পাঠের আনন্দে সমরেশ থাকবেন
খুব সহজ, স্বাভাবিক ভঙ্গির মধ্যেই অসাধারণত্ব সৃষ্টির, পাঠকের গভীরে আঁচড় কাটার অদ্ভুত একটা ক্ষমতা ছিল সমরেশ মজুমদারের। ভাষার কেরদানি নয়, নয় অতিকথন, চেষ্টাকৃত বাহুল্য নয়, যেন একজন মানুষ মুখোমুখি বসে গল্প করছে এমন। এই সহজ স্বাচ্ছন্দ্য, এই অবারিত স্পষ্টতাই সমরেশ মজুমদারকে দিয়েছে তুমুল পাঠকপ্রিয়তা।
স্মরণ করতে পারি, আশি ও নব্বই দশকের তরুণ-তরুণী মানে আমরা, বুঁদ হয়ে থাকতাম সমরেশে। স্বভাবতই, একা ছিলেন না তিনি। সুনীল, শীর্ষেন্দু, বুদ্ধদেব গুহ, সঞ্জীব এবং পরবর্তীকালে হুমায়ুন আহমেদের সঙ্গেও প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে হতো। কিন্তু কী সুন্দর সময় ছিল, সেই প্রতিদ্বন্দ্বিতার মধ্যে কোনো তিক্ততা ছিল না, অসূয়া ছিল না। এ যেন ছিল বই পড়ার, ঋদ্ধ ও আনন্দিত হবার এক প্রতিযোগিতা। কোথায় হারাল সেসব দিন।
প্রাসঙ্গিক একটা উদাহরণ দিয়ে বিষয়টা পরিষ্কার করা যাক: 'জ্বলন্ত অবস্থায় সায়ন কোনওমতে ম্যাডামের পা স্পর্শ করতে পারল। জ্বলন্ত পা। জ্বলন্ত আগুনের সেই রথ ক্রমশ আকাশ অধিকার করতে ওপরে, আরও ওপরে উঠে যাচ্ছিল। ঈশ্বর বলে কেউ যদি কোথাও থাকেন তাহলে তিনি বিপন্ন বোধ করছিলেন অবশ্যই। এই আগুন যদি আরও দীর্ঘতর হয় তাহলে তাঁর স্বর্গের অস্তিত্ব লোপ পাবে। নিরাপদে ফিরে গিয়ে ছেলে চারটে মশগুল ছিল। ছিনতাই করা একটা জিপ তাদের আড়াল করতে অনেক গল্প সাজাবে। ওরা কেউ পেছনে তাকায়নি তাই অগ্নিরথ দেখতে পায়নি। ওরা কেউ সামনে তাকাবে না তাই লক্ষ লক্ষ অগ্নিরথের অস্তিত্ব টের পাবে না।'
সমরেশ মজুমদারের নিবিষ্ট পাঠক উপরের উদ্ধৃতিটি কোন বই থেকে নেয়া সেটি চট করে ধরতে পারবেন। উত্তরাধিকার, গর্ভধারিণী, কালবেলা, কালপুরুষের আড়ালে ঢাকা পড়ে থাকা একটি উপন্যাস। অগ্নিরথ। অনেকেই সমরেশের অন্যতম সেরা সৃষ্টি বলে মনে করেন একে। রক্ষণশীল পরিবারের সন্তান সায়ন। ব্লাড ক্যান্সারে আক্রান্ত। চিকিৎসার উদ্দেশ্যে পাহাড়ে এসেছে। এখানেই তাকে ঘিরে জন্ম নেয় অনেক মিথ। কেউ কেউ তার চেহারায় খুঁজে পায় যিশুর আদল। মানুষের মধ্যে লুকিয়ে থাকা হিস্রতার বলি হয় একদিন সায়ন। দুর্বৃত্তদের আগুনে কেবল পরহিতকামী বিদেশিনী নারী এলিজাবেথই কেবল নয়, গ্রাস করে নেয় শুদ্ধতার প্রতীক সায়নকেও।
