মিনিকেট: কমছে চালের পুষ্টিগুণ, বছরে অপচয় ১৬ লাখ মেট্রিক টন

ছবি: সংগৃহীত

নিষেধাজ্ঞা সত্ত্বেও যথাযথ মনিটরিংয়ের অভাবে চাল অতিমাত্রায় পলিশ করে 'মিনিকেট' হিসেবে বাজারে ছাড়ছেন মিল মালিকরা।

চালের যথাযথ পুষ্টিমান রক্ষা ও অপচয় রোধে ২০২৩ সালে সরকার চাল পলিশ ও তা ভুয়া নামে বিক্রি করা নিষিদ্ধ করে।

'খাদ্যদ্রব্য উৎপাদন, মজুত, হস্তান্তর, পরিবহন, সরবরাহ, বিতরণ ও বিপণন আইন-২০২৩' অনুযায়ী, কোনো খাদ্যদ্রব্যে থাকা প্রাকৃতিক উপাদান সম্পূর্ণ বা আংশিক অপসারণ বা পরিবর্তন করে তা উৎপাদন বা বিপণন নিষিদ্ধ এবং দণ্ডনীয় অপরাধ।

একই আইনে খাদ্যশস্য থেকে উৎপাদিত খাদ্যদ্রব্যকে উপজাত হিসেবে উল্লেখ না করে ভিন্ন বা কাল্পনিক নামে বাজারজাত করাও নিষিদ্ধ করা হয়েছে।

তবে মিলাররা বিভিন্ন জাতের চাল পলিশ অব্যাহত রেখেছেন এবং সেগুলো মিনিকেট হিসেবে বিক্রি করছেন। তাদের দাবি, এখনো চাল পলিশ সংক্রান্ত কোনো নির্দেশিকা তারা খাদ্য মন্ত্রণালয়ের কাছ থেকে পাননি।

বাংলাদেশে ভাত একটি প্রধান খাদ্য এবং কার্বোহাইড্রেটের প্রাথমিক উৎস। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, দেশে বছরে প্রায় তিন কোটি ৯০ লাখ টন চাল উৎপাদিত হয়। আর মাথাপিছু দৈনিক খরচ হয় গড়ে ৪৯৩ গ্রাম চাল, যা একজন ব্যক্তির ক্যালরি গ্রহণের ৫৮ শতাংশ।

গবেষকরা বলেন, চাল অতিরিক্ত পলিশ করলে এতে থাকা আয়রন, ক্যালসিয়াম ও ভিটামিন 'বি'র মতো প্রয়োজনীয় পুষ্টি উপাদান কমে যায়। অথচ স্বাস্থ্যের জন্য এসব উপাদান অত্যাবশ্যক।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউটের (বিআরআরআই) যৌথ গবেষণায় দেখা গেছে, চাল ১০ শতাংশ বা এর বেশি পলিশ করলে তা থেকে ৯-১৮ শতাংশ প্রোটিন, ৮-১৯ শতাংশ ফাইবার, ৬-২১ শতাংশ ম্যাগনেসিয়াম ও ৮-৫০ শতাংশ পর্যন্ত ফলিক অ্যাসিড কমে যায়।

কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা জানান, চাল ১০ শতাংশের বেশি পলিশ করলে প্রতি বছর ১৬ লাখ মেট্রিক টনের অপচয় হয়, যা মোট চাহিদার দশমিক শূন্য ছয় শতাংশ।

ওই যৌথ গবেষণার অন্যতম গবেষক হাবিবুল বারী সজীব বলেন, চাল পলিশ করার প্রক্রিয়ায় গুরুত্বপূর্ণ খনিজ ও ভিটামিন ১০ শতাংশ বা তারও বেশি হারে কমে যায়।

গবেষণায় দেখা গেছে, মিলাররা চালকে আকর্ষণীয় করার জন্য অতিরিক্ত পলিশ করেন এবং ভোক্তাদের আকৃষ্ট করার জন্য মিনিকেট হিসেবে বাজারজাত করেন, যদিও চালের এ জাতীয় কোনো জাত নেই।

চলতি বছরের ১ মে প্রকাশিত ইন্টারন্যাশনাল ফুড পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (আইএফপিআরআই) এক গবেষণায় দেখা গেছে, বাংলাদেশের শহরের বাজারগুলোতে বিক্রি হওয়া চালের ৩০ শতাংশেরও বেশি আকৃতি, আকার ও রঙে পরিশোধিত হয় এবং মিনিকেট হিসেবে বাজারে আসে।

'রিসার্চ-ব্যাকড পলিসি টু ইলিমিনেট মিনিকেট রাইস ইন বাংলাদেশ উইল ইমপ্রুভ নিউট্রিশন' শীর্ষক গবেষণায় দেখা গেছে, তথাকথিত মিনিকেট চাল মূলত ব্রি-২৮ ও ব্রি-২৯ এর মতো ধানের জাত থেকে তৈরি এবং এতে অন্যান্য জাতের তুলনায় ৭০ শতাংশ পর্যন্ত কম জিংক রয়েছে।

প্রতিবেদনে বলা হয়, 'মিনিকেট' নামটি এসেছে ১৯৮৫ সালে, যখন শতাব্দী নামে একটি উচ্চ ফলনশীল সরু ধানের জাত ভারতের পশ্চিমবঙ্গের কৃষকদের কাছে 'মিনি কিটে' বিতরণ করা হয়।

আইএফআরআইয়ের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, শতাব্দী জাতের চালের উৎপাদন এখন আর হয় না।

