সমরেশ মজুমদারের ‘দৌড়’, আমাদের থামায়
সমরেশ মজুমদারের প্রথম উপন্যাস 'দৌড়'। তখন সবে দেশ (১৯৭৬) পত্রিকায় ছোটগল্প লিখতে শুরু করেন। সত্তরের কলকাতার টালমাটাল সময় তখনও রয়ে গেছে। যুবক বয়সে সমরেশ লিখে বসলেন ছোট কলেবরের এই উপন্যাস। যাতে মিশে আছে সবে চাকরি হারিয়ে বসা তার বয়সী যুবকেরই কয়েকটা দিনের কথা।
তবে সমরেশ মজুমদারের লেখালেখির বিশাল জীবনের রূপান্তর বুঝতে 'দৌড়' উপন্যাসটি বেশ প্রাসঙ্গিক। ছোট কলেবরের উপন্যাস আমাদের সঙ্গে যেমন তরুণ লেখক সমরেশ মজুমদারের পরিচয় করিয়ে দেয়, তেমনি বাঙালী মধ্যবিত্তের সত্তরের রাজনৈতিক টালমাটাল সময়ের চিত্র বেশ ভালোভাবে ফুটে ওঠে। বিশেষ করে, রেসের মাঠে ঘোড়দৌড়ের প্রতিযোগিতাকে ঘিরে জুয়ার আসর আমাদেরকে নিয়ে যায়, লোভ ও ভাগ্যের এক রাজ্যে। যেখানটায় আমাদের দূষিত আত্মাগুলো আটকে আছে ভিন্ন ভিন্ন বেশে।
রাকেশ নামের সেই যুবকের গল্প পড়তে গেলে সত্তরের সময়কে দেখতে পাই। জানতে পারি, সেসময়ের কলকাতায় গজিয়ে ওঠা অর্থনৈতিক বৈষম্য কীভাবে প্রকট হয়ে উঠছে। তার মধ্যে গোলকধাঁধার মত এদিকে ওদিক ছুটে বেড়াচ্ছে প্রধান চরিত্র রাকেশ। কারণ পূর্বের ছাত্রজীবনে 'পলিটিক্স' করার দায়ে তার চাকরি চলে গেছে।
ক
প্রায় পঞ্চাশ বছরের লেখালেখির যাত্রা থেমেছে কাল। সমরেশের লেখাগুলো পড়লে খেয়াল হয়, প্রথম থেকেই তার উপন্যাসে রাজনীতির উপস্থিতি সচেতন ও পরিষ্কারভাবে এসেছে। গল্পের চরিত্রগুলোর জীবন পরিবর্তন হবার পেছনে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে রাজনীতি কাজ করে। সমরেশের সাহিত্যকে ব্যবচ্ছেদ করলে 'রাজনীতি' বিষয়টাকে আমরা একটা গুরুত্বপূর্ণ ও কার্যকরী বৈশিষ্ট্য হিসেবে দেখতে পাই।
'দৌড়' উপন্যাসের প্রধান চরিত্র একদিন হুট করেই দেখতে পান তার বিরুদ্ধে পুলিশের প্রতিবেদনে তার চাকরি চলে গেছে। প্রসঙ্গত সমরেশের ছাত্রজীবন থেকে রাজনীতিতে যুক্ত হবার কারণেই চাকরিচ্যুত করা হয়েছে তাকে। বড় কর্মকর্তা জয়সোয়াল সাহেবের রুম থেকে বের হতে হতে রাকেশ আশপাশ থেকে 'কোন পার্টি করতো?' ধরণের ফিসফিসানি শুনতে পান। তিনি বহু চেষ্টা করেন এটা বোঝাতে যে, তিনি কেন তার বাবাও কোনদিন রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত ছিলেন না। এমনকি বিশ্ববিদ্যালয়ে তার সিনিয়র একজন রাকেশ, যিনি কিনা এসব 'পলিটিক্স' করতেন, উনার সঙ্গে গুলিয়ে ফেলা হয়েছে বলে আকুতি জানানোর চেষ্টা করেন। কিন্তু এতে তেমন কিছু লাভ হয় না। রাতারাতি এই ঘটনার কারণে তার জীবনে আমূল পরিবর্তন আসে।
