দিনাজপুরের ১০ দর্শনীয় স্থান

রামসাগর দিঘি। ছবি: ইউএনবি

রংপুর বিভাগের অন্তর্গত দিনাজপুর জেলাটি আবহমান কাল ধরে ধারণ করে আছে উত্তরবঙ্গের ইতিহাস ও সংস্কৃতি। রাজধানী থেকে ৪১৩ কিলোমিটার উত্তর-পশ্চিমে অবস্থিত সদর উপজেলার প্রধান নদী পুনর্ভবা। এই জেলার পূর্বে রংপুর ও নীলফামারী, পশ্চিমে ভারতের পশ্চিমবঙ্গ, উত্তরে ঠাকুরগাঁও ও পঞ্চগড় এবং দক্ষিণে রয়েছে জয়পুরহাট ও গাইবান্ধা জেলা।

১৭৮৬ সালে প্রতিষ্ঠিত দিনাজপুর শহর ভ্রমণ মানে শুধুই একটি অঞ্চলের ভৌগোলিক অবস্থান জানা নয়, অঞ্চলটির অতীতের সঙ্গে এক সেতুবন্ধনও বটে। এর প্রতিটি ইট আর দেয়ালের রঙ সরবে জানান দেয় ঐতিহাসিক ঘটনাগুলোর কথা। পাশাপাশি পরিচয় করিয়ে দেয় শহরবাসীর পূর্বসূরীদের। আজকের আয়োজনে থাকছে দিনাজপুর জেলার দর্শনীয় স্থানগুলো।

ঢাকা থেকে দিনাজপুর যাওয়ার উপায়

উত্তরাসহ গাবতলীর পথে ঢাকার বিভিন্ন জায়গা থেকে পাওয়া যায় দিনাজপুরের বাসগুলো। এগুলোতে মানভেদে ভাড়া ৫০০ থেকে ৯০০ টাকা।

আর ট্রেনে যেতে হলে কমলাপুর থেকে সন্ধ্যা ৭টা ৪০ অথবা সকাল ৯টা ৫০ মিনিটের টিকিট বুক করা যেতে পারে। সিটের ধরনভেদে এগুলোতে ভাড়া ১৮৫ থেকে ৮৯৭ টাকা পর্যন্ত নিতে পারে।

দিনাজপুরের ১০ জনপ্রিয় দর্শনীয় স্থান

রামসাগর দিঘি

বাংলাদেশের বৃহত্তম দিঘি হিসেবে পরিচিত এই জলাশয়টি মূলত একটি কৃত্রিম দিঘি। পলাশী বিপ্লবের কিছু পূর্বে রাজা রামনাথ রাজ্যের পানির চাহিদা মেটাতে খনন করেছিলেন এই দিঘি। রাজার নামানুসারেই দিঘিটি পরবর্তীতে পরিচিতি পায়। বর্তমানে এটি দিনাজপুর পর্যটন বিভাগের দায়িত্বে আছে।

প্রায় ৪ লাখ ৩৭ হাজার ৪৯২ বর্গমিটার ক্ষেত্রফল এবং ১০ মিটার গভীরতার এই দিঘির আশপাশে বিকেলে ঘুরে বেড়ানোর জন্য দারুণ জায়গা। এখানে সাঁতার কাটারও ব্যবস্থা আছে। পূর্ণিমার সময় ক্যাম্পিং করার জন্য রামসাগর বেশ জনপ্রিয় একটি স্থান।

শহরের প্রাণকেন্দ্র থেকে অটোরিকশা ভাড়া নিয়ে রামসাগর জাতীয় উদ্যানে যেতে ৩০ থেকে ৪০ মিনিট সময় লাগতে পারে।

কান্তজির মন্দির

বাংলাদেশের এই বিখ্যাত স্থাপনাটি নির্মিত হয়েছিল ১৮ শতকে, যার আরও একটি নাম নবরত্ন মন্দির। ঢেপা নদীর তীরে কান্তনগর গ্রামের অবস্থান। মন্দিরের শিলালিপি অনুসারে মহারাজা প্রাণনাথ রায় মন্দিরের কাজ শুরু করেছিলেন। ১৭২২ সালে তিনি মারা যাওয়ার পর তার পুত্র মহারাজা রামনাথ রায় ১৭৫২ সালে এর নির্মাণকাজ শেষ করেন।

