বন্ধুর সঙ্গে কি প্রেমের সম্পর্কে যাওয়া উচিত

যে কোনো সম্পর্কের রসায়নই বেশ কঠিন একটা বিষয়। আর তা যদি হয় বন্ধুত্ব ও সেখান থেকে হওয়া প্রেমের সম্পর্ক তাহলে বিষয়টি বেশ জটিল হতে পারে।
বন্ধুর সঙ্গে প্রেম
ছবি: সংগৃহীত

ধরুন, কোনো এক বন্ধুর প্রতি আপনার ভালোলাগা কাজ করতে শুরু করল। বন্ধুদের আড্ডায় আপনি আবিষ্কার করলেন, সবাইকে বাদ দিয়ে বিশেষ একজনের প্রতি আপনার রাজ্যের মনোযোগ।

তার সাধারণ কোন টেক্সটের কোনো অন্তর্নিহিত ব্যাখ্যা আছে কি না তা আপনাকে সারাদিন ভাবাচ্ছে, প্রাত্যহিক যেকোনো আলাপে বারবার তার প্রসঙ্গ টেনে আনছেন। এখন প্রশ্ন হচ্ছে, আপনার কি এই ভালোলাগার ব্যাপারে কিছু করা উচিত? অনুভূতিগুলো দমিয়ে ফেলা উচিত? নাকি সাহস করে বন্ধুত্ব থেকে এক ধাপ এগিয়ে যাওয়ার পথে অগ্রসর হওয়া উচিত?

এই প্রসঙ্গে কথা হয় ২২ বছরের ইশফার কাদেরীর কাছে। তার মতে, তিনি সম্পর্কের ক্ষেত্রে খুব সতর্ক হয়ে পা ফেলেন। যার প্রমাণ আমরা তার কথাতেই পেলাম।

ইশফার বলেন, 'ভবিষ্যতে কী হবে তা তো বলা যায় না। এজন্য আমার মনে হয়, যদি বন্ধুত্ব থেকে প্রেমের ব্যাপারটা ঠিকমতো না এগোয় তাহলে প্রেমের সম্পর্ক তো যাবেই, পাশাপাশি খুব কাছের একজন বন্ধুকেও হারানোর আশঙ্কা তৈরি হতে পারে।'

অন্যদিকে বইপ্রেমী নাবিল হাসান, যিনি মাঝেমাঝে বিভিন্ন প্লাটফর্মে প্রেম-ভালোবাসা নিয়ে লেখেন, তিনি কিছুটা ভিন্ন অভিমত দিলেন।

'আমার দুজন বন্ধু যখন প্রেমের সম্পর্কে গিয়েছিল, আমি অবাক হওয়ার চেয়ে আনন্দিত হয়েছিলাম বেশি। আমার কাছে মনে হয়, যদি ভালোবাসা সত্য এবং সুন্দর হয়, তাহলে বন্ধুত্ব থেকে প্রেমে যাওয়াটা সমস্যা না', বলেন তিনি।

তাহলে কীভাবে এই 'বন্ধুত্বের সঙ্গে প্রেম' বিষয়টা কাজ করে?

আগে আমাদের বুঝতে হবে কারো সঙ্গে বন্ধুত্ব থেকে প্রেমের সম্পর্কে যাওয়ার ব্যাপারটা স্বাভাবিক এবং বন্ধুদের দুজন দুজনের সঙ্গী হওয়ার সম্ভাবনা আমাদের দৈনন্দিন জীবনে খুবই সাধারণ। পপ কালচারের অসংখ্য উদাহরণ এই প্রসঙ্গে উঠে আসতে পারে যেমন - হোয়েন হ্যারি মেট স্যালি, ফ্রেন্ডস, অলওয়েজ বি মাই মেবি, হ্যারি পটার ইত্যাদি। পাশাপাশি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমেও বন্ধুত্ব থেকে প্রেম বিষয়টির নিয়মিত আনাগোনা ও প্রাসঙ্গিকতা দেখা যায়।

