তরুণদের কেন বইমেলায় যাওয়া উচিত
মেলার আজ ১০ম দিন। বইমেলায় কারা যায়? প্রকাশকদের আয়োজনে লেখক ও পাঠকরা! প্রজন্মের লেখক-পাঠকদেরও মেলায় বেশ ভিড় থাকে। পাঠকদের আরও যাওয়া উচিৎ। বয়স্করাও যান। হেঁটে দেখেন চারপাশ, বই কেনেন। তরুণীরা সেজে-গুজে ঘুরে বেড়ান বইমেলায়। মায়েরা সন্তানদের নিয়ে যান বিশেষ করে ছুটির দিনে। প্রকাশকরা নানান রঙ্গিন সাজসজ্জায় সাজান বইমেলার স্টল ও প্যাভিলিয়ন। সব মিলিয়ে একটা আনন্দঘন উৎসবমুখর পরিবেশ।
আমি কেন বইমেলায় যাই? প্রশ্ন করলাম নিজেকে। উত্তর অনেক। মেলায় না গিয়ে থাকতে পারি না। বইয়ের পরিবেশে সারাক্ষণ ঘেরাও থাকবো- এর চাইতে বড় পাওয়া কী হতে পারে? কয়েকজনকে প্রশ্ন করলাম। কেউ বলেছেন বইয়ের ঘ্রাণ নিতে। কেউ পছন্দের লেখকের ছবি নিতে। কেউ আনন্দে নতুন বই সংগ্রহ করতে। প্রিয় লেখকদের সাথে দেখা করতে। মেলায় সেলফি তোলা একজনকে বললাম- সেলফি তুলতেই আসেন? হেসে জবাব দিলেন, প্রিয় মানুষের সাথে ছবি তোলা গেলে, প্রিয় বইয়ের সঙ্গে সেলফি তুলতে কী সমস্যা?' কথা বাড়ালাম না।
বইমেলায় সাংবাদিক যায় খবর সংগ্রহ করতে, ফিচার লেখক ফিচারের অনুষঙ্গ পেতে, পাঠক বই কিনতে, প্রকাশক বই কতটুকু বিক্রি হলো খবর নিতে, লেখক অটোগ্রাফ দিতে, বাদামওয়ালা যায় বাদাম বেচতে, কেউ সেলফি তুলতে, প্রেমিক প্রেমিকা যায় হাত ধরে হাঁটতে। কারণ এমন অবারিত সুযোগ আর কোথায়? সারাদিন থাকলেও কোনো সমস্যা নেই!
এ এক অন্যরকম দৃশ্য! লাখ লাখ বইয়ের সংগ্রহ একসাথে। প্রতিটি দোকানের ডানে বায়ে কেবল বই আর বই। হাঁটতে হাঁটতে দোকানে দোকানে দাঁড়ায়। বই নাড়াচাড়া করে। দীর্ঘ সময় নিয়ে বইয়ের কিয়দংশ পড়ে। পছন্দ হলে বই কেনে। কিনতে না পারলে কেউ দাঁড়িয়ে হলেও পড়ে। পছন্দের বই সংগ্রহের জন্য এরকম বড় সংগ্রহ আর হতে পারে না। মেলায় বই পছন্দ করাও সহজ। কারণ অন্যরা কী বই কিনছে, কী বই নিয়ে কথা বলছে- সেসব দেখেও বই পছন্দ করতে পারে।
পাশাপাশি নানান মঞ্চ বা সংগঠন বা প্রকাশনীর আলোচনা সভা থাকে। সেখান থেকেও নতুন বই, বিভিন্ন লেখক ও লেখা সম্পর্কে জানা যায়। আলোচনা সভায় যোগ দিতে অনেকে যায়। অনেক সংগঠন নানান ধরণের ঘরোয়া ও অনানুষ্ঠানিক আড্ডার আয়োজন করেন। তারাও আসেন, আলোচনা-সমালোচনা করেন। এভাবেই সাহিত্য সংস্কৃতির সময় কেটে যায়। এছাড়াও প্রকাশক লেখক সাইনিং ইভেন্ট করেন। বইপ্রেমীদের জন্য এটি একটি সুবর্ণ সুযোগ।
বাস্তবে, বইমেলা থেকে মানুষ কী নিয়ে ফেরে? বইমেলায় যে পরিমাণ মানুষ হয় সে পরিমাণ বই বিক্রি হয় না। বেশিরভাগ বই না কিনে ঘুরেফিরে চলে আসে। এরপরেও আমি বলবো বইমেলায় যারা যায় তাদের মধ্যে অবশ্যই বইপ্রীতি আছে। কারও কম কারও বেশি। এমনকি যাদের বইয়ের প্রতি আগ্রহ নেই তাদের মধ্যেও বই নিয়ে এক ধরণের ইলিউশন তৈরি হয়। বই, স্টল, প্যাভিলিয়ন, বইমেলা ইত্যাকার ছবি, দৃশ্যকল্প মানুষের মনে, মননে, চিন্তায় রয়ে যায়। সুকুমারবৃত্তি চর্চার দিকে মানুষকে টানে। মানুষকে আলোর দিকে নিয়ে আসে। তাই তরুণদের বইমেলায় উৎসাহিত করা উচিত।
