বইমেলা ঘিরে যেসব প্রত্যাশা
![](https://tds-images-bn.thedailystar.net/sites/default/files/styles/big_202/public/images/2025/02/02/03.jpg)
ফরাসি দার্শনিক রেনে দেকার্ত বলেছিলেন—'ভালো বই পড়া মানে বিগত শতকের সেরা সব মানুষের সঙ্গে কথা বলা।' একটি সুন্দর জাতি তৈরি করতে হলে বইয়ের বিকল্প নেই। একটি ভালো বই বহু মানুষের অনর্থক সঙ্গ থেকে উত্তম হতে পারে। প্রতিবছর 'একুশে বইমেলা' আসে। সেই মেলাকে ঘিরে তৈরি হয় বহু মানুষের স্বপ্ন-কল্পনা।
বইমেলার দর্শনার্থী বাড়লেও, সত্যিকার পাঠক কি বেড়েছে? নাকি বইগুলো সৈয়দ মুজতবা আলীর 'বইকেনা' গল্পের সেই ড্রয়িংরুম বিহারিণীর মতো! যাকে বই সাধলে নাসিকা কুঞ্চিত করে বলে, 'সেও তো ওঁর একখানা রয়েছে।' অথচ মার্ক টোয়েনের নাকি মেঝে থেকে ছাদ পর্যন্ত ছিল বই আর বই। সবযুগেই জনসংখ্যার হিসেবে বইকেনার লোক কম। তারও চেয়ে কম বইপড়ার লোক।
বর্তমান সময়ে এসে তা বলা আরও দুষ্কর। কেননা বর্তমান প্রজন্মের হাতে রয়েছে একেকটা বিশ্বলোক। তাদের বিশ্বদর্শন হচ্ছে ইলেক্ট্রনিক ডিভাইস। তবুও আমাদের রাজধানীতে মাসব্যাপী 'একুশে বইমেলা' পালিত হয়। একদিক থেকে তা আশাব্যঞ্জক, তারও চেয়ে আশাব্যঞ্জক বইমেলায় উপচে পড়া ভিড়। তার মানে বইয়ের প্রতি মানুষের আকর্ষণ রয়েছে। এখন এই আকর্ষণকে বাংলা একাডেমি কীভাবে কাজে লাগাতে পারে সেটাই বিবেচ্য।
বই কিনে ঘরে সাজিয়ে রাখা, শোপিস হিসাবে রেখে দেওয়ার প্রবণতা বেশি মানুষের। এটাও অন্যান্য লোক দেখানো সংস্কৃতির মতো। তাই বই কীভাবে পাঠের বিষয় হতে পারে, তা নিয়ে গবেষণা-অনুসন্ধান এবং তার ফল প্রকাশ করতে পারে বাংলা একাডেমি। বইমেলাকে কেবল স্টলে আবদ্ধ না রেখে তা ছড়িয়ে দিতে পারে বাংলাদেশময়। এমনকি বিশ্বের মধ্যে বাংলা ভাষার উৎপাদিত সম্পদ কীভাবে ছড়িয়ে পড়তে পারে তারও উপযুক্ত ভাবনা থাকা দরকার। অনেকে ভাববেন, এই কথাগুলো শুধু বলার জন্য বলা। আমাদের বেশিরভাগ কথাই তা-ই। হয়তো এই হৈচৈ থেকেই জন্ম নেবে ভবিষ্যৎ।
সাধারণত স্বৈরাচারী শাসকেরা প্রত্যেকটা জিনিসের দখলদারিত্ব চায়। ফলে বইমেলাকেও তারা বানায় রাজনীতির ঝান্ডা। তৈলমর্দনকারী লেখা বইও সংখ্যাতীত বেড়ে যায়। অনেকে বেমালুম ভুলে যান যে, তৈলযুক্ত বাঁশে ওঠার চেয়ে নামা সহজতর। এখন কথা হচ্ছে, বইমেলায় নানামতের মানুষ আসে, কাজেই সবার অংশগ্রহণ থাকা জরুরি। পাঠ বিবেচনায় সবাই পাঠক, কেউ কারো খোঁয়াড়ে বন্দি নয়
