ঐতিহাসিক নিদর্শন শশীলজের একাল-সেকাল

ঊনবিংশ শতকের শেষ দিকে ময়মনসিংহ শহরের কেন্দ্রস্থলে ৯ একর ভূমির ওপর একটি মনোমুগ্ধকর দ্বিতল ভবন নির্মাণ করেন সূর্যকান্ত। সূর্যকান্তের দত্তক পুত্র শশীকান্ত আচার্য চৌধুরীর নামে এই ভবনের নাম রাখা হয় শশীলজ। ছবি: ফাবিহা বিনতে হক

মুক্তাগাছার জমিদারির প্রতিষ্ঠাতা শ্রীকৃষ্ণ আচার্য্য প্রস্থানের পর কেটে গেছে অনেকদিন। ৩ পুরুষ ধরে চলমান জমিদারির সিলসিলা বহাল রাখতে গৌরীকান্ত আচার্য চৌধুরীকে দত্তক নেন জমিদার রঘুনন্দন আচার্য্য। জমিদার গৌরীকান্ত আচার্য চৌধুরীরও কোনো সন্তান ছিল না।

জমিদার গৌরীকান্ত আচার্য চৌধুরী মারা যাওয়ার পর তার স্ত্রী লক্ষ্মী দেবী আচার্য চৌধুরানী পূর্বসূরিদের পথ অনুসরণ করে দত্তক নিলেন চন্দ্রকান্তকে। অল্পবয়সে চন্দ্রকান্তের মৃত্যু হলে লক্ষ্মী দেবী সূর্যকান্ত আচার্য চৌধুরীকে দত্তক নেন।

সূর্যকান্ত আচার্য চৌধুরীর ময়মনসিংহে স্থাপন করেন একাধিক নান্দনিক স্থাপনা। ঊনবিংশ শতকের শেষ দিকে ময়মনসিংহ শহরের কেন্দ্রস্থলে ৯ একর ভূমির ওপর একটি মনোমুগ্ধকর দ্বিতল ভবন নির্মাণ করলেন সূর্যকান্ত। সূর্যকান্তের দত্তক পুত্র শশীকান্ত আচার্য চৌধুরীর নামে এই ভবনের নাম রাখা হয় শশীলজ। রাজপ্রাসাদটি ১৮৯৭ সালের ১২ জুন ভূমিকম্পে বিধ্বস্ত হলে অত্যন্ত ব্যথিত হন সূর্যকান্ত আচার্য চৌধুরী। ১৯০৫ সালে ঠিক একই স্থানে নতুনভাবে শশীলজ নির্মাণ করেন শশীকান্ত আচার্য চৌধুরী। ১৯১১ সালে শশীলজের সৌন্দর্য বর্ধনে আরও কিছু সংস্কারকাজ সম্পন্ন হয়। নবীন জমিদারের প্রচেষ্টায় শশীলজ হয়ে ওঠে আভিজাত্যপূর্ণ, দৃষ্টিনন্দন রাজমহল।

ছবি: ফাবিহা বিনতে হক

ময়মনসিংহ শহরের প্রাণকেন্দ্রে ৯ একর জায়গা জুড়ে আজও সমহিমায় দাঁড়িয়ে আছে লাল ইটের রাজবাড়ি। যার দ্বারপ্রান্তে আছে সাদা মার্বেল পাথরে নির্মিত দৃষ্টিনন্দন গ্রিকদেবী ভেনাসের মর্মর প্রতিমূর্তি। যেখানে আজ আর রাজা নেই, নেই রাণী কিংবা মন্ত্রীপরিষদ, শুধু পড়ে আছে সুবিশাল রাজপ্রাসাদ আর তার পরতে পরতে জড়ানো ইতিহাসের স্মৃতিচিহ্ন।

বাংলার বিখ্যাত মহারাজা শশীকান্ত আচার্য্যের পরিবার বাংলা বিহার উড়িষ্যার নবাব মুর্শিদকুলি খাঁর আমলে প্রথম জমিদারি লাভ করেন এবং ময়মনসিংহ শহর থেকে কিছু দূরে অবস্থিত মুক্তাগাছাকে কেন্দ্র করে তাদের জমিদারি পরিচালিত হয়। শশীকান্ত আচার্য্য ছিলেন এই জমিদার পরিবারের শেষ উত্তরাধিকার।

ছবি: ফাবিহা বিনতে হক

আঠারশ শতকে মুক্তাগাছার বাহিরে নির্মিত এ রাজবাড়ীটি স্থাপত্যশৈলীর অনন্য নিদর্শন হিসেবে এখনো শহরের প্রাণকেন্দ্রে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে।