উপরের উদ্ধৃতিটি অগ্নিরথের শেষ অনুচ্ছেদ। কেবল সায়ন আর এলিজাবেথের শরীরে নয়, পাঠকদের হৃদয়ানুভূতিতেও অগ্নিশিখার প্রজ্বলন ঘটায় লাইন ক'টি। বহু দিন, মাস, বছর কেটে যায়, অগ্নিরথের পাঠকরা ভুলতে পারেন না অসহায় সায়ন আর ধর্ষিতা এলিজাবেথের আগুনে পুড়ে মরার দৃশ্যটি। সমরেশ এভাবেই অধিকার করে রাখেন তার পাঠকদের। রাখবেন আরও বহুদিন।
সমরেশ মজুমদারের দীর্ঘ সাহিত্য-যাত্রার শুরু যে উপন্যাসটি দিয়ে সেটির নামটি খুবই যথার্থ। দৌড়। উপন্যাসের উৎসর্গে লিখেছিলেন: 'দৌড় আমার প্রথম উপন্যাস, প্রথম প্রেমে পড়ার মতো'। এ উপন্যাসের শেষটাও মনে রাখার মতো: 'মেয়েদের চোখের দৃষ্টি মাঝে মাঝে এক হয়ে যায় কি করে! মায়ের, নীরার অথবা এখন এই জিনার? যে চোখ শুধুই বলে- ভালো থেকো, ভালো থেকো, ভালো-
ঈশ্বর, তবে কেন বুক জ্বলে যায়!'
উত্তরাধিকার, কালবেলা, কালপুরুষ- এই ত্রয়ী উপন্যাসের ওপরই বোধ করি দাঁড়িয়ে আছে সমরেশ মজুমদারের পাঠকপ্রিয়তার সৌধ। অনিমেষ আর মাধবীলতা, সমরেশের পাঠকের কাছেই প্রিয় দুটো নাম। অনিমেষ নামে এক মফস্বলী তরুণের উচ্চশিক্ষার জন্য কলকাতায় পা রাখা, রাজনীতির অগ্নিগর্ভ পরিবেশের সঙ্গে পরিচিত- সেই সঙ্গে আত্ম-অনুসন্ধানের গল্প উত্তরাধিকার। অনেকটা 'কামিং অব এজ' ঘরানার উপাখ্যান, বাস্তবতা সম্বন্ধে ধারণাহীন সহজসরল এক তরুণের উপলব্ধির উন্মেষকালের গল্প উত্তরাধিকার। তারপর কালবেলা।
পাঠকপ্রিয়তার তুঙ্গস্পর্শী এক উপন্যাস। রাজনীতিতে অনিমেষের কঠিনভাবে জড়িয়ে পড়া, আদর্শের সঙ্গে বাস্তবতার বিপুল ফারাক উপলব্ধিজনিত হতাশা এবং তারপর তার জীবনের এক উজ্জ্বল উদ্ধার, যার নাম মাধবীলতা। মাধবীলতা যেন তার জীবনের ধ্রুবতারা; ঝড়, ঝঞ্ঝা, সমস্ত প্রতিকুলতার মধ্যে যে অনিমেষকে স্থিতধী করে রাখে। কালবেলা আমাদের জানায়, বিপ্লব ও প্রেম পরস্পরবিরোধী হতেই হবে এমন কথা নেই, পরম বিশ্বাসে একে অন্যের হাতে হাত ধরেও তারা চলতে পারে। কালবেলার পাঠকরা কি কখনও ভুলতে পারবেন সেই উক্তি: বিপ্লবের আরেক নাম মাধবীলতা! এই ট্রিলজির তৃতীয় উপন্যাস কালপুরুষ।