রাজনীতির সঙ্গে কর্মস্থলের সংযোগ স্থাপন ও 'একজনের পরিবর্তে একই নামের অন্যজন' কাউকে শাস্তি দেয়ার প্রবণতা দেখে মনে পড়ে, ২০১১ সালের ১৬ মার্চ ঝালকাঠিতে লিমন নামের একজন কিশোর মাঠে গরু আনতে যাবার সময় রাষ্ট্রের একটি আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর লোক এসে তাকে সন্ত্রাসী অভিহিত করে। নিজেকে সাধারণ ছাত্র হিসেবে পরিচয় দিলেও লিমনের বাম পায়ে গুলি করা হয়, পরে সেই পা কেটে ফেলতে হয় তার। সেদিনই তার বিরুদ্ধে দু'টো মামলা করে আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। ২০১৩ সালে ২টি মামলা তুলেও নেয়। এ যেন সমরেশের রাকেশ চরিত্রই লিমন হয়ে ঘুরে ফিরে আসা।
এই গল্পের প্রধান চরিত্রকে আমরা চাকরি হারানোর পর এক দোদুল্যমান অবস্থায় দেখতে পাই। অন্ধকার ভবিষ্যতের দিকে তাকিয়ে খবরটা প্রথম তিনি জানায় তার বান্ধবীকে। যে কিনা শরীরের অনেকটুকু প্যারালাইজড অংশ নিয়ে সারাক্ষণ শুয়ে থাকেন। রাকেশ জানে, এরকম পঙ্গু মেয়ের সঙ্গে তার কোন ভবিষ্যৎ নেই। তারপরেও তাকে ভালোবেসে যায় সে। ফোন করে চাকরি হারানোর কথা জানায়। বাজিতে জিতে যাওয়ার খবর জানায়। রাকেশ নামের এই তরুণ, যেন এক পঙ্গু সমাজকে ভালোবেসে যায় সেভাবেই, যেভাবে আমরা আমাদের ক্ষয়ে যাওয়া সমাজকে ভালোবেসে চলেছি।
সমরেশ মজুমদারের উপন্যাসগুলোতে রাজনীতি ও আন্দোলনের ছাপ কত প্রত্যক্ষভাবে ছিল তা বোঝা যায়, পরবর্তী বইগুলোতে। তার লেখা বহুলপঠিত কালবেলা ট্রিলজিতে তৎকালীন কলকাতার প্রত্যক্ষ রাজনীতি উঠে এসেছিল। উত্তরাধিকার, কালবেলা এবং কালপুরুষ ১৯৭৯ থেকে ১৯৮৯ সালের মধ্যে প্রকাশিত হয়। দেশ পত্রিকায় ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত কালবেলার জন্য তিনি সাহিত্য একাডেমি পুরস্কার লাভ করেন।
খ
'দৌড়' উপন্যাসে সমরেশ মজুমদার এক যুবকের চরিত্র দিয়ে সত্তরের দশকের অদ্ভুত সময়কে ধরেছেন। যেখানে রাজনীতির কারণে চাকরিচ্যুত হওয়া খুব সাধারণ ব্যাপার। এর বাইরেও বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময় সুহাস নামের যেই লোকটার শিল্প সাহিত্যের প্রতি ছিল দারুণ ঝোঁক, তিনিই কিনা বনে গেছেন তুখোড় জুয়াড়ি হিসেবে। হালের জনপ্রিয় ঘোড়দৌড় প্রতিযোগিতা ঘিরে যেই জুয়ার আসর বসে, সেখানে তিনি দেখতে পান টাকার কুমির রায় সাহেবকে। আবার দেখতে পান সহায় সম্বল হারিয়ে বসে থাকা অরুণ লাজুকভাবে বলে, 'কাউকে বোলো না যে এখানে আমি আসি'।