প্রাসাদের কাঠামো

বাংলাদেশের অন্যতম প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন শশীলজের প্রতিটি ইঞ্চিতে ছড়িয়ে রয়েছে নানা গল্প, ইতিহাস আর লোকগাথা। ৯ একর জমির উপর সবুজের সমারোহ নিয়ে অতীত ঐতিহ্য ধারণ করে শশী লজ মহাকালের সাক্ষীরূপে অম্লান হয়ে আছে। প্রাসাদটিতে রয়েছে ১৬টি গম্বুজ। শশীলজের মূল ভবনের সামনেই রয়েছে বাহারি ফুলের বাগান। বাগানের মাঝখানে আছে শ্বেতপাথরের ফোয়ারা, যার মাঝখানে দাঁড়িয়ে আছে গ্রিক দেবী ভেনাসের স্নানরত মর্মর মূর্তি। বাগানের ঠিক পেছনেই লালচে ইট আর হলুদ দেয়ালে নির্মিত শশী লজের মূল ভবনটি অবস্থিত। ভেতরে প্রায় প্রতিটি ঘরেই ছাদ থেকে ঝুলন্ত, প্রায় একই রকম দেখতে বেশ কয়েকটি ঝাড়বাতি আছে। ভবনের পাশেই আছে পদ্মবাগান। শশী লজের ভেতর মহলের বারান্দা অতিক্রম করে কয়েক ধাপ সিঁড়ি পেরোলেই রঙ্গালয়। একসময় বাইজীর রিনিঝিনি নূপুরের শব্দে মুখরিত রঙ্গালয় আজ কেবলই ইট-পাথরের দেয়াল।

ছবি: ফাবিহা বিনতে হক

সাধারণ বাস ভবন ছাড়াও প্রাসাদটিতে আছে স্নানঘর, দাস-দাসীদের থাকবার জায়গা, রান্না ঘর। ভবনটির পেছনে রয়েছে একচিলতে সবুজ উঠান। সেই উঠান পেরোলেই চোখে পড়বে স্বচ্ছ সাদা এক দ্বিতল ভবন। এটি রাণীর স্নানঘর হিসেবে ব্যবহৃত হতো। ভবনের পেছনে অবস্থিত "জলঘর" খ্যাত স্নানঘরটি দোতলা পুকুর ঘাটলা। কে এই জলঘরের ভাস্কর তার পরিচয় না মিললেও সাদা মার্বেল পাথরে নির্মিত স্নানঘরটি যেকোনো দর্শনার্থীর চোখ জুড়িয়ে দেবে। স্নানঘরের ভেতরে রয়েছে একটি সুড়ঙ্গ যা এই ঘরের রহস্যময়তা আরও বাড়িয়ে দেয়। ধারণা করা হয়, এই সুড়ঙ্গপথে মুক্তাগাছা যাওয়ার ব্যবস্থা ছিল। এই স্নানঘরে বসে রাণী পুকুরে হাঁসের জলকেলি দেখতেন। পুকুরটির ঘাটও মার্বেল পাথরে বাঁধানো।

বাড়িটির আশেপাশে রয়েছে বেশকিছু দুষ্প্রাপ্য ও প্রাচীন গাছগাছালি। দেখা মিলবে জমিদারি ইতিহাসের প্রাচীনতম সাক্ষী নাগলিঙ্গম বৃক্ষের। যা তখন হাতির খাবার হিসেবে ব্যবহৃত হতো।

বর্তমান অবস্থা

জমিদারী প্রথা বিলুপ্ত হওয়ার পর তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান সরকার জমিদারদের সব ভবন ও সম্পত্তি সরকারের খাস জমি ও ভবন হিসেবে ঘোষণা দেয়। ১৯৫২ সালে সরকার এই ভবনটিকে 'মহিলা শিক্ষিকা প্রশিক্ষণ মহাবিদ্যালয়' হিসেবে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অধীনস্থ করে। ২০১৫ সালে প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তর সেখানে জাদুঘর স্থাপনের জন্য বাড়িটি অধিগ্রহণ করে। ২০১৯ সালে রাজবাড়ীর অন্দরমহল জনসাধারণের জন্য খুলে দেওয়া হয়। রাজমহলের মোট ১৮টি কক্ষের মধ্যে ৩টি কক্ষে রাজবাড়ীর পুরাকীর্তি, রাজার ব্যবহার্য জিনিস, আসবাবপত্র সংরক্ষণ করে রাখা আছে। সেখানে দেখতে পাওয়া যাবে হাতির দাঁতের তৈরি সোফা, মাঝখানে রাখা একটি মার্বেল পাথরের টেবিল। ঘরের ভেতর রাখা চেয়ারের সর্বাঙ্গে ময়ূর, লতাপাতা আর ফুলের কারুকাজ। যে কাজগুলো করা হয়েছে হাতির দাঁত দিয়ে।

ছবি: ফাবিহা বিনতে হক

গণ্ডারের চামড়া থেকে শুরু করে বুনো মোষের শিং, হরিণের শিং, জমিদারদের ব্যবহার্য পালংক, মহিষের শিং দিয়ে তৈরি পানপাত্র, শ্বেতপাথরের মূর্তি, হাতির মাথার কঙ্কাল, হাতির চোয়ালের কঙ্কাল, মাটির নলসহ হুঁকাসহ আরও ঐতিহাসিক পুরাকীর্তি দর্শনার্থীদের প্রদর্শনের জন্য রাখা হয়েছে। মাত্র ১৫ টাকা মূল্যের টিকিটের মাধ্যমে এই জাদুঘরে প্রবেশ করা যাবে।

   

Comments

The Daily Star  | English

Netanyahu now a wanted man

ICC issues arrest warrants for the Israeli PM, his former defence chief for war crimes and crimes against humanity; 66 more killed in Gaza

22m ago