রিভার্স কালচার শক বিষয়ে কতটা জানেন?

রিভার্স কালচার শক
ছবি: সংগৃহীত

আমরা যারা দেশের বাইরে পড়তে যাই, 'কালচার শক' বিষয়টির সঙ্গে তারা সবাই কম-বেশি পরিচিত। দেশের বাইরে নতুন পরিবেশে, নতুন সংস্কৃতিতে শুরুর দিকে যে বিড়ম্বনা, এই বিষয়টি আজকাল বেশ আলোচিত।

বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে গ্র্যাজুয়েট শিক্ষার্থীদের জন্য তাই সেমিস্টারের শুরুতেই বিভিন্ন প্রশিক্ষণ-কর্মশালার মাধ্যমে 'কালচার শক' বিষয়টি নিয়ে আলোচনা করা হয়। কিন্তু দেশের বাইরে দীর্ঘদিন থাকার পর আমরা যারা আবার নিজ দেশে ফিরে আসি, সেই সময়টাতে পরিবর্তিত পরিবেশে বিড়ম্বনার সম্মুখীন হই। মনোবিজ্ঞানে কিন্তু বলা হয়, নিজ দেশ ফিরে এলেও দীর্ঘদিন ভিন্ন এক সংস্কৃতি, পরিবেশে থাকার ফলে ব্যক্তির মধ্যে এক ধরনের রিভার্স কালচার শক তৈরি হয়। এই বিষয়টি  নিয়ে খুব একটা আলোচনা হতে দেখা যায় না।

দেশে ফেরার পর আমার নিজের এবং আমার বেশ কয়েকজন বন্ধু-সহকর্মীর অভিজ্ঞতা ছিল প্রায় একই। ঠিক কোথায় যেন আমাদের খাপ খাচ্ছে না! আবার প্রবাসে থাকতেও নিজ দেশ, পরিবারের কথা আমরা মনে করেছি প্রতিনিয়ত। কিন্তু দুবছর পর দেশে ফিরে এমন বোধ হবে, সেটার জন্য আমরা কেউই প্রস্তুত ছিলাম না।

মনোবিজ্ঞানে এর প্রধান কারণ হিসেবে বলা হয়, দীর্ঘদিন একটি পরিবেশে থাকার ফলে সেখানে আমাদের একটি অভ্যাস গড়ে ওঠে। একইসঙ্গে সেই পরিবেশ এবং স্থানে নিত্যদিনের কাজকর্ম, সেখানকার পরিচিত মানুষ, সবকিছু মিলিয়ে আমরা নতুন আরেকটি 'কমফোর্ট জোন' তৈরি করে নিই। আমাদের মস্তিষ্ক সেভাবেই এই পরিবেশটিকে নিরাপদ ভেবে নেয়। তাই যখন অভ্যাসবশত গড়ে তোলা নিয়ম, বা পুরো জীবনব্যবস্থাটাই ছেড়ে আবার আরেক পরিবেশে এসে পড়ি, তখন আমাদের মধ্যে এক ধরনের অস্বস্তি, সেইসঙ্গে কখনো ভীতিও তৈরি হতে পারে।

তবে এর আরও কারণ রয়েছে। যেমন আমার সহকর্মীদের অধিকাংশই বলেছেন, আবহাওয়া, নিরাপত্তা এবং পরিবেশে খাপ খাইয়ে নিতে তাদের অস্বস্তি কাজ করছিল। নারী সহকর্মীদের ক্ষেত্রে নিরাপত্তা, স্বাচ্ছন্দ্যে চলাফেরার বিষয় আরেকটি প্রধান কারণ। আর আমার নিজের ক্ষেত্রে কারণটা ছিল, আমি একেবারেই চলে এসেছিলাম। তাই দুবছরের যত বন্ধু, সুন্দর পরিবেশ আর এই দুটা বছরে যত্ন করে গুছিয়ে নেওয়া আমার বাসাটা ছেড়ে আসতে বেশ খারাপ লাগছিল।

