দুর্গাপূজার যত আচার-অনুষ্ঠান

ছবি: সংগৃহীত

নীল আকাশে সাদা মেঘের ভেলা, কাশবন আর বাতাসে শিউলির সুবাস জানান দেয় মা আসছেন। দুর্গতিনাশিনী দেবী দুর্গাকে বরণ করে নিতে প্রকৃতির মতো সাজ সাজ রব মন্দির-মণ্ডপে। আর কদিন পরে ঢাকের বাদ্য আর শঙ্খধ্বনিতে মুখরিত হবে চারদিক।

দুর্গাপূজার আচার-অনুষ্ঠান সম্পর্কে জেনে নিন মহানগর সার্বজনীন পূজা কমিটির পুরোহিত বরুণ চক্রবর্তীর কাছ থেকে।

দেবীর আগমন ও গমন

পঞ্জিকামতে, ২০২৩ সালে দেবী দুর্গা এবার মর্ত্যে আসবেন ঘোটকে অর্থাৎ ঘোড়ায় চড়ে। যাবেনও ঘোড়ায় চড়ে। এর ফল 'ছত্রভঙ্গ'। দুর্গার আগমন ও গমন অনেক প্রাকৃতিক দুর্যোগ ও বির্পযয়ের বার্তা দিচ্ছে।

 

মহালয়া

১৪ অক্টোবর শুভ মহালয়ায় পিতৃপক্ষের অবসানে দেবীপক্ষের শুরু। দেবীপক্ষের সূচনালগ্নে স্বর্গ থেকে মর্ত্যলোকে মায়ের আগমন বার্তা ধ্বনিত হয়।

দেবীপক্ষেই শান্তির বার্তা নিয়ে দু্র্গতিনাশিনী দুর্গা স্বর্গ থেকে মর্ত্যলোকে আসেন। প্রথমে বিল্বতলে অর্থ্যাৎ বেলগাছের নিচে অবস্থান নেন। সেই শুভলগ্নে মাকে আহ্বান করে ঘট স্থাপন করা হয়। ষোড়শ উপাচারে দেবী দুর্গার পূজা করা হয় বিল্বতলে। দেশ ও জাতির মঙ্গল কামনা করে ওই বিল্বতলেই পুষ্পার্ঘ্য অর্পণ করা হয়। ভোরে চণ্ডীপাঠের মধ্য দিয়ে মায়ের আবাহন আর সকাল ৮টায় বিল্বতলে পূজা করা হয় বলে জানান পুরোহিত বরুণ চক্রবর্তী।

রামচন্দ্র অকালবোধন করে শারদীয় দুর্গোৎসবের সূচনা করেছিলেন। অকালে দুর্গাকে জাগিয়ে তুলেছিলেন বলে একে বলা হয় অকালবোধন। ষষ্ঠীপূজা এবং বোধন একই দিনে এবার।

মহাষষ্ঠী

২০ অক্টোবর ষষ্ঠ্যাধী কল্পারম্ভ বিহিত পূজা। ষষ্ঠ্যাধী কল্পারম্ভ হবে সন্ধ্যাবেলা। আর বিহিত পূজা হবে সকালবেলায়। সকালে বেলগাছের নিচে ঘট স্থাপন করে ষোড়শ উপাচারে পূজা করা হবে। দেবী দুর্গার চরণে গন্ধ, পুষ্প, অর্ঘ্য বাদ্য দিয়ে প্রার্থনা করা হবে দেশ তথা বিশ্বে অশুভ শক্তির বিনাশ আর শুভ শক্তি প্রতিষ্ঠার।

