সুগন্ধা নদীতে লঞ্চে আগুনের ১ বছর, এখনো সহায়তা বঞ্চিত ভুক্তভোগী পরিবার

পুড়ে যাওয়া এমভি অভিযান-১০ লঞ্চ। ছবি: সংগৃহীত

ঢাকা-বরগুনা রুটে সুগন্ধা নদীতে অভিযান-১০ লঞ্চে অগ্নিকাণ্ডের এক বছর আজ। ভয়াবহ সেই স্মৃতি মনে করে এখনো শিউরে ওঠেন নিহতের স্বজন ও বেঁচে যাওয়া যাত্রীরা। 

এখনো কান্না থামছে না স্বজনহারা মানুষের। পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম মানুষকে হারিয়ে থমকে গেছে অনেক পরিবার। এদিকে, এখনো মেলেনি সরকারি সহায়তা।

গত বছর ২৪ ডিসেম্বর ভোরে ঝালকাঠির সুগন্ধা নদীতে ওই অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় মোট ৪৯ জন নিহত হন। তাদের মধ্যে ৩৭ জনই বরগুনার বাসিন্দা ছিলেন। ২৫ জনের মরদেহ পরিবারের কাছে হস্তান্তর করা হয়। 

অজ্ঞাত ২৪ মরদেহের মধ্যে ১৬ জনের মরদেহের ডিএনএ শনাক্ত করা হয়েছে। এখনো ডিএনএ রিপোর্ট মেলেনি ৮ জনের।

আগের সন্ধ্যায় ঢাকার সদরঘাট থেকে ৬ শতাধিক যাত্রী নিয়ে বরগুনার উদ্দেশে ছেড়েছিল অভিযান-১০ লঞ্চটি। রাত ৩ টার দিকে ঝালকাঠি জেলার আওতাধীন সুগন্ধা নদীতে ইঞ্জিন বিস্ফোরিত হয়ে পুরো লঞ্চে আগুন ধরে যায়

রতন বিবির হাহাকার

রতন বিবির (৬৫) ছেলে হাকিম শরীফ (৪৫) ঢাকায় একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে চাকরি করতেন। বাড়ি ফেরার পথে অভিযান-১০ লঞ্চে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় স্ত্রী পাখি বেগম আর ১৬ মাস বয়সের শিশু সন্তান নাসরুল্লাহসহ নিহত হন হাকিম শরীফ। 

তাদের মরদেহ দাফন করা হয় বরগুনার সদর উপজেলার পোটকাখালী এলাকায় গণকবরে। হাকিম শরীফের আরও ৩ সন্তান হাফসা বেগম (১৮), সুমাইয়া (১৬) ও ফজলুর রহমান (৯) এবং বৃদ্ধা মা রতন বিবি আছেন পরিবারে। 

পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম হাকিম শরীফসহ ৩ জনকে হারিয়ে এখনো নির্বাক রতন বিবি। সংসার চলছে ধার-দেনা আর আত্মীয় স্বজন ও প্রতিবেশীদের দান-অনুদানে।

রতন বিবি দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'এক বছর ধরে মানুষের সহায়তায় আমাদের পরিবারের ভরণপোষণ চলছে। ছেলের ৩ সন্তান পড়াশোনা করে। বড় নাতনী হাফসা কলেজে, ছোট নাতনী সুমাইয়া এবার এসএসসি পাস করেছে। আর ছোট নাতী ফজলুর রহমান তৃতীয় শ্রেণিতে পড়ছে। ওদের লেখাপড়ার খরচ চালাতে কষ্ট হয়।'

স্থানীয় ইউপি চেয়ারম্যান কিছুদিন আগে তাদের দুই বস্তা চাল দিয়েছিলেন জানিয়ে তিনি বলেন, 'এছাড়া সরকারি কোনো সহায়তাই পাইনি।'

এখনো বাবার মরদেহের খোঁজ পাননি মিরাজ

অন্ধ হাফেজ মিরাজুল ইসলাম তার অসুস্থ বাবাকে চিকিৎসা শেষে ওই লঞ্চে সেদিন ফিরছিলেন বরগুনায়। সঙ্গে ছিলেন তার মা, স্ত্রী ও একমাত্র মেয়ে। পরিবারের অন্য সবাই কোনোমতে বেঁচে ফিরলেও মারা যান তার অসুস্থ বাবা ইদ্রিস খান। তার মরদেহ পাওয়া যায়নি।

বরগুনার মাইঠা গ্রামের বাসিন্দা মিরাজ দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'আমি মা-বাবার একমাত্র সন্তান। বাবার লাশটাও যদি পেতাম তবুও সান্ত্বনা থাকতো। লঞ্চের সেদিনের সেই বিভীষিকাময় ঘটনা মনে হলে এখনো ভয় লাগে।'

বরগুনার পোটকাখালীতে অভিযান-১০ লঞ্চের নিহতদের গণকবর। ছবি: সোহরাব হোসেন/স্টার

সেদিন অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় বেঁচে যান গৃহবধূ মেহেরিনা কামাল। তিনি ডেইলি স্টারকে বলেন, 'আমার স্বামী ও একমাত্র সন্তান ফারিয়াকে নিয়ে কেবিনে ছিলাম। অন্যান্য যাত্রীদের চিৎকারে ঘুম ভেঙে গেলে নদীতে ঝাঁপ দিয়ে পরিবারের সবাই প্রাণে বাঁচি। তবে ঝাঁপ দিতে গিয়ে বাম পায়ের গোড়ালিতে ব্যথা পাই। এখনো ভালো হয়নি।'

সেদিনের পর প্রায় ৬ মাস রাতে তিনি ভালোভাবে ঘুমাতে পারেননি বলে জানান। 

ওই ঘটনার পর এখনো নিখোঁজ আছেন বরগুনা সদরের পরীরখাল এলাকার রাজিয়া সুলতানা ও তার ৮ বছরের শিশু নুসরাত। বছর পার হলেও এখনো মা ও বোনের মরদেহ পাওয়ার অপেক্ষায় আছেন রাজিয়া সুলতানার মেয়ে জান্নাতুল ফেরদৌসী। 

জান্নাতুল ফেরদৌসী ডেইলি স্টারকে বলেন, 'আমার মা ও ছোট বোন অভিযান-১০ লঞ্চে আগুনে পুড়ে মারা গেছেন। এখন তো আর মরদেহ পাওয়ারও সম্ভাবনা নেই। তবে যদি অন্তত মায়ের কবরটা পেতাম বা মায়ের মরদেহের একটি হাড়ও যদি পেতাম তাহলে বাড়িতে এনে দাফন করতাম।'

'১৪ জনের ডিএনএ ম্যাচ করেছে। কিন্তু সেই ১৪ জনের মধ্যে আমার মা নেই, বোনও নেই,' যোগ করেন তিনি।

যোগাযোগ করা হলে বরগুনার জেলা প্রশাসক হাবিবুর রহমান ডেইলি স্টারকে বলেন, 'ডিএনএ টেস্টের মাধ্যমে লঞ্চে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় নিখোঁজ ৩০ যাত্রীর মধ্যে ১৪ জনকে শনাক্ত করা হয়েছে।'

আর্থিক সহায়তারা বিষয়ে জানতে চাইলে জেলা প্রশাসক বলেন, 'পরিবারগুলোকে আর্থিক সহায়তার জন্য আমরা নৌ মন্ত্রণালয়ে আবেদন করেছি। যে কোনো সময় মন্ত্রণালয় থেকে এসব পরিবারকে আর্থিক সহায়তা দেওয়া হবে।'

 

Comments

The Daily Star  | English

India bans import of certain jute products, woven fabrics from Bangladesh via land ports

Today's action by DGFT came a little more than one month after India had imposed port restrictions on the import of certain goods like readymade garments and processed food items from Bangladesh via land routes

7m ago