দেশে ফিরেই আবার সেই চাকরিজীবন। অবশ্যই শিক্ষা আর চাকরিজীবনের মধ্যে পার্থক্য বিস্তর! তাই নিজের বন্ধুমহল, তাদের সঙ্গে সপ্তাহ শেষের আড্ডা আর হবে না, ভেবেই খারাপ লাগছিল। এর মধ্যে পূর্ব-পশ্চিম মহাদেশের যে দূরত্ব, সে কারণে জেটল্যাগ কাটাতে লেগে গিয়েছিল প্রায় পুরো এক মাস। এই ভিন্ন রুটিনও কিন্তু আমারসহ অনেকের ক্ষেত্রেই অবসাদবোধ তৈরি করে। সবকিছু মিলিয়ে, আমরা প্রায় সবাই দেশে ফিরেই এক ধরনের অনুপস্থিতি টের পাচ্ছিলাম, যাকে খুব সহজে বলা যায়, 'ফিশ আউট অফ ওয়াটার'। প্রবাদটির মানে হলো, একটি জলজ্যান্ত মাছকে পানি থেকে তুলে এনে ডাঙায় ছেড়ে দিলে, মাছটির যে দশা হবে, খানিকটা ওরকম।

এ ক্ষেত্রে ব্যক্তির সময় নিয়ে আবার সেই পরিবেশে খাপ খাইয়ে নেওয়া ছাড়া আসলে কোনো বিকল্প নেই। খারাপ লাগার সময়টুকু পরিবার, কাছের বন্ধু কিংবা পছন্দের জায়গাগুলোতে সময় কাটানো যেতে পারে। যেমন বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাস, পছন্দের কোনো ক্যাফে বা বন্ধুর বাসা। এতে করে প্রবাসে থাকাকালীন যেই বিষয়গুলোর জন্য আমাদের খারাপ লাগা কাজ করত, সেই বিষয়গুলোর রেশ খানিকটা খুঁজে পাওয়া যাবে। এ সময় পরিবার বা কাছের বন্ধুরা হতে পারে এই 'রিভার্স কালচার শক' কাটিয়ে ওঠার সবচেয়ে ইতিবাচক উপায়।

তবে একইসঙ্গে বর্তমান এই সময়টা নষ্ট না করে, আগামীর যে পরিকল্পনা, তাও গুছিয়ে নেওয়া প্রয়োজন। যেমন অনেকেই কিছুদিন বিরতি নিয়ে আবার পরবর্তীতে উচ্চশিক্ষার জন্য পরিকল্পনা করেন। তাই উচ্চশিক্ষার জন্য যাবতীয় প্রয়োজনীয় বিষয়গুলো গুছিয়ে নেওয়া যেতে পারে। এতে করে যেই বিষয় বা মুহূর্তগুলো আমরা ছেড়ে এসেছি, সেই মুহূর্তগুলোর 'শূন্যতা' পূরণের একটি কার্যকরী উপায় হবে। এই সময়টা যে নষ্ট হচ্ছে না, বরঞ্চ আগামী সময়ের জন্য নিজেকে প্রস্তুত করা এবং যান্ত্রিক জীবনে নিজেকে খানিকটা বিরতি দেওয়া হচ্ছে, এভাবে ইতিবাচকতার সঙ্গে গুছিয়ে নিতে হবে।

পাশাপাশি এমন কিছু সঙ্গ এবং প্রশ্ন এড়িয়ে চলা প্রয়োজন, যেগুলো আমাদের মধ্যে অস্বস্তি তৈরি করতে পারে। যেমন আমাকে অজস্রবার শুনতে হয়েছে, কেন আমি পিএইচডি না করে চলে আসলাম। কেন আমি এই বোকামি করছি, যুক্তরাষ্ট্রের মতো উন্নত দেশ ফেলে চলে আসলাম! এই ব্যক্তিগত প্রশ্নগুলো আসলে একান্তই ব্যক্তির নিজস্ব পরিকল্পনা। তাই এরকম পরিবেশ এবং সঙ্গ এড়িয়ে নিজেকে সময় দেওয়া এবং আগামী পরিকল্পনার জন্য গুছিয়ে নেওয়াটাই সবচাইতে গুরুত্বপূর্ণ।

নাদিয়া রহমান: সহকারী অধ্যাপক, গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ, বাংলাদেশ ইউনিভার্সিটি অব প্রফেশনালস (বিইউপি) ও যুক্তরাষ্ট্রের ইউনিভার্সিটি অব কেন্টাকির শিক্ষার্থী।

 

Comments

The Daily Star  | English
Eid-ul-Azha 2025

Main Eid congregation held at National Eidgah

With due religious solemnity and fervour, the main congregation of Eid-ul-Azha was held at the National Eidgah.

1h ago