্ডল আজ বুধবার ডেইলি স্টারকে বলেন, 'গতকাল মামলার হাজিরা দিয়ে এসেছি। মামলা তুলে নেওয়ার প্রক্রিয়া চলছে। আশা করি খুব শিগগির মামলাটি শেষ হবে। আমার বিরুদ্ধে ধর্ম অবমাননার যে অভিযোগ আনা হয়েছিল, তার কোনো প্রমাণ পাওয়া যায়নি এবং কেউ সাক্ষী দিতেও আসেনি।'

হৃদয় চন্দ্র মন্ডলের স্ত্রী ববিতা হাওলাদার ডেইলি স্টারকে বলেন, 'আমারা এখনো ভয়ের মধ্যে আছি। কিছুদিন আগে রাত ১২টার দিকে অপরিচিত নম্বর থেকে ফোন আসে। পরিচয় জানতে চাইলেও ওই ব্যক্তি তা দেননি। পরে তার নম্বর থানায় দেবো বললে তিনি বলেন, "আপনার কিন্তু একটা ছোট মেয়ে আছে।" এই ভয় দেখিয়ে ফোন রেখে দেয়। আমার স্বামী সবসময় অন্যায়ের বিরুদ্ধে কথা বলে। সত্য কথা বলে। এখন সত্য কথা বললেই শত্রু বেশি। বিভিন্ন বিষয় নিয়ে সত্য কথা বলায় আমার স্বামীকে হয়রানি করা হচ্ছে।'

২০১৬ সালের ১৩ মে নারায়ণগঞ্জের পিয়ার সাত্তার লতিফ উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক শ্যামল কান্তি ভক্তকে 'ধর্মীয় অনুভূতি'তে আঘাত দেওয়ার অভিযোগে সংসদ সদস্য সেলিম ওসমানের সামনে কান ধরে উঠবস করানো হয়। তাকে চাকরি থেকে পদত্যাগ করতে বাধ্য করে স্কুল ব্যবস্থাপনা কমিটি।

ঘটনাটি তদন্তে শিক্ষা মন্ত্রণালয় একটি কমিটি গঠন করে। তদন্তে শ্যামল কান্তি ভক্তের বিরুদ্ধে আনা অভিযোগ মিথ্যা প্রমাণিত হয় এবং তাকে আবার প্রধান শিক্ষক করা হয়।

পরবর্তীতে শ্যামল কান্তি ভক্তকে নানাভাবে হয়রানি করা হয়। তার বিরুদ্ধে ঘুষ নেওয়ার অভিযোগ এনে কারাগারে পাঠানো হয়। শ্যামল কান্তি ভক্ত এবং মানবাধিকারকর্মীরা দাবি করেন, একটি প্রভাবশালী মহলের নির্দেশে তাকে কারাগারে পাঠানো হয়।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের অধ্যাপক রোবায়েত ফেরদৌস ডেইলি স্টারকে বলেন, 'আমাদের দেশে ধর্মান্ধতা, সাম্প্রদায়িকতা বেড়ে গেছে। অসাম্প্রদায়িক রাষ্ট্র, যেটির স্বপ্ন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান দেখেছিলেন, সেখান থেকে আমরা বের হয়ে আসছি। আমাদের মধ্যে সহনশীলতা কমে গেছে। অন্য ধর্মকে শ্রদ্ধা ও স্বীকৃতি দেওয়া তো দূরের কথা, আমরা অন্য ধর্মকে সহ্যই করতে পারছি না। তাদেরকে সংখ্যালঘু থেকে সংখ্যাশূন্য করার চেষ্টা করা হচ্ছে।'

এসব ঘটনায় রাষ্ট্রের ইন্ধন আছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, 'যারা প্রশাসনে আছেন, তাদের মধ্যেও অনেকে ধর্মান্ধ ও সাম্প্রদায়িক মানসিকতার। তা ছাড়া এখানে ভোটের রাজনীতি কাজ করে। মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ ভোটের কারণে সরকার ও রাজনৈতিক দলগুলোও এই বিষয়গুলোকে তেমন গুরুত্ব দেয় না। ফলে এসব ঘটনার পুনরাবৃত্তি হচ্ছে।'

এই সমস্যা থেকে উত্তরণের উপায় কী হতে পারে, জানতে চাইলে ঢাবির এই অধ্যাপক বলেন, 'শিক্ষা ও সাংস্কৃতিক ক্যাম্পেইন সবার আগে দরকার। শিক্ষা ও সংস্কৃতির বিপ্লব ঘটাতে না পারলে আমরা শিগগির একটি উগ্র ধর্মান্ধ জাতি হিসেবে পরিণত হবো।'

শিক্ষাবিদ ও লেখক অধ্যাপক সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম ডেইলি স্টারকে বলেন, 'সমাজে সাম্প্রদায়িকতা বেড়ে গেছে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের কারণে এই সাম্প্রদায়িকতা দ্রুত ছড়াচ্ছে। চরম উগ্রবাদকে দমন করা হলেও মধ্যম পর্যায়ের উগ্রবাদকে প্রশ্রয় দেওয়া হচ্ছে। ফলে নির্দিষ্ট একটি ধর্মের শিক্ষকদের লক্ষ্য করা হচ্ছে। তা ছাড়া ভারতে সাম্প্রদায়িকতা নিয়ে যে ঘটনা ঘটছে, তার একটি প্রভাব আমাদের এখানেও পড়ছে।'

পারিবারিক শিক্ষা তেমনভাবে দেওয়া হচ্ছে না উল্লেখ করে তিনি বলেন, 'আমাদের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোরও কিছু সমস্যা আছে। যোগ্য শিক্ষকের অভাব রয়েছে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানেও মূল্যবোধ ও অসাম্প্রদায়িকতার শিক্ষা তেমনভাবে দেওয়া হচ্ছে না। শিক্ষকরা নিজেদের কাজ ভুলে গিয়ে অনেকেই রাজনীতি নিয়ে ব্যস্ত। তা ছাড়া শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের কমিটিগুলোতে শিক্ষা-সংশ্লিষ্ট যোগ্য লোক থাকতে পারছে না। এগুলো এখন রাজনীতিবিদদের দখলে। অনেক খারাপ প্রকৃতির লোকও এই কমিটিগুলোতে আছে।'

'এসব ঘটনার পেছনে ভোটের রাজনীতিও কাজ করে। এ কারণে রাজনৈতিক দলগুলো এসব বিষয় নিয়ে কথা বলেন না। প্রশাসন অনেক জায়গায় ভালো কাজ করলেও তাদের মধ্যে কেউ কেউ আছে যারা বিভিন্ন সময় এসব ঘটনায় নীরব থাকেন। ফলে সাম্প্রদায়িক কর্মকাণ্ড মাথা চাড়া দিয়ে উঠছে। আমরা যদি এখনই এসব বিষয় নিয়ন্ত্রণ করতে না পারি, তাহলে সামনে আরও বড় ধরনের বিপদ আসবে। আমরা পুরোপুরি অন্ধকারের দিকে ধাবিত হবো', যোগ করেন অধ্যাপক সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম।

Comments

The Daily Star  | English

Power, Energy Sector: Arrears, subsidies weighing down govt

The interim government is struggling to pay the power bill arrears that were caused largely by “unfair” contracts signed between the previous administration and power producers, and rising international fuel prices.

9h ago