প্রজন্ম বদলে গেছে। রিলে রেসের দৌড়বিদের মতোই অনিমেষের হাত থেকে ব্যাটন তুলে নিয়েছে তার পুত্র অর্ক। নিজের আদলে পুত্রকে গড়তে চেয়েছিল অনিমেষ, কিন্তু পঙ্কিল সমাজব্যবস্থার ঘূর্ণাবর্তে পড়ে অর্ক হয়ে পড়ল সমাজবিরোধী। চরম দারিদ্র্যের সঙ্গে লড়াই করতে থাকা অনিমেষের কাছে জীবনটাকে মনে হয় ট্র্যাজিক কোনো উপন্যাসের মতো। কোথাও আলোর কোনো রেখা নেই। অভাব, দারিদ্র্য, অসুস্থতা, পুত্রের বিপথগামিতা-একের পর এক বিপর্যয়ে পর্যুদস্ত তার জীবন। কিন্তু শেষমেষ মেঘের আড়ালে সুবর্ণরেখার মতোই এক টুকরো স্বস্তি হয়ে আসে পুত্র অর্কের আত্মোপলব্ধি।
সমরেশের আরেক স্মরণীয় সৃষ্টি সাতকাহন। বহু প্রতিকুলতার পাহাড় ডিঙিয়ে এক নারীর এগিয়ে চলার গল্প সাতকাহন। নাম তার দীপাবলি। যেন জ্বলজ্বলে এক অগ্নিশিখা। কাঁটা বিছানো পথ। সমাজ, পরিবার, স্বজন- সবাই যেন বাঁধার সঙ্গিন উঁচিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। দ্বিধা আর সংগ্রাম নিজের সঙ্গেও। তবু অগ্নিবলয় অতিক্রম করে স্থির সংকল্প নিয়ে এগিয়ে যায় দীপাবলি। সকল নারীই যেন দীপাবলির মধ্যে নিজেকে আবিষ্কার এবং পুনরাবিষ্কার করেন। মানুষ স্বর্গদূত নয়। দীপাবলির মধ্যেও আছে মানবীয় ত্রুটি। কিন্তু তার মধ্যে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে থাকার যে জেদ, সেটিই তাকে অনন্যতা দিয়েছে। তার দিকে তাকিয়ে অনেক নারী ভাবতে শিখেছে, 'দুঃখ, মৃত্যু, বিরহদহন' সত্ত্বেও মুখ থুবড়ে পড়ে থাকা যাবে না। পরিস্থিতি যাই হোক, এগিয়ে যেতে হবে। একটা প্রজন্মের অসংখ্য নারী দীপাবলি হতে চেয়েছে। সব মিলিয়ে সমরেশের সৃষ্ট চরিত্রগুলোর মধ্যে দীপাবলি অনন্য, যা উপন্যাসটিকেও একটি স্বতন্ত্র মর্যাদা দিয়েছে।
ঢাকা কলকাতা মিলিয়ে সমরেশ মজুমদারের অসংখ্য পাঠক। লেখার অনায়াসভঙ্গী, মনে রাখার মতো চরিত্র, গল্পের শক্তি- এসবই বিপুলসংখ্যক মানুষকে সমরেশ-ভক্ত বানিয়েছে। ছিদ্রান্বেষীরা হয়তো সমরেশের লেখায় খুঁত আবিষ্কারে প্রবৃত্ত হবেন। আতশকাচের নিচে ফেলে দেখানোর চেষ্টা করবেন, কেন তিনি কালোত্তীর্ণ সাহিত্যিক নন। কিন্তু এহ বাহ্য!
পাঠক কবে সমালোচকের সমালোচনা পড়ে কোনো লেখকের লেখাকে ভালোবেসেছে? কিংবা দূরে ঠেলে দিয়েছে? সমরেশ তার বিপুল পাঠককে সৃষ্টি করেছেন নিজের মেধা, জীবনবোধ আর গল্প বলার দক্ষতায়। ধারণা করি তিনি নিজেও কখনো অসাধারণের, অভিজাতদের, মুষ্টিমেয় কয়জনের গল্প বলিয়ে হতে চাননি। নিজেকে আবদ্ধ রাখতে চাননি এমন কোনো কুঠুরিতে, যেখানে কেবল সাহিত্যের উচ্চমানের প্রবেশাধিকার আছে। তিনি হতে চেয়েছেন সব মানুষের কথাকার। যে সময় ও সমাজকে খুব কাছে থেকে দেখেছেন, সেটিকেই ফুটিয়ে তুলেছেন গল্প ও উপন্যাসের ফ্রেমে।
তিনি ছিলেন বস্তুত শহুরে জীবনের কথাকার। কারণটিও সহজেই বোধগম্য। উত্তরবঙ্গের মফস্বলে জন্ম নেয়া ও জীবনের বৃহদাংশ কলকাতায় কাটিয়ে দেওয়া সমরেশের কাছে শহরের মানুষের জীবনবাস্তবতা ছিল কাছ থেকে দেখা, হৃদয় দিয়ে অনুভব করা। ফলে যখন গল্প বলতে গেছেন। চিরচেনা সেই মানুষগুলোই ধরা পড়েছে তার গল্পের ক্যানভাসে। এ কারণেই অনিমেষ, মাধবীলতা, অর্ক, দীপাবলি ইত্যাদি চরিত্র এত বাস্তবসম্মত। মনে হয় যেন বইয়ের পৃষ্ঠা ছেড়ে বেরিয়ে এসে পাঠকের মুখোমুখি বসেছে তারা। প্রগাঢ় আন্তরিকতায় বলে যাচ্ছে নিজেদের গল্প এখানেই কথাকার সমরেশ মজুমদারের অনন্যতা। তত্ত্ব আর তথ্যের ডামাডোলে পাঠককে বিচলিত করেন না, 'আমাকে পড়তেই হবে'- এমন দাবি নিয়ে তাদের ওপর জেঁকে বসতে চান না। খুব নির্মোহ ভঙ্গিতে, আলাপচারিতার ঢঙে গল্প বলতে শুরু করেন। পাঠক টেরও পান না, কখন তিনি বাধা পড়ে গেছেন সমরেশের গল্পের জাদুতে। একসময় গল্প শেষ হয়। চরিত্রগুলো মাথার মধ্যে ঘুরতে থাকে। গল্পটাও।
সমরেশ মজুমদারের সৃষ্টিসম্ভার বিপুল। লিখেছেন দুহাতে। গল্প, স্মৃতিকথা, ভ্রমণকাহিনী। তার লেখা 'কইতে কথা বাধে' বইটির কথা মনে পড়ে। নামকরণের ক্ষেত্রে বাধলেও, বলার ক্ষেত্রে কোথাও বাধাবন্ধন মানেননি লেখক। নানা বিষয়- হোক সেটি ধর্ম, সংস্কার, রাজনীতি, দেশ ও সমাজ- নির্দ্বিধায় বলে গেছেন নিজের বিশ্বাস, অবিশ্বাস, ভালো লাগা-মন্দ লাগার কথা। অনেকেই কেবল সমরেশের উপন্যাসগুলো পড়েছেন। তাও সুপরিচিত উপন্যাসগুলো। কিন্তু তার বিশাল গল্পসম্ভার কিংবা নন-ফিকশনগুলো পড়ে দেখেননি। আমি নিশ্চিত, সমরেশের আত্ম-উপলব্ধিমূলক লেখা, ভ্রমণকাহিনী ইত্যাদিও তাদের সামনে ভাবনার নতুন দরজা খুলে দেবে।
এসব অমূল্য সম্পদ রেখে নশ্বর জীবন ছেড়ে অবিনশ্বরতার পথে যাত্রা করেছেন জীবনশিল্পী সমরেশ। অসংখ্য পাঠক স্মৃতিময়তার ভেসে স্মরণ করছেন তাকে। জীবনের অবিস্মরণীয়, ফুল্ল কিছু মুহূর্ত উপহার দেওয়ার জন্য কৃতজ্ঞতা জানাচ্ছেন। হয়তো খ্যাতি নয়, কীর্তি নয়, সচ্ছলতা নয়- এটুকুই চেয়েছিলেন সমরেশ।
অজস্র পাঠকের ভালোবাসার মুকুট পরে রাজার মতোই বিদায় নিলেন। প্রিয় লেখক, শেষ বিদায়ের শ্রদ্ধা আপনাকে। সগৌরবে বেঁচে থাকবেন অনিমেষ, মাধবীলতা, দীপাবলি, সায়ন ও অর্কের মধ্যে।
Comments