'২৪-এর জুলাই অভ্যুত্থানের পর মানুষের মধ্যে কিছু আশা জেগেছে। আর তা হলো সর্বস্তরে পরিবর্তন। তবে শ্যাম রাখি না কূল রাখি— অবস্থা এখন কোনও কোনও প্রতিষ্ঠান প্রধানের। কিন্তু মৌলিক পরিবর্তন ও সাম্যাবস্থা তৈরির জন্য এতো কিছু ভাবতে হয় না। এতো লোকের মন রক্ষারও প্রয়োজন পড়ে না। বেশি মনরক্ষা মানে কাজের গতি মাঠেমারা। বাংলা একাডেমির একুশে বইমেলা হোক সবধরনের জ্ঞানের জন্য উন্মুক্ত। সাধারণত স্বৈরাচারী শাসকেরা প্রত্যেকটা জিনিসের দখলদারিত্ব চায়। ফলে বইমেলাকেও তারা বানায় রাজনীতির ঝান্ডা। তৈলমর্দনকারী লেখা বইও সংখ্যাতীত বেড়ে যায়। অনেকে বেমালুম ভুলে যান যে, তৈলযুক্ত বাঁশে ওঠার চেয়ে নামা সহজতর। এখন কথা হচ্ছে, বইমেলায় নানামতের মানুষ আসে, কাজেই সবার অংশগ্রহণ থাকা জরুরি। পাঠ বিবেচনায় সবাই পাঠক, কেউ কারো খোঁয়াড়ে বন্দি নয়। জ্ঞানকে বেঁধে রাখা যাবে, এমন রশি কোথাও তৈরি হয়নি। বস্তুগত উন্নয়নের জ্ঞানকে হয়তো কুক্ষিগত করে রাখা যায় কিন্তু চৈতন্যকে আটকালে তা দানবীয় আকৃতিতে বাড়তে থাকে।আর স্বার্থপর জ্ঞানে জগতের কল্যাণ হয় না।
কাজেই সবধরনের জ্ঞানের বই বাজারে উন্মুক্ত থাকতে হবে। এখন বলতে পারেন, এক্ষেত্রে একাডেমির প্রচালককে হতে হবে মাছির মতো গোলাকার চক্ষুসদৃশ। এই প্রকার চোখ থাকলেই কেবল চারদিকের জিনিস একবারে দেখা যায়। যদিও এমন চোখ পাওয়া আর বাঘের দুধ মেলানো একই কথা। তবুও সোজা দেখার চোখ দুটোকে ধারণ করে আছে যে মাথাটা, তা একটু এদিক ওদিক করলে ক্ষতি কী? আমার বিশ্বাস, বর্তমান মহাপরিচালকের শুধু বাহ্যিক মস্তিষ্ক নয়, ভেতরেও শাঁসবস্তু রয়েছে। কেবল ত্রিমাত্রিক কার্যবিধি সম্পাদনের জন্য উপযুক্ত সহযোগিতা দরকার।
বইমেলার উদ্দেশ্য ছিল বইয়ের প্রচার, জনপ্রিয়তা বৃদ্ধি, সর্বোপরি প্রকাশকদের দিক থেকে বিজ্ঞাপন প্রচার। বইমেলা চালু হয়েছিল বাংলা একাডেমি ও জাতীয় গ্রন্থকেন্দ্র হতে। স্বতঃস্ফূর্ততার সঙ্গে হয়তো প্রকাশকদের পাটোয়ারিবুদ্ধিও তখন কাজ করেছিল। ফলে বইমেলা দিনে দিনে খুচরা বইয়ের বাজারে পরিণত হয়। অথচ বইমেলার প্রধানতম লক্ষ্য হওয়া উচিত লেখক-প্রকাশক চুক্তি, লেখক-পাঠক মতবিনিময়, ভালো বইয়ের প্রণোদনা, জ্ঞানের প্রচার ইত্যাদি।
বইমেলা এখন বিভাগীয় পর্যায় ছাড়িয়ে জেলা পর্যায়ে, এমনকি নাম না জানা স্থানেও হচ্ছে। এটা ভালো লক্ষণ। তবে হতাশার কথা হচ্ছে, পাড়ায় পাড়ায় একসময় যে ক্লাবঘরগুলো দেখা গিয়েছিল, সেসব এখন একশ্রেণির স্বার্থপর লোকের আড্ডাখানা হয়ে উঠেছে। বইকে কার্যকরি করতে হলে পাড়ায় পাড়ায় পৌঁছাতে হবে। হাতে হাতে মোবাইল ফোন আর গ্যাজেট-ডিভাইসের পরিবর্তে যেন দেখা যায় এদেশের প্রত্যেকটি শিশু কিশোর তরুণ কি বৃদ্ধের হাতে শুধু বই আর বই। কথাগুলো কাল্পনিক শোনা যাচ্ছে, কিন্তু উন্নত দেশে বাসে ট্রেনে কি বিমান-ভ্রমণেও মানুষের হাতে বই থাকে। এটা একটা সামাজিক আন্দোলন। বই ছাড়া মানুষের জ্ঞান বিকাশের কার্যকরি পথ নেই।
বইমেলা হতে পারে আমাদের স্কুলগামী শিশুকিশোরদের অবকাশ ভ্রমণের স্থান। দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে তারা যাতে বইমেলায় আসতে পারে, সেজন্য উপযুক্ত ব্যবস্থা নেয়া যেতে পারে। আমাদের বইমেলার পরিসর তো এখন বেশ বিস্তৃত। সচক্ষে ছেলেমেয়েরা বইয়ের সঙ্গ উপভোগ করতে পারলে তা জাতির জন্য মঙ্গলজনক। দেশের স্কুল কলেজ কর্তৃপক্ষও বিষয়টি ভেবে দেখতে পারেন। এখনকার ছেলেমেয়েদের হাতে বই তুলে দেয়া খুবই জরুরি। একটা সময় আমরা বই সংগ্রহ করে পড়তাম। পরস্পরের কাছে ধার নিতাম। এখন সেই সংস্কৃতি গেলো কোথায়?
দেশের বিভিন্ন স্থানে কিছু মানুষ নিজেদের উদ্যোগে পাঠাগার তৈরি করলেও, দেখা যায়, সেসবের পেছনে কোনো স্বার্থবুদ্ধি কাজ করছে। ফলে পাঠাগারে বইয়ের তুলনায় পিঁপড়ার সংখ্যা যতো দেখা যায়, মানুষের সংখ্যা তারচেয়ে কম। আবার নিঃস্বার্থভাবে কেউই পাঠাগার করছেন না, সেটাও পুরোপুরি সত্য নয়। কিন্তু সেই সংখ্যাটা বাড়ানো দরকার। ছেলেমেয়েদের বই পড়ার অভ্যাস তৈরি করার জন্য পরিবারের ভূমিকা অনেক বেশি। প্রত্যেকটি পরিবারকে একেকটি সংগ্রহশালা হয়ে ওঠা জরুরি। এই মুভমেন্টে সহায়তা করতে পারে বাংলা একাডেমি, জাতীয় গ্রন্থকেন্দ্র, পাবলিক লাইব্রেরির মতো প্রতিষ্ঠান।
আসলে বইমেলার পরিসর বড় হলেও প্রকৃত পাঠকের সংখ্যা বাড়েনি। প্রকাশনীগুলোও এক্ষেত্রে কম দায়ী নয়। তারা বইয়ের ব্যবসা বোঝেন, কিন্তু ভালো বইয়ের কদর বোঝেন না। বাজারে চলে না, এমন দোহাই দিয়ে বহুমূল্যবান পাণ্ডুলিপি চাপা পড়ে থাকে। শেয়াল-কুমিরের সেই গল্পের মতো দু চারটে কুমিরের ছানা দেখানো বই বের করে তারা মেলার স্টল বরাদ্দের একটা বন্দোবস্ত করতে চান। আবার কারো কারো পক্ষে মেলায় স্টল দেওয়া নিছক একটা সম্মানরক্ষার বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। ফলে প্রকৃত বইয়ের বাজার তৈরি হচ্ছে না। অনেক প্রকাশক বলেন যে, তাদের লাভ হয় না। তবুও প্রকাশনীর সংখ্যা হুহু করে বেড়েই চলেছে! একবার একজন প্রকাশককে জিজ্ঞেস করলাম, "আপনার বইয়ের বেচাবিক্রি কেমন?" তিনি বললেন, "কি আর বলবো? এর চেয়ে ক্যালেন্ডার ছাপাই সেটাই ভালো!"
তারা সাধারণত মন্ত্রণালয়ের লোক দেখলে খুশি হয়ে যান। এর পেছনে কারণ মন্ত্রণালয়ে ভুরি ভুরি ভালো লেখক থাকেন তা নয়, সরকারি বরাদ্দ পেলে কয়েক হাজার বই এমনিই ছাপা হয়ে যায়। সেই বইগুলোর দশা হয় গুয়ানতানামো কারাগারের কয়েদির মতো। সেগুলো শেলফে আজীবনের জন্য প্রবেশ করে, বের হয় না। ভালো বইয়ের বণ্টন চ্যানেল ও প্রচারণা এতোটাই দুর্বল যে, যে-কোনো প্রকাশনীর একক বই তিনশো কপি বিক্রি করাও দায় হয়ে পড়ে। অথচ ১৮ কোটি মানুষের প্রত্যেকে না হোক সবমিলে এক কোটি মানুষের হাতে বই গেলে কোনো প্রকাশককে মাথায় হাত দিতে হয় না।
স্থানীয় বই বিক্রেতারা যাতে সৃষ্টিশীল বইয়ের গুরুত্ব বুঝতে পারেন, সেই ব্যবস্থাটা দরকার। বইমেলার সঙ্গে তাদেরকেও সম্পৃক্ত করা জরুরি। আর শ্রেণিগত পাঠকের ধাক্কায় বইও এখন বর্ণ-সম্প্রদায়ে বিভক্ত। উচ্চবিত্ত শ্রেণি থেকে শুরু করে মধ্য ও নিম্নবিত্ত শ্রেণির, বিভিন্ন রুচির পাঠকের অভাব নেই। কেউ কেউ কেবল ইংরেজি ভাষার বই পড়েন। কেউ শুধু ধর্মগ্রন্থ বা নির্দিষ্ট পাঠের বিষয় পড়েন। এই বৈচিত্র্য বাড়ানো জরুরি। কেননা বহুমুখি জ্ঞান না হলে জগৎ ও জীবনকে বোঝা দায়!
সম্ভব হলে জাতীয় গ্রন্থকেন্দ্র, বাংলা একাডেমি ও প্রকাশনা সংস্থাগুলো মিলে ফ্রাঙ্কফুর্ট মেলার মতো একটি আন্তর্জাতিক বইমেলা করুক। যেখানে বিভিন্ন দেশের লেখকদের প্রতিনিধিরাও আসবেন। বাংলা একাডেমির মেলায় সেমিনার, মোড়ক উন্মোচন এসবের প্রয়োজন রয়েছে, কিন্তু তা জাতির আপামর সন্তানদের জন্য অধিকতর জ্ঞানবিকাশে প্রত্যাশী হয়ে ওঠা জরুরি। কিছু কিছু সংস্থার বইয়ের একচেটিয়া পুঁজিবাজারকেন্দ্রিক চিন্তাও তখন প্রশমিত হবে। বাড়াতে হবে সমৃদ্ধ লেখক ও বুঝদার পাঠকদের সম্মিলন।এতে বাংলা ভাষা সাহিত্য ও সংস্কৃতিকে আন্তর্জাতিকভাবে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া সম্ভবপর হবে বলে মনে করি।
শিক্ষক, বাংলা বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়।
Comments