বাংলাদেশ অটো মেজর অ্যান্ড হাসকিং মিলস ওনার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিএএমএইচএমওএ) তথ্য অনুযায়ী, সারা দেশে অন্তত চার হাজার স্বয়ংক্রিয় মিলে চাল পলিশ করা হয়।

দ্য ডেইলি স্টার দিনাজপুর, ঢাকা, নারায়ণগঞ্জ, সুনামগঞ্জ, চাঁপাইনবাবগঞ্জ, রংপুর, ফরিদপুর, নীলফামারী ও যশোরের দুই ডজন মিলমালিকের সঙ্গে যোগাযোগ করেছে।

তারা সবাই জানান, মানের ওপর নির্ভর করে ১০-১৬ শতাংশ হারে চাল পলিশ করেন তারা।

সিলেট বিভাগীয় অটো রাইস মিল মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক সাব্বির আহমদ বলেন, সরকার এখনো পলিশের সীমা নির্ধারণ না করায় মিল মালিকরা ইচ্ছামতো চাল পলিশ করছেন, যা মূলত জনস্বাস্থ্য বিষয়ে আপস করার মতো।

নওগাঁর ধান-চাল পাইকার ও ব্যবসায়ী সমিতির সভাপতি নিরোদ বরণ সাহা চন্দন বলেন, সারাদেশের মিলাররা ১৫ শতাংশ হারে চাল পলিশ করেন।

তিনি বলেন, 'মানুষ সাদা চাল পছন্দ করে। তাই সরকারি কোনো নির্দেশনা না থাকায় মিলাররা অতিরিক্ত পলিশ করে।'

নিরোদ বরণ সাহা চন্দন কথার সঙ্গে একমত পোষণ করেন ভোলা অটো রাইস মিলস লিমিটেডের মালিক ও বরিশাল বিভাগীয় মিলস মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক জুলফিকার মাহমুদ নিয়াজ এবং মা ভান্ডারী অটো রাইস মিলের মালিক ও কুষ্টিয়ার অটো মেজর অ্যান্ড হাসকিং মিলস ওনার্স অ্যাসোসিয়েশনের সহ-সাংগঠনিক সম্পাদক মাসুদ রানাও।

বিএএমএইচএমওএর সাধারণ সম্পাদক এইচ আর খান পাঠান বলেন, পলিশ করার ফলে চালের দামও বেড়ে যায়।

'পলিশ করার পর আমরা ৪০ কেজি ধান থেকে ২৬ কেজি চাল পাই। কিন্তু পলিশ না করে দেড় কেজি চাল সাশ্রয় করা যায় এবং কেজিপ্রতি দাম ২-৩ টাকা কমানো যেত', বলেন তিনি।

বিভিন্ন জেলার খাদ্য কর্মকর্তারা জানান, সরকারি নির্দেশনা না থাকায় তারা মিলারদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নিতে পারছেন না।

কুষ্টিয়ার খাদ্য নিয়ন্ত্রক মোহাম্মদ বাবুল হোসেন বলেন, 'সরকারের কোনো নীতিমালা নেই... আমরা সরকার বা ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের কাছ থেকে চাল পলিশ সংক্রান্ত কোনো নির্দেশনা পাইনি।'

আরও সাতজন জেলা খাদ্য নিয়ন্ত্রকের সঙ্গে যোগাযোগ করেছে ডেইলি স্টার। তারাও একই কথা জানিয়েছেন।

খাদ্য মন্ত্রণালয়ের সচিব ইসমাইল হোসেন ডেইলি স্টারকে বলেন, আইনে স্পষ্টভাবে বলা আছে যে, চাল পলিশ করা যাবে না। (যদিও) নীতিমালায় রাইস পলিশিংয়ের জন্য শতাংশ নির্দিষ্ট করা হয়নি, তবে আইন লঙ্ঘন করার কোনো উপায় নেই।

মন্ত্রণালয়ের জনসংযোগ কর্মকর্তা কামাল হোসেন বলেন, 'চাল পলিশ সংক্রান্ত একটি নীতিমালা তৈরি করা হয়েছে এবং বর্তমানে তা বাংলাদেশ গভর্নমেন্ট প্রিন্টিং অফিসে রয়েছে।'

খাদ্যমন্ত্রী সাধন চন্দ্র মজুমদার গত ২০ জুন ডেইলি স্টারকে বলেন, 'দেশে প্রতি বছর চার কোটি টন চাল উৎপাদিত হয়। এই চাল উজ্জ্বল করতে পাঁচবার পলিশ করা হয়। এতে চালের ওজন চার থেকে পাঁচ শতাংশ পর্যন্ত কমে যায়। ফলে বার্ষিক চাল উৎপাদন কমেছে ১৬ লাখ মেট্রিক টন। চাল দুইবার পলিশ করলে একদিকে চালের পুষ্টিগুণ বাড়বে, অন্যদিকে লোকসানও কমবে।

'এ পদ্ধতি অবলম্বন করলে চালের উৎপাদন খরচ কম হবে এবং ভোক্তারাও অধিক সাশ্রয়ী মূল্যে চাল পাবেন', বলেন তিনি।

Comments

The Daily Star  | English
Bangladesh asks India not to interfere in internal affairs

Dhaka asks New Delhi not to interfere in Bangladesh's internal affairs

Foreign Secretary Jashim Uddin briefed journalists following the Foreign Office Consultation between Bangladesh and India

9h ago