'হিন্দ সিনেমার সামনেই ট্যাক্সি পেয়ে গেলেন সুহাসদা। ট্যাকসিতে বসেই সুহাসদা বললেন, 'রেসকোর্স – জলদি যাইয়ে সর্দারজী', রেসকোর্স! রাকেশ এতক্ষণে বুঝতে পারল ওরা কোথায় যাচ্ছে! কেমন একটা অস্বস্তি আর সেই সঙ্গে কৌতূহল টের পেল রাকেশ। আজ এই ক'বছর ও কলকাতায় আছে, রেসকোর্সে যাবার কথা মনেই আসেনি একবারও। রেস শব্দটার মধ্যে কি একটা গোপন অপরাধবোধ সংস্কারে জড়ানো আছে, ঠিক পরিষ্কার করে চে'চিয়ে বলা যায় না আমি রেসে যাচ্ছি। সুহাসদার দিকে তাকাল রাকাশে। সেই সুহাসদা, বাংলা সংস্কৃতি ও সাহিত্য যার নখস্ত সেই সুহাসদা এখন চকোলেট স্যুট পরে ট্যাক্সির জানলায় হেলান দিয়ে রেসবুকের পাতা উল্টে যাচ্ছেন একমনে'।
সমরেশ মজুমদার সময়কে তুলে ধরার খুঁটিনাটি বিষয়ে দেখলে অবাক হতে হয়। সত্তর ও আশির দশকে এ অঞ্চলে উপন্যাসগুলোর বর্ণনায় খুঁটিনাটি বিষয়বস্তু দেখানোর প্রবণতা বেশি একটা ছিল না। তবে সমরেশ বিস্তারিত লেখার সময় সেটিকে আরোপিত করে তোলেননি; বরং বিষয়গুলো লেখাকে আরও বেশি প্রাণবন্ত করেছে। মাত্র কয়েক লাইনে তিনি লাইব্রেরিতে রাখা যেই ম্যাগাজিনটার বর্ণনা দিয়েছেন, তা পড়লে শুধু সেই সময়কে ধরা যায় তা নয়; বরং পাঠককে নিয়ে যায় সেই লাইব্রেরিতে।
'একটা রঙিন ম্যাগাজিন খুলে বসল ও। পাতা ওল্টাতে ওল্টাতে একটা কালার ছবিতে ওর চোখ আটকে গেল। একটা রায়টের দৃশ্য। সাদামুখো অ্যামেরিকান পুলিশ তেড়ে আসছে রাইফেল উঁচিয়ে আর নিগ্রো মেয়ে শরীর বেঁকিয়ে হাতের বই ছুড়ে মারছে তাদের দিকে। বইটে এখন শূন্যে ঝুলছে। কি বই ওটা?'
একটা অনুচ্ছেদেই রঙিন ছবি আর বর্ণবাদের মধ্যে পুলিশের বিপরীতে বই ছুঁড়ে দেয়ার মত আন্দোলনের ছবি হয়তোবা সমরেশই আঁকতে পারতেন।
এই বইয়ের গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয় হলো, প্রেম, সংসার ও ক্ষোভ। তবে যেভাবে এখানে প্রধান চরিত্রের আশেপাশে তিনটি নারী চরিত্রকে আবর্তিত করা হয়েছে, তা অনেকক্ষেতে অবাস্তব ও মধ্যবিত্তের 'ফ্যান্টাসি জীবন' বলেই মনে হয়। কারণ চাকরি হারা রাকেশ চরিত্রকে উপন্যাসের অর্ধেক পথ পর্যন্ত বেশ বাস্তবিক ও শান্ত মনে হলেও, উপন্যাসের পরের অংশে আকস্মিকভাবেই অশান্ত ও ফ্যান্টাসি জগতের বাসিন্দা বলে মনে হয়। যদিও মধ্যবিত্ত পরিবারের আর্থ-সামাজিক অস্থিতিশীল অবস্থানকে পরিস্ফুটিত করতে হয়তোবা সমরেশ এই ফর্মুলায় গল্প ফেঁদেছিলেন।
সমরেশ মজুমদার বেশ বিখ্যাত কিছু উপন্যাস লিখলেও প্রথম উপন্যাসটি তার সাহিত্য চর্চায় প্রাসঙ্গিকই থেকে গেছে। তাই হয়তো এই বইয়ের ভূমিকায় লিখেছেন- 'দৌড় আমার প্রথম উপন্যাস, প্রথম প্রেমে পড়ার মতো। অথচ গল্প লিখছি অনেকদিন। …অদ্ভুত ব্যাপার, উপন্যাস লেখার কথা ভাবিনি কখনো'। তারপর সাগরময় ঘোষকে লিখলেন আরও দুটো লাইন। 'মাছেরা কি ঝর্ণার কাছে ঘুরে ফিরে কৃতজ্ঞতা জানায়? কি জানি। শুধু জানি, ওদের জলজ বলা হয়ে থাকে'।
Comments