প্রথমে মন্দিরটির উচ্চতা ছিল ৭০ ফুট। ১৮৯৭ সালের ভূমিকম্পে ক্ষতির কারণে এটি এখন ৫০ ফুট লম্বা। মহাভারত, রামায়ণ ও অন্যান্য পৌরাণিক কাহিনিগুলো মন্দিরের বাইরের দেয়ালে প্রায় ১৫ হাজার টি বর্গাকার পোড়ামাটির ফলকে চিত্রিত করা। শহর থেকে অটোরিকশায় করেই পৌঁছানো যায় কান্তজির মন্দিরে।

কান্তজির মন্দির। ছবি: ইউএনবি

নয়াবাদ মসজিদ

দিনাজপুর জেলার এই অনন্য প্রত্নতাত্ত্বিক ভান্ডারটি নির্মিত হয়েছে ১৭৯৩ সালে সম্রাট দ্বিতীয় শাহ আলমের শাসনামলে। সে সময় বেশ অনেকগুলো টেরাকোটায় কারুকার্য মণ্ডিত করে বানালেও এখন তার মাত্র ১০৪টি অবশিষ্ট রয়েছে। এগুলোর অধিকাংশই আবার সম্পূর্ণ অক্ষত নয়।

স্থানীয়দের মতে, ১৮ শতকের মাঝামাঝিতে কান্তজির মন্দির নির্মাণের সময় পশ্চিমের কোনো এক দেশ থেকে আগত মুসলমান স্থপতিরা বসবাস করতে শুরু করেন এই নয়াবাদ গ্রামে। তারাই পরবর্তীতে নিজেদের ব্যবহারের জন্য গড়ে তুলেছেন এই মসজিদটি।

কান্তজির মন্দির আর এই নয়াবাদ মসজিদ পরস্পর থেকে মাত্র কয়েক মিনিটের দূরত্বে অবস্থিত। তাই একসঙ্গে দুটো জায়গাই ঘুরে আসা যেতে পারে।

নয়াবাদ মসজিদ। ছবি: ইউএনবি

নবাবগঞ্জ জাতীয় উদ্যান

দিনাজপুরের নবাবগঞ্জ উপজেলার ৫১৮ হেক্টরের পঞ্চবটীর বনটি জাতীয় উদ্যান হিসেবে স্বীকৃতি পায় ২০১০ সালের ২৪ অক্টোবর। বর্তমানে এই বিশাল শালবনটি শেখ রাসেল জাতীয় উদ্যান নামে পরিচিত। বনের মাঝখানে প্রায় ৬০০ একরের আশুরার বিল দেশীয় মাছের অভয়াশ্রম। এই বিলের ওপরে নির্মাণ করা হয়েছে উত্তরবঙ্গের সব থেকে বড় কাঠের ব্রিজ।

স্থানীয়দের মতে সিদ্ধিলাভের পর দস্যু রত্নাকর এই বনেই বাল্মীকি মুনিরূপে খ্যাতিলাভ করেন। এখানেই রয়েছে সীতার কোট বৌদ্ধবিহার, যাকে কেন্দ্র করে রচিত হয়েছিলো কিংবদন্তির শিবের কৈলাশবাস আর সীতার বনবাসের গল্প।

দিনাজপুর থেকে নবাবগঞ্জের পথে বাস আছে। নবাবগঞ্জে পৌঁছার পর কাঠের ব্রিজের কথা জিজ্ঞেস করলেই যে কেউ পঞ্চবটী বনের রাস্তা দেখিয়ে দেবে।

দিনাজপুর রাজবাড়ী

শহরের উত্তর-পূর্বে রাজারামপুর গ্রামের কাছে রাজ বাটিকা এলাকায় অবস্থিত এই দর্শনীয় স্থানটি। রাজবাড়ী বলা হলেও ঐতিহাসিক পটভূমি অনুসারে এটি আসলে একটি জমিদার বাড়ি। দিনাজপুর জেলার ঐতিহ্য ও সমৃদ্ধির প্রতিনিধি বলতেই বোঝা হয় এই রাজবাড়ীকে। তাই সর্বসাকূল্যে ভবনের অবস্থা বেশ নাজুক থাকা সত্ত্বেও ইতিহাসপ্রেমিরা বেশ আগ্রহ নিয়ে ঘুরতে আসেন রাজবাড়ী।

এখানকার ইতিহাস সমৃদ্ধ ভবন ও জায়গাগুলোর মধ্যে রয়েছে কুমার মহল, আয়না মহল, রানী মহল, লক্ষ্মীর ঘর, আটচালা ঘর, ঠাকুর ঘর, কালিয়া জিউ মন্দির, আতুর ঘর, রাণী পুকুর ও চম্পা তলা দীঘি। শহর থেকে যেকোনো স্থানীয় গাড়িতে করে ঘুরে আসা যায় রাজবাড়ী।

দিনাজপুর রাজবাড়ী। ছবি: ইউএনবি

সিংড়া জাতীয় উদ্যান

দিনাজপুরের বীরগঞ্জ উপজেলার ভগনগরে অবস্থিত এই বনাঞ্চলটি সিংড়া মৌজার অন্তর্গত বলে এর নাম হয়েছে সিংড়া ফরেস্ট। প্রায় ৮৫৬ একর বনাঞ্চলটির প্রায় ৭৫৬ একর জায়গাকে জাতীয় উদ্যান হিসেবে ঘোষণা করা হয় ২০১০ সালে। এরপর থেকে এটি পিকনিক স্পটে পরিণত হয়েছে। বনের মাঝ দিয়ে বয়ে যাওয়া নদীটি খনন করে ২ ভাগে বিভক্ত হওয়া বনকে একসঙ্গে মেলাতে তৈরি করা হয়েছে সেতু।

শিশুদের জন্য বিভিন্ন ধরনের রাইডসসহ সরকারি উদ্যোগে বিনোদনের বিভিন্ন কার্যক্রম চালু হয়েছে। প্রতি শীতেই এখানে পিকনিক করার ধুম পড়ে যায়। দিনাজপুর শহর থেকে বীরগঞ্জ হয়ে সড়ক পথেই পৌঁছা যায় সিংড়া জাতীয় উদ্যানে।

স্বপ্নপুরী পিকনিক স্পট

দিনাজপুরের সবচেয়ে আকর্ষণীয় জায়গাটির অবস্থান এর ফুলবাড়ী উপজেলার আফতাবগঞ্জে। প্রায় ৪০০ একর জমির ওপর গড়ে তোলা হয়েছে এই সুন্দর নকশাকৃত বিনোদন পার্কটি। কৃত্রিম হ্রদ, পাহাড়, বাগান, গাছ-গাছালি, ফুলের বাগান, প্রতিকৃতি, চিড়িয়াখানা, কৃত্রিম ফোয়ারা, ইটভাটা, ঘোড়ার রথ, শাল, হংসরাজ সাম্পান, খেলাধূলার জায়গা; সব মিলিয়ে এক সমৃদ্ধ পিকনিক স্পট এই স্বপ্নপুরী। এ ছাড়াও আছে মাটির কুঁড়েঘর, ডাকবাংলো ও বাংলাদেশের ভূমি মানচিত্র।

এখানে রাত্রি যাপনের জন্য রয়েছে ৫টি কটেজ। সবকিছু উপভোগ করতে হলে জনপ্রতি ৭০ টাকা খরচ করে পার্কে প্রবেশ করতে হবে। দিনাজপুর থেকে সিএনজিচালিত অটোরিকশা বা বাসে করে স্বপ্নপুরী যাওয়া যায়। প্রধান শহর থেকে প্রায় ২ থেকে আড়াই ঘণ্টার রাস্তা। তাই ঢাকা থেকে গেলে এই যাত্রায় সারাদিন লেগে যেতে পারে।

স্বপ্নপুরী পিকনিক স্পট। ছবি: ইউএনবি

লিচু বাগান

দিনাজপুরের দেশব্যাপী সুখ্যাতি মূলত এর লিচুর জন্যে। এখানকার ১৩টি উপজেলাতেই চাষ হয় লিচুর। ছোট-বড় সব মিলিয়ে গোটা দিনাজপুর জেলায় মোট ৩ হাজার ১২৮টিরও বেশি লিচু বাগান আছে, যেখানে লিচু গাছের সংখ্যা প্রায় ২ লাখ ২০ হাজারের মতো। দিনাজপুরের প্রসিদ্ধ লিচুর বাজার এলাকার নাম পৌরসভা নিউমার্কেট।

সকাল থেকে দুপুর অব্দি চলে লিচুর বেচা-কেনা। চিরির বন্দরে কম করে হলেও আছে প্রায় ১ হাজার ২০০ লিচু বাগান। এ ছাড়া শহরে রামসাগর দিঘির পথে মাশিমপুর এলাকাটি লিচুর জন্য অনন্য এক জায়গা। এ ছাড়া কাহারোল উপজেলার কান্ত নগরের নয়াবাদ গ্রামে দেখা যাবে প্রচুর লিচু বাগান। কান্তজীর মন্দির ও নয়াবাদ মসজিদ যাওয়ার পথেই অটোরিকশা থেকে চোখে পড়বে এই বাগানগুলো।

দীপশিখা মেটি স্কুল

দিনাজপুরের বিরল উপজেলার মোঙ্গলপুর ইউনিয়নের অন্তর্গত রুদ্রপুর গ্রামের এক ব্যতিক্রম স্কুল দীপশিখা মেটি স্কুল। ১৯৯৯ সালের ১ সেপ্টেম্বর দীপশিখা নামক একটি স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন প্রতিষ্ঠা করেছিল স্কুলটি। তবে ভিন্নধর্মী শৈল্পিক স্থাপনার কাজ শুরু হয় ২০০৫ সালের সেপ্টেম্বরে।

অপূর্ব এই শিল্পকর্মের মূল উপাদান হচ্ছে মাটি, খড়, বালি ও বাঁশ, দড়ি, খড় ও কাঠ। শুধুমাত্র ভিত ছাড়া আর কোথাও ইট ব্যবহার করা হয়নি। পুরো স্কুলটি ৬ কক্ষ বিশিষ্ট একটি দোতলা ভবন, যার আয়তন ৮ হাজার বর্গফুট। পরিবেশবান্ধব শ্রেণিকক্ষগুলোতে শিক্ষার্থীরা গরম-শীতের তীব্রতা অনুভব করে না।

দিনাজপুর শহরের টেকনিক্যাল মোড় থেকে বোচাগঞ্জগামী বাসে উঠে নেমে যেতে হবে মঙ্গলপুর। তারপর সেখান থেকে অটোরিকশায় করে সরাসরি মেটি স্কুল পৌঁছানো যাবে।

হাজী মোহাম্মদ দানেশ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়

এটি রংপুর বিভাগের প্রথম বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়। তেভাগা আন্দোলনের জনক হাজী মোহাম্মদ দানেশের নাম নিয়ে ১৯৭৬ সালে শুরু হয় এই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানটির যাত্রা। তবে শুরুতে এটি কলেজ হলেও ২০০২ সালের ৮ এপ্রিল এটি বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবে স্বীকৃতি পায়।

১৩০ একর আয়তনের এই বিশ্ববিদ্যালয়ে আছে জিমন্যাশিয়াম, মসজিদ, পোস্ট অফিস, ব্যাংকের শাখা, অ্যাকাডেমিক ভবন, মেডিকেল সেন্টার, প্রশাসনিক ভবন, হোস্টেল, সেমিনার কক্ষ ও ২টি অডিটরিয়াম। এ ছাড়া আরও আছে লাল-সাদা ইটের সমন্বয়ে তৈরি দৃষ্টিনন্দন ভবন, শিশুপার্ক, খেলার মাঠ, ডি-বক্স চত্বর, বোটানিক্যাল গার্ডেন, টিএসসি, লাইব্রেরি, শহীদ মিনার ও ক্যান্টিন।

বিশ্ববিদ্যালয়টি ঢাকা-দিনাজপুর মহাসড়কের পাশেই অবস্থিত। দিনাজপুর শহর থেকে সিএনজিচালিত অটোরিকশায় করে বিশ্ববিদ্যালয়ে যাওয়া যাবে। এ ছাড়া বিশ্ববিদ্যালয়ের নিজস্ব বাসে চড়েও যাওয়া যেতে পারে।

হাজী মোহাম্মদ দানেশ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়। ছবি: ইউএনবি

পরিশিষ্ট

দিনাজপুর জেলার দর্শনীয় স্থানগুলো থেকে যেকোনো একটিই পরিদর্শন জীবনের সেরা অভিজ্ঞতাগুলোর একটি হতে পারে। কিন্তু সেই অভিজ্ঞতাকে নিমেষেই নষ্ট করে দিতে পারে অনাকাঙ্ক্ষিত যেকোনো দুর্ঘটনা। তাই ভ্রমণের সময় প্রয়োজন সদা সতর্কতা।

বিশেষ করে সময়টি যখন শীতকাল, তখন ভ্রমণের জন্য সঠিক কাপড় ও জুতা বাছাই করার পরেও ব্যাগটিকে সহজে বহনযোগ্য করার প্রতি খেয়াল রাখতে হবে। সঙ্গে বিশুদ্ধ খাবার পানি রাখা উচিত। স্থানীয় খাবার চেখে দেখার ব্যাপারে সতর্ক থাকা জরুরি। স্বাস্থ্য ঠিক না থাকলে মাঝপথেই ভ্রমণ শেষ করে ফেলতে হতে পারে। যেকোনো জরুরি অবস্থা নিয়ন্ত্রণের জন্য বিশুদ্ধ খাবার পানি ও সাধারণ ওষুধপত্রের সঙ্গে ফার্স্ট এইড বক্স সঙ্গে রাখা বাঞ্ছনীয়।

Comments