শেয়ারবাজারে মতিউরের অনিয়ম

সম্পদ নিয়ে বিতর্কের মুখে পড়া এনবিআর কর্মকর্তা মতিউর রহমান শেয়ারবাজারে বিনিয়োগের মাধ্যমে বড় অংকের অর্থ উপার্জন করেছেন। তবে যে প্রক্রিয়ায় তিনি এটি করেছেন তা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে।

সম্প্রতি বেসরকারি টেলিভিশন এনটিভিকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে এনবিআর থেকে অপসারিত ও অর্থ মন্ত্রণালয়ে সংযুক্ত মতিউর রহমান স্বীকার করেন যে, পুঁজিবাজার সম্পর্কে তার দক্ষতা কাজে লাগিয়ে রুগ্ন কিন্তু সম্ভাবনাময় কোম্পানির শেয়ার কিনে আর্থিকভাবে লাভবান হয়েছেন তিনি।

নিজের স্বীকারোক্তিতে তিনি জানান,  পুঁজিবাজারের দুর্বল ও সম্ভাবনাময় কোম্পানির মালিকদের সঙ্গে তিনি বসতেন এবং তাদের দুর্বলতা চিহ্নিত করা এবং  প্রতিষ্ঠানগুলো পরিদর্শন করে কোম্পানির উন্নয়নের জন্য সমাধান দিতেন। পড়তিতে থাকা অবস্থায় কম দামে তিনি কোম্পানিগুলোর শেয়ার কিনতেন এবং মূল্য বেড়ে গেলে তা বিক্রি করে দিতেন।

এভাবে তিনি ভালো মুনাফা করেন বলেও জানিয়েছেন। এছাড়াও ইনিশিয়াল পাবলিক অফারিংয়ের (আইপিও) মাধ্যমে কোম্পানিগুলো কীভাবে বাজারে তালিকাভুক্ত হবে তার পরামর্শক হিসেবেও কাজ করেন তিনি।

সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোতে চাকরি করা ক্ষমতাধর ও প্রভাবশালী লোকজন কীভাবে অর্থ উপার্জনের মেশিনে পরিণত হয় মতিউর রহমানের এই স্বীকারোক্তি  তারই প্রমাণ।  মতিউরের ক্ষেত্রে যা ঘটেছে তা কৌতূহলোদ্দীপক। তিনি ভেতরের ইনফরমেশন নিয়ে শেয়ারবাজারে এসেছিলেন, যা পুঁজিবাজারের নিয়ম অনুযায়ী বেআইনি।

ইনসাইড ট্রেডিংয়ের এই নিয়ম যারা সাধারণ বিনিয়োগকারী তাদের সুরক্ষায় করা হয়েছে। কারণ যারা শেয়ারবাজারের অভ্যন্তরীণ তথ্য জেনে বিনিয়োগ করেন তারা কখন মুনাফা ও কখন লোকসান হতে পারে তা আগেই জানতে পারেন, যা সাধারণ বিনিয়োগকারী পারেন না।

মতিউর রহমান ও তার পরিবারের সম্পদ নিয়ে বিতর্ক এমন এক সময় এল যখন বর্তমান ও সাবেক শীর্ষ সরকারি কর্মকর্তা ও তাদের পরিবারের সদস্যদের বিপুল সম্পদের বিষয়ে তদন্ত ও আলোচনা চলছে।

দ্য ডেইলি স্টারের কাছে আসা প্রাথমিক হিসাব অনুযায়ী, মতিউর রহমান ও তার কোম্পানির কাছে অন্তত ১০টি কোম্পানির তিন কোটির বেশি শেয়ার আছে। তবে এই সংখ্যা আরও বাড়তে পারে।

মতিউর, যিনি এর আগে চট্টগ্রাম কাস্টমস অ্যান্ড লার্জ ট্যাক্সপেয়ার ইউনিট (এলটিইউ), ভ্যাট-এও কাজ করেছেন, গত বুধবার এনটিভিকে বলেন, তিনি ২০০৮ সালে পুঁজিবাজারে বিনিয়োগ শুরু করেন।