সন্ধ্যাবেলায় শুরু হবে ষষ্ঠ্যাধী কল্পারম্ভ। ষষ্ঠী তিথির সন্ধ্যায় দুর্গা মণ্ডপে প্রথমে দেবীর বোধন। বোধনের মাধ্যমে দেবীকে জাগিয়ে তোলা হবে। পরে অধিবাস ও আমন্ত্রণ করা হবে। এদিন মায়ের মুখ উন্মোচিত হয়। লক্ষ্মী, গণেশ, কার্তিক, সরস্বতীকে নিয়ে মণ্ডপে অধিষ্ঠিত হন দশভূজা দেবী দুর্গা।

মহাসপ্তমী

২১ অক্টোবর মহাসপ্তমী। এদিন সকালে প্রথমে নবপত্রিকা স্থাপনের কথা জানান পুরোহিত বরুণ চক্রবর্তী।

নবপত্রিকা হচ্ছে কলাবউ। নবপত্রিকার নয়টি গাছ দেবী দুর্গার নয়টি বিশেষ রূপ। কদলী, কচু, হরিদ্রা, বিল্ব, ধানসহ নয়টি গাছ কলাগাছের সঙ্গে বেঁধে লালপাড় সাদা শাড়িতে জড়িয়ে নববধূর মতো সাজানো হয়। এই নবপত্রিকা বা কলাবউ পূজার চারদিন প্রতিমার ডানদিকে পূজিত হয়।

এরপর ঘট স্থাপনের পর তর্পণের মাধ্যমে দেবী দুর্গাকে মহাস্নান করানো হবে। চক্ষুদানের মাধ্যমে মায়ের প্রাণ প্রতিষ্ঠা করা হবে মহাসপ্তমীতে। লক্ষ্মী, গণেশ, কার্তিক, সরস্বতী, দেবাদিদেব মহাদেব, সকল দেব-দেবীর প্রাণ প্রতিষ্ঠা করা হবে। এরপর পুষ্প, অর্ঘ্য দিয়ে একেক দেব-দেবীর আরাধনা একেকভাবে করা হবে।

প্রতিবারের মতো এবারও মাতৃআরাধনায় দেশ,জাতি তথা সারাবিশ্বে সকল অশুভ দূর করে যেন মা মঙ্গলময় করে যান সেই প্রার্থনা হবে বলে জানান পুরোহিত। মহাসপ্তমীর পূজা শেষে পুষ্পাঞ্জলি দেবেন ভক্তরা। সন্ধ্যাবেলায় থাকবে সন্ধ্যাপূজা ও সন্ধ্যা আরতি।

মহাঅষ্টমী

২২ অক্টোবর মহাঅষ্টমী। অষ্টমী পূজার মূল আকর্ষণ কুমারী পূজা। এদিন মাকে কুমারীরূপে পূজা করা হয়। ঢাকার মধ্যে রামকৃষ্ণ মিশনেই শুধু কুমারী পূজা অনুষ্ঠিত হয়। কুমারী পূজায় মাতৃরূপে দেবী দুর্গারই আরাধনা করা হয়।

পুরোহিত বরুণ চক্রবর্তী জানান, অষ্টমী তিথির সকাল ৯টা ৫৭ মিনিটে নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে শেষ করতে হবে অষ্টমী পূজা। ফুল, জল, বেলপাতা, ধূপ-দীপসহ ষোড়শ উপচারে মায়ের পূজা করা হবে। এরপর পুষ্পাঞ্জলি নিবেদন। অষ্টমী পূজার পর সন্ধি পূজার আয়োজন। সন্ধ্যা ৫টা ৪৭ মিনিটের মধ্যে শেষ করতে হবে সন্ধি পূজা।

বরুণ চক্রবর্তী বলেন, 'দেবী দুর্গা ও রাবণের মধ্যে তুমুল যুদ্ধের একপর্যায়ে সন্ধি দাবি করে রাবণ। অষ্টমী তিথির শেষ ১২ মিনিট ও নবমী তিথির প্রথম ১২ মিনিট নিয়ে মোট ২৪ মিনিটের এই সংযোগস্থলই হচ্ছে সন্ধি। যুদ্ধ সমