কীভাবে বুঝবেন বন্ধু আপনাকে ঈর্ষা করে
সত্যিকারের সুস্থ, সুন্দর বন্ধুত্বের মাঝে কোনো 'কিন্তু' থাকে না, কোনো দ্বিধা-দ্বন্দ্ব কাজ করে না, কোনো লুকোছাপার প্রয়োজন পড়ে না। প্রাণের বন্ধুটিকে নিয়ে যেন সাত সাগরও পাড়ি দেওয়া যায়, জীবনের প্রতিটি মুহূর্তে মনে হয় বন্ধুটি কাছে থাকলে ভালো হতো। কিন্তু সবচেয়ে দৃঢ় বন্ধুত্বেও সংবেদনশীল কিছু জায়গা থাকে, আর কখনো কখনো সেই চ্যালেঞ্জের নাম হয় ঈর্ষা।
যদি আপনার কখনো মনেও হয় বন্ধু আপনার প্রতি ঈর্ষান্বিত, বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই দেখা যায় আপনি বিষয়টিকে পাত্তা দেননি বা ভেবেছেন আপনি ওভারথিংক করছেন। বাস্তবতা হলো, বন্ধুরা একে অপরের প্রতি প্রায়ই ঈর্ষা অনুভব করে। বিষয়টি অস্বস্তিকর হলেও সত্য। এই লুকানো অনুভূতিটি চিনতে পারলে এবং সামাল দিতে শিখলে বন্ধুত্ব অটুট রাখা সম্ভব।
বন্ধুত্বে ঈর্ষার মানে কী?
জীবনে কখনো না কখনো আমরা ঈর্ষা অনুভব করব—এটা খুবই স্বাভাবিক। কারো জীবনের এমন কিছু আমাদেরও চাইতে ইচ্ছে করতেই পারে যা আমাদের নেই। বন্ধুত্বের স্কেলে সবাই লেটার মার্ক পেয়ে পাশ করে যাবে, ব্যাপারটা মোটেও এমন না। অবসাদ কিংবা মানসিক বিষণ্নতায় থাকা মানুষের মধ্যে এই অনুভূতিগুলো খেয়াল করা গেলেও, এটি যে কারো ক্ষেত্রেই হতে পারে এবং এটি নিয়ন্ত্রণ করাও কঠিন।
বন্ধুরা সাধারণত এই বিষয়গুলোর কারণে ঈর্ষান্বিত হতে পারে:
● সম্পর্কের সাফল্য
● চেহারা বা ফ্যাশন-স্টাইল
● ভ্রমণ অভিজ্ঞতা
● ক্যারিয়ার ও পদোন্নতি
● আর্থিক অবস্থা
● অন্যান্য বন্ধুত্ব
● ব্যক্তিগত সম্পত্তি বা জীবনধারা
মনোবিজ্ঞানী আফটন টার্নার বলেন, হিংসাত্মক আচরণের পেছনে মূলত আত্মবিশ্বাসের অভাব কাজ করতে পারে। অর্থাৎ আপনার বন্ধুর হিংসার আসল কারণ আপনি নন—তবে এর প্রভাব আপনাকেই সামলাতে হয়।
একজন ঈর্ষান্বিত বন্ধু আপনাকে এমন অনুভূতি দিতে পারে যেন আপনি যথেষ্ট নন, যা প্রকৃত বন্ধুত্বের স্বভাববিরুদ্ধ। বিষাক্ত সম্পর্ক আমাদের মানসিক স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর। তাই হিংসার লক্ষণগুলো চেনা এবং তা সামলে নেওয়া গুরুত্বপূর্ণ।
আপনার বন্ধু গোপনে ঈর্ষান্বিত কি না বুঝবেন কীভাবে?