ফরচুন সুজের শেয়ার থেকে 'অস্বাভাবিক বেশি' অর্থ উপার্জন করেছেন বলেও স্বীকার করেন তিনি। ১০ টাকা ফেসভ্যালুর শেয়ার ৮ টাকা দরে কিনে পরে ৫৪ টাকা দরে বিক্রি করেন তিনি।

তিনি বলেন, 'কোম্পানিটিকে শেয়ারবাজারে আনতে পরামর্শ দেওয়ার জন্য জুতা তৈরির কোম্পানির সঙ্গে আমার চুক্তি হয়েছিল। বিনিময়ে মালিক আমাকে ৮ টাকায় শেয়ার দিয়েছিলেন।'

এ বিষয়ে জানতে দুদিন ধরে তার মোবাইল ফোনে একাধিকবার কল ও টেক্সট মেসেজ পাঠানো হলেও মতিউর রহমান কোনো সাড়া দেননি।

কোম্পানি আইন অনুযায়ী, কোনো কোম্পানি ছাড়ের দামে শেয়ার বিক্রি করতে পারে তবে উচ্চ আদালতের অনুমোদন সাপেক্ষে, আর তা অবশ্যই কোম্পানির আর্থিক প্রতিবেদনে দেখাতে হবে।

তবে কোম্পানিটি এ বিষয়ে কোনো অনুমোদন নেয়নি এবং তালিকাভুক্ত হওয়ার সময় ২০১৫-১৬ সালের আর্থিক প্রতিবেদনে তা দেখানোও হয়নি। আইপিও প্রসপেক্টাসে দেখা যায়, সব শেয়ারহোল্ডার ১০ টাকা অভিহিত মূল্যে শেয়ার কিনেছেন।

পুঁজিবাজারে কোনো প্রতিষ্ঠানের তালিকাভুক্ত হওয়ার কাজে সরকারি কর্মচারিরা পরামর্শক হিসেবে কাজ করতে পারেন না, এমনকি আইন অনুযায়ী কোনো ব্যক্তিরও এ কাজ করার সুযোগ নেই।

এটি 'ইস্যু ম্যানেজমেন্ট লাইসেন্সধারী' বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর কাজ, এজন্য ৬৬ টি ব্যাংকের লাইসেন্স আছে।

ব্যাংকগুলো নির্ধারিত ফি এর বিনিময়ে এই কাজ করে থাকে। আইন অনুযায়ী তারা কোম্পানিগুলোর কাছ থেকে এজন্য ফি হিসেবে কোনোভাবেই শেয়ার নিতে পারে না।

বিএসইসির সাবেক চেয়ারম্যান ফারুক আহমেদ সিদ্দিকী বলেন, একজন সরকারি কর্মকর্তার এ ধরনের পরামর্শ দিতে পারে না। পুঁজিবাজারের বিধানেও এর কোনো সুযোগ নেই।

কোম্পানি কেন তাকে ৮ টাকায় শেয়ার দিল? এটি অনিয়মের একটি গুরুতর অভিযোগ যা কর্মকর্তা নিজেই স্বীকার করেছেন। এর সুষ্ঠু তদন্ত হওয়া উচিত, তিনি বলেন।

একজন শীর্ষ মার্চেন্ট ব্যাংকার যিনি সাধারণত আইপিও কনসালটেন্সি সেবা দিয়ে থাকেন তিনি বলেন, মতিউর রহমানের সাক্ষাৎকারে ইঙ্গিত দিয়েছেন যে তিনি তালিকাভুক্তির আগে শেয়ার পেয়েছেন এবং বাংলাদেশের কোনো কোম্পানিই এই সময়ে ডিসকাউন্টে শেয়ার বিক্রি করে না।

'অধিকাংশ কোম্পানিকে কোনো টাকা না পেয়ে কিংবা কম দামে ঘুষ হিসেবে কিছু প্রভাবশালী ব্যক্তিকে শেয়ার দিতে হয়।'