পুঁজিবাদের এ যুগে ও মোবাইল দাপটের সময়ে মানুষের জন্য সুন্দর পরিবেশ খুব কম। বইমেলা একমাত্র ব্যতিক্রম। সাহিত্য, সংস্কৃতি, পড়াশোনা, সাহিত্যালোচনা ইত্যাদি বিষয় ও অনুষঙ্গে দীর্ঘ সময় কাটানোর জন্য উত্তম জায়গা। এখানে মানুষের ইতিবাচক একটা পরিবর্তন আসবেই। বিশেষ করে কিশোর-কিশোরী ও শিশুরা বারংবার গেলে বইমুখী হবেই। প্রজন্মের মধ্যে বইপ্রীতি ঢুকিয়ে দিতে পারলে সমাজ পরিবর্তন সহজ হবে। অধিক শাসনে, ধমক দিয়ে মানুষকে পরিবর্তন করা যায় না। বরং বই মানুষকে ধীরে ধীরে মুক্তির দিকে নিয়ে আসে।
কেউ কেউ বলেন বইমেলায় অবশ্যই বই কেনা উচিত। আমি দ্বিমত পোষণ করি। মানুষের আসতে আসতে অভ্যাস হোক। বোধোদয় হবে বই কিনবে। দশটি না কিনলেও দুটি কিনবে। একটি হলেও পড়বে। না পড়ুক, বাসায় রাখলে অন্য কেউ না কেউ পড়বে। অপঠিত থাকে না। কেউ না কেউ পড়বেই।
আবার প্রকাশকদের মধ্যে এক ধরণের হতাশা দেখা যায়। বই বিক্রি হয় না; ক্ষতি। বাস্তবের যে অবস্থা তাতে তা মনে হয় না। কারণ প্রতিবছরই বই বিক্রি বাড়ে। গত মেলায় নতুন বই এসেছে মোট ৩ হাজার ৭৩০টি। গত বছরও এ সংখ্যা ছিল প্রায় সাড়ে তিন হাজার। বাংলা একাডেমির তথ্যমতে, ২০২৩ মেলায় ২৭ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত বিক্রি হয়েছে প্রায় ৪৭ কোটি টাকার বই।' ২০২৪ মেলায়ও দেখা যায়, প্যাভিলিয়নের সংখ্যা যেমন বাড়ছে, তেমনি আয়োজন চোখে পড়ার মতো।
তবে এটা বলা যায় যে, প্রকাশকগণ যথাযথ সম্পাদনের মাধ্যমে নির্বাচিত বই প্রকাশ করলে ও বইয়ের মার্কেটিং করলে বই বিক্রি বাড়তো। বুক রিভিউ করানো ও প্রকাশ করানো খুব জরুরি কাজ। যাতে পাঠকরা রিভিউ দেখে বই কেনে। মেলার শুরুর দিকে বইয়ের রিভিউ থাকা দরকার যাতে পাঠকরা মেলার শেষদিকে এসে বই কিনতে পারেন।
জার্নাল অব রয়েল এনথ্রোপোলোজিক্যাল ইন্সটিটিউটে প্রকাশিত একটি নিবন্ধে ব্রায়ান ময়েরান বইমেলাকে 'মূল্যবোধের একটি টুর্নামেন্ট' হিসেবে চিহ্নিত করেছেন। প্রকাশনা শিল্পে এর ভূমিকা পরীক্ষা করে বিশেষ করে প্রকাশনা চক্র এবং পাঠক সৃষ্টিতে এর সম্পর্ক বিশ্লেষণ করে উপসংহার টানেন। বইমেলা আমাদের মননের উৎকর্ষ সাধন করে ও ইতিবাচক মূল্যবোধ তৈরিতে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ ভূমিকা রাখে।
তাহলে কী দাঁড়ালো? 'মূল্যবোধ' তৈরি করতে বইমেলায় যাই! তরুণ প্রজন্ম সবার বইমেলায় যাওয়া উচিত। নিজের চিন্তার বিকাশ ও তারুণ্য জাগ্রত করতে। কবি জসীম উদ্দিন বলছেন, বই একমাত্র বন্ধু যে মানুষকে শুধু দিয়েই যায় বিনিময়ে কিছু চায় না। বই হলো এমন একটি মাধ্যম যা আমাদের কল্পনা শক্তিকে আরও বিস্তৃত করে। জানার আগ্রহকে বাড়ায়। বই পড়লে মানুষের মনুষ্যত্ব জেগে ওঠে।' এই জেগে উঠার জন্য আমিও যাই এবং যাব।
Comments