বন্ধুত্বের ক্ষেত্রে হিংসা প্রকাশ পায় আচরণ, কথাবার্তা এবং সামাজিক মেলামেশায়। যদি সন্দেহ হয় যে আপনার বন্ধু আপনার প্রতি ঈর্ষান্বিত, তবে কিছু নির্দিষ্ট লক্ষণ সাহায্য করতে পারে তা বুঝতে।
আচরণগত লক্ষণ
যখন আপনার জীবনে ভালো কিছু ঘটে, তখন তারা হয়তো আপনাকে এড়িয়ে চলে বা পরিকল্পনা থেকে বাদ রাখে। হিংসাত্মক বন্ধুদের মধ্যে এমন প্রবণতা দেখা যায় যে, তারা আপনাকে দলছুট করতে চায় অথবা এমন আলোচনায় মেতে থাকে যেখান থেকে আপনাকে দূরে রাখা হয়।
যোগাযোগের ধরন
একজন ঈর্ষান্বিত বন্ধু যোগাযোগের ক্ষেত্রে অস্বাভাবিক আচরণ করতে পারে। যখন আপনি ভালো সময় কাটাচ্ছেন, তারা অদৃশ্য হয়ে যায়, কিন্তু যখন আপনি সমস্যার মধ্যে থাকেন, তখনই তারা উপস্থিত হয়। তারা হয়তো ঠাট্টা-মশকরা, তুলনা, অনুভূতিকে অবহেলা করা বা অপরাধবোধ সৃষ্টির মাধ্যমে নিজেদের হীনমন্যতা প্রকাশ করছে, কিন্তু আপনার মানসিক স্বাস্থ্যের জন্য এটি অত্যন্ত ক্ষতিকর।
সামাজিক আচরণ
সামাজিক পরিবেশে এ ধরনের হিংসা আরও স্পষ্ট হতে পারে। তারা হয়তো আপনার সাফল্য নিয়ে উদাসীন থাকে, কিন্তু আপনার দুর্বলতা খুঁজে বের করতে অধিক আগ্রহী। এমনকি আপনার নতুন চাকরি বা সম্পর্কের খুঁত খুঁজে বের করতেও তারা উৎসাহী থাকতে পারে।
মানসিক আচরণ
দুঃখজনক হলেও সত্যি, কখনো কখনো ঈর্ষান্বিত বন্ধু তাদের নেতিবাচকতা নিজের মধ্যে রাখেন না। যখন কেউ আপনার সাফল্যের প্রতি ঈর্ষান্বিত হয়, তা আপনার ভালো মুহূর্তগুলোকে ম্লান করতে পারে এবং এমনকি আপনার আত্মবিশ্বাসকেও টলিয়ে দিতে পারে।
`ব্যক্তিগত অনিরাপত্তা ঈর্ষার কারণে আরও তীব্র হতে পারে," বলছেন টার্নার। তিনি উল্লেখ করেন, "ঈর্ষাপ্রবণ বন্ধুত্বে নিজের অসাফল্য এবং আড়ালে চলে যাওয়ার ভয় ঈর্ষাকে আরো বাড়িয়ে তুলতে পারে। এটি ক্যারিয়ার, চেহারা বা সম্পর্কের মতো ক্ষেত্রে আত্মবিশ্বাসে আঘাত হানতে পারে।"
একজন বন্ধুর ঈর্ষা পুরো বন্ধুত্বটিকেই প্রশ্নবিদ্ধ করতে পারে।
`যদি বিষয়টি নিয়ে কথা না বলা হয়, তা বন্ধুত্বকে দুর্বল করতে পারে বা পুরোপুরি ভেঙে দিতে পারে', সতর্ক করেছেন লে গয়।
টার্নার বলেন, `ঈর্ষা প্রায়ই যোগাযোগে সমস্যা সৃষ্টি করে, বিশ্বাস কমিয়ে দেয়, ক্ষোভ বাড়ায় এবং সম্পর্ককে ভারসাম্যহীন করে তোলে। এর ফলে বন্ধুত্বে মানসিক দূরত্ব তৈরি হতে পারে।'
আপনার বন্ধু কি আপনার চলার পথে বাধা হয়ে দাঁড়াচ্ছে?
ঈর্ষান্বিত বন্ধুদের আচরণ আপনার আত্মবিশ্বাসে প্রভাব ফেলতে পারে এবং নিজেকে সন্দেহ করতে বাধ্য করতে পারে। হিংসা কেবল বন্ধুদের সম্পর্ককেই নষ্ট করে না, বরং আত্মবিশ্বাস ও মানসিক শান্তির ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। ক্রমাগত সমালোচনা আপনার আত্মসম্মানবোধকেও দুর্বল করতে বাধ্য করে।
কীভাবে পরিস্থিতি সামলাবেন?
পরিস্থিতি মোকাবিলা করুন
যদি বন্ধুত্ব মূল্যবান মনে হয়, তবে আলোচনা করুন। কিন্তু নিশ্চিত হন, এটি এমন সম্পর্ক কি না যা আপনি টিকিয়ে রাখতে চান।
সম্পর্কের সীমারেখা নির্ধারণ করুন
বন্ধুত্ব মানেই সবসময় 'হ্যাঁ' বলা নয়, এটি হওয়া উচিত সম্মান ও পারস্পরিক সমর্থনের জায়গা।
প্রয়োজন হলে দূরত্ব তৈরি করুন
যদি বারবার আলোচনা করার পরও বন্ধু পরিবর্তিত না হয়, তাহলে হয়তো বন্ধুত্বের ইতি টানাই উত্তম।
বন্ধুত্ব প্রতিযোগিতা নয়, বরং একে অপরের সুখ-দুঃখ ভাগ করে নেওয়ার জায়গা। যদি হিংসার কারণে সম্পর্কের ভারসাম্য নষ্ট হয়ে যায়, তবে এটি নিয়ে অবশ্যই ভাবা উচিত।
Comments