সাধারণত কোম্পানিগুলো নিয়ন্ত্রক কর্মকর্তাদের প্লেসমেন্ট শেয়ার দিয়ে থাকে।

ফরচুন সুজের আইপিও প্রসপেক্টাস অনুসারে মতিউর কোম্পানির ৫ লাখ শেয়ার পেয়েছেন, যা প্রাক-আইপিও সময়ে কোম্পানির মোট শেয়ারের ০ দশমিক ৬৭ শতাংশ।

ডেইলি স্টারের হাতে আসা কোম্পানির প্রসপেক্টাসে দেখা যায়, তিনি একমি পেস্টিসাইডস, অ্যাসোসিয়েটেড অক্সিজেন, সিঅ্যান্ড এ টেক্সটাইল, ডমিনেজ স্টিল, লুব-রেফ (বাংলাদেশ), মামুন এগ্রো, এমএল ডাইং, রিং শাইন এবং এসকে ট্রিমস থেকেও শেয়ার পেয়েছেন।

তিনি একমি পেস্টিসাইড থেকে ৩৭ লাখ শেয়ার এবং অ্যাসোসিয়েটেড অক্সিজেন থেকে সাড়ে ১৪ লাখ শেয়ার পেয়েছেন। তার প্রথম স্ত্রী লায়লা কানিজ লাকির কাছে অ্যাসোসিয়েটেড অক্সিজেনের শেয়ার ছিল সাড়ে চার লাখ এবং ছেলে আহমেদ তৌফিকুর রহমান অর্ণবের কাছে ছিল পাঁচ লাখ শেয়ার।

সিঅ্যান্ড এ টেক্সটাইল নামে একটি কোম্পানি থেকেই তিনি ও তার পরিবারের সদস্যরা পেয়েছেন ৪৭ লাখ ৩০ হাজার শেয়ার।

এছাড়া এসকে ট্রিমস থেকে ৮৮ লাখ ৮৩ হাজার শেয়ার, কাট্টালি টেক্সটাইল থেকে ২১ লাখ, এমএল ডাইং থেকে ১৬ লাখ, মামুন এগ্রো প্রোডাক্টস ও রিং শাইন থেকে ১০ লাখ শেয়ার এবং ডমিনেজ স্টিল ও লুব-রেফ (বাংলাদেশ) থেকে ৮ লাখ শেয়ার পেয়েছেন তিনি।

পুঁজিবাজারের নিয়ম অনুযায়ী, যে কোনো ব্যক্তি প্লেসমেন্ট শেয়ার পেতে পারেন। স্টক এক্সচেঞ্জের সঙ্গে তালিকাভুক্ত হওয়ার আগে, অনেক কোম্পানি ব্যক্তির কাছে প্লেসমেন্ট শেয়ার বিক্রি করে, বিশেষ করে বন্ধুবান্ধব এবং পরিবারের কাছে।

সাধারণত তালিকাভুক্তির পর বেশি দামে শেয়ার কেনাবেচা হবে ভেবে তারা অভিহিত মূল্যে বা বেশি দামে শেয়ার বিক্রি করে। এর মধ্যে বিনিয়োগকারীরা এক বছর বা তার বেশি সময় শেয়ার ধরে রেখে অর্থ উপার্জন করতে পারেন।

কিন্তু একই ব্যক্তি যদি অনেক কোম্পানির শেয়ার কেনেন, তাহলে তারা সব কোম্পানির শেয়ার কেনার জন্য অগ্রাধিকারমূলক সুবিধা পাচ্ছেন কিনা তা নিয়ে প্রশ্ন ওঠে, বলেন বিএসইসির সাবেক চেয়ারম্যান ফারুক আহমেদ সিদ্দিকী।

তিনি বলেন, ওই ব্যক্তি ওই প্লেসমেন্ট শেয়ারের বিনিময়ে কোম্পানিগুলোকে কোনো অবৈধ সুবিধা দিয়েছেন কি না, তা খতিয়ে দেখা উচিত সরকারের।

বিএসইসির একজন শীর্ষ কর্মকর্তা বলেন, পুঁজিবাজারে শেয়ার কেনা-বেচায় সরকারি কর্মকর্তাদের কোনো নিষেধাজ্ঞা নেই। কিন্তু আদর্শগতভাবে, স্টক মার্কেটে নীতিনির্ধারণী ভূমিকা রয়েছে বা এই খাতে স্বার্থের দ্বন্দ্ব রয়েছে তাদের কখনই স্টক এক্সচেঞ্জে বিনিয়োগের অনুমতি দেওয়া উচিত নয়।

'নিয়মটি সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন, কেন্দ্রীয় ব্যাংক বা এনবিআরের মতো অফিসে কর্মরত ব্যক্তিদের ক্ষেত্রে আরও বেশি প্রযোজ্য।'

বিএসইসির মুখপাত্র মোহাম্মদ রেজাউল করিম বলেন, কোনো কোম্পানি ডিসকাউন্ট মূল্যে শেয়ার বিক্রি করলে হাইকোর্টের অনুমোদন নিতে হবে, কিন্তু ফরচুন সুজ তা করেনি। অভিহিত মূল্যে শেয়ার ইস্যু করার জন্য এটি শুধুমাত্র বিএসইসি থেকে অনুমোদন নিয়েছে।

'তিনি (মতিউর) কীভাবে ৮ টাকায় শেয়ার পেলেন সে বিষয়ে আমাদের কাছে কোনো তথ্য নেই। শুধু কোম্পানি এবং সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিই এটি বলতে পারবেন।'

যেকোনো কোম্পানি যে কাউকে প্লেসমেন্ট শেয়ার অফার করতে পারে। তাই কোনো কোম্পানি অভিহিত মূল্যে শেয়ার বিক্রি করলে বিএসইসির কিছু বলার বা করার নেই, তিনি বলেন।

ফরচুন সুজের কোম্পানি সচিব রিয়াজ উদ্দিন ভূঁইয়া বলেন, কোম্পানিটি ১০ টাকা দরে মতিউরের কাছে শেয়ার বিক্রি করেছে।

মতিউর এখন অন্য কোম্পানির শেয়ারের দাম বাড়াতে কাজ করছেন।

এনটিভিকে মতিউর রহমান বলেছেন, 'বর্তমানে আমি সিলভা ফার্মাসিউটিক্যালসের সঙ্গে কাজ করছি। এক বছরের মধ্যে এর প্রবৃদ্ধি তিন গুণ হবে। এর দামও দ্বিগুণ হবে।'

বিএসইসির আদেশ অনুযায়ী, কেউ প্রকাশ্যে শেয়ারের দাম অনুমান করতে পারবে না। এছাড়া ১৯৭৯ সালের সরকারি কর্মচারী (আচরণ) বিধিতে বলা হয়েছে, কোনো সরকারি কর্মকর্তা বিনিয়োগের ক্ষেত্রে পূর্বানুমান দিতে পারবেন না।

অন্যদিকে, কোনো কোম্পানি কম সংখ্যক শেয়ারহোল্ডারের সঙ্গে ব্যক্তিগতভাবে বসতে পারে না। কোম্পানি শুধুমাত্র এজিএম-এ সংখ্যালঘু শেয়ারহোল্ডারদের সঙ্গে কথা বলতে পারে।

বাজার বিশ্লেষকরা বলছেন, এই ধরনের বৈঠক এবং গোপন তথ্যের ভিত্তিতে শেয়ার কেনা-বেচাকে ইনসাইডার ট্রেডিং হিসেবে দেখা হয়, যা বেআইনি।

কিন্তু মতিউর রহমান একে অন্যভাবে দেখেন।

একসময় এক কোটি টাকা বিনিয়োগ করে ১৪ কোটি টাকা আয় করেছি জানিয়ে তিনি এনটিভিকে বলেন, 'আমি সব সময় এভাবেই শেয়ারবাজারে বিনিয়োগ করি।'

Comments

The Daily Star  | English
Banking sector crisis

Why is the banking sector crisis so deep-rooted?

The regime-sponsored immorality to protect or pamper the financial gangsters not only eroded the future of the banking sector, but also made the wound too difficult to recover from.

5h ago