বিভিন্ন গবেষণায় উঠে এসেছে, বেশিরভাগ মানুষ কোনো একজনের সঙ্গে যত পরিচিত হয়, দিন যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে তার প্রতি তত বেশি আকর্ষণ বাড়ে। এর পেছনে সম্ভাব্য কারণ এটা হতে পারে যে তাদের মধ্যে পরিচিতি ও বন্ধন যত সুগভীর হতে থাকে, অভিজ্ঞতা ও বিভিন্ন পারস্পরিক বিষয়ে সামঞ্জস্যতা খুঁজে পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে সম্পর্কের একটা শক্ত ভিত্তিও তৈরি হতে শুরু করে। এই ধরনের মানুষ বন্ধুর মতো সম্পর্কের বাইরে অন্য কাউকে ভালোবাসার মানুষ হিসেবে ভাবতে পারে না।

প্রসঙ্গত নিজের সুন্দর অভিজ্ঞতার কথা জানাতে গিয়ে স্নাতক শিক্ষার্থী নুসরাত পারিশা বললেন, 'আমার মনে হয় না যে ধরাবাধা ধারণা থাকা উচিত যে বন্ধুর সঙ্গে প্রেমের সম্পর্কে গেলে ভালো কিছু হবে না। আমার মতে প্রেমের সম্পর্কের শুরুতে ভালো বন্ধু হওয়াটা খুব গুরুত্বপূর্ণ। আমার নিজের ক্ষেত্রে এই ব্যাপারটা হয়েছে। ফলে আমার জন্য অনেক কিছু সহজ হয়েছে। আমি যেমন, আমার সঙ্গীর সঙ্গে যেন ঠিক তেমন সাবলীল থাকতে পারি এবং সময়টা যেন আনন্দে কাটে সেটা সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ এখানে।'

এতে কিছুটা আন্দাজ পাওয়া যায় যে হাল আমলের ডেটিং অ্যাপগুলোতে কেন অনেকেই মনের মত কাউকে খুঁজে পান না। যদিও বন্ধুকে ডেটে যাওয়ার আমন্ত্রণ জানানো অবশ্যই টিন্ডারে কারও সঙ্গে ম্যাচ হওয়ার চেয়ে বেশি ভীতিকর! তবে অন্য কারো চেয়ে বন্ধুর সঙ্গে প্রেমের সম্পর্কে জড়ানোর মাধ্যমে সত্যিকার ভালোবাসার খোঁজ মেলার সম্ভাবনাও বেশি। সুতরাং কোন পথটা আসলে বেছে নেওয়া উচিত, এই সাহসী সিদ্ধান্ত নেওয়ার ব্যাপারটা মোটেই সহজ নয়।

বন্ধুত্ব থেকে প্রেমের সম্পর্কে জড়ানোর কিছু বড় অসুবিধাও আছে। যেমন দুজনের মধ্যে যেকোনো একজন যদি শুধু প্রেমের বিষয়টা অনুভব করে তখন সেটা সমস্যার কারণ হয়ে দাঁড়ায়। আরও নানা অসুবিধা থাকে।  

এ বিষয়ে কথা হচ্ছিল তরুণ শিক্ষার্থী সৈয়দা জাহরার সঙ্গে।

তিনি বলেন, 'দুজন বন্ধুর মধ্যে অনুভূতি এবং মানসিক সংযোগ আসলেই অকৃত্রিম কি না, এটা শুধু অস্থায়ী একটি অনুভূতি কি না কিংবা গভীর বন্ধুত্বকেই প্রেমের অনুভূতি হিসেবে ভুলক্রমে ধরে নিয়ে এগিয়ে যাওয়া হচ্ছে কি না, এই বিষয়গুলো নিশ্চিত না হয়ে কখনও বন্ধুর সঙ্গে প্রেমের সম্পর্কে রাতারাতি জড়িয়ে পড়া উচিত নয়।'

আপনি ও আপনার বন্ধু হয়তো বন্ধুত্ব থেকে ভালোবাসার দিকে এগিয়ে যাওয়ার জন্য মানসিকভাবে প্রস্তুত এবং হয়তো আপনারা এই অগ্রযাত্রা থেকে সুন্দর একটা ফলাফলেরই প্রত্যাশা করছেন। কিন্তু পরে হয়তো আবিষ্কার করতে পারেন, আপনি বন্ধু হিসেবে যতটা ভালো, প্রেমিক-প্রেমিকা বা ভালোবাসার মানুষ হিসেবে ততটা নন।

এমন অভিজ্ঞতার কথা তুলে ধরলেন বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থী রাইনা শাহরিন, যিনি তার আশপাশে এমন অনেক ঘটনা দেখেছেন।

তিনি বলেন, 'বন্ধুত্ব এবং সামঞ্জস্যতা দুটি ভিন্ন বিষয়। যদি দুজন মানুষ অনেক ভালো বন্ধুও হয় তার মানে এই না যে তাদের প্রেমের সম্পর্কে অনেক ভালো বোঝাপড়া থাকবে। এসব ক্ষেত্রে ফলপ্রসূতা না থাকলে অযথা প্রেমের সম্পর্কে গিয়ে নিজেদের সুন্দর বন্ধুত্ব নষ্ট করার তো দরকার নেই।'

যদি বিচ্ছেদ ঘটে তখন কী হবে- এই প্রশ্নও এসে যায় এখানে। আর এটা সবাই বোঝে যে, অবশ্যই ফলাফল খুব মধুর কিছু হবে না।

এই ধরনের তিক্ত অভিজ্ঞতা হয়েছে শিক্ষার্থী রামাদান আব্দুল্লাহর।

তিনি বলেন, 'বন্ধুদের মধ্যে প্রেমের সম্পর্কের ক্ষেত্রে সাবধান থাকা উচিত। কারণ বিচ্ছেদ ঘটলে পুরো বন্ধুদের সার্কেলও ভেঙে যেতে পারে। কোথাও একসঙ্গে সব বন্ধু মিলে ঘুরতে গেলে অস্বস্তিকর পরিবেশ সৃষ্টি হতে পারে। কারণ বাকি বন্ধুদের সতর্ক থাকতে হবে যে কী বললে আপনি বা আপনার সদ্যপ্রাক্তন প্রেমিক বা প্রেমিকা অস্বস্তিতে পড়বেন না।'

সুতরাং সম্পর্ক ভাঙলে আপনি তো ভালো একজন বন্ধু হারাবেনই, সঙ্গে আপনাদের সার্কেলের অন্য সব বন্ধুও দুই দলে বিভক্ত হয়ে যাবে। যার ফলে অন্যদের সঙ্গে বন্ধুত্বে চিড় ধরার আশঙ্কা দেখা দিতে পারে।

যে কোনো সম্পর্কের রসায়নই বেশ কঠিন একটা বিষয়। আর তা যদি হয় বন্ধুত্ব ও সেখান থেকে হওয়া প্রেমের সম্পর্ক তাহলে বিষয়টি বেশ জটিল হতে পারে। বন্ধুত্ব থেকে প্রেমের সম্পর্কের দিকে এগিয়ে গেলে সেটা হয়তো একটা দীর্ঘস্থায়ী ভালোবাসার সম্পর্কের জন্ম দিতে পারে, কিন্তু অন্যদিকে এর ফলে বন্ধুত্বের প্রগাঢ়তা কমে গিয়ে ধীরে ধীরে তৈরি হতে পারে দূরত্ব। বন্ধুত্ব ছাড়াও আপনার সঙ্গীর প্রতি ভালোবাসার গভীরতা কতটুকু, সেটার উত্তর জানার মধ্যেই হয়তো এই যাত্রায় পা দেওয়া উচিত কি না তার ইঙ্গিত লুকিয়ে আছে।

অনুবাদ করেছেন সৈয়দা সুবাহ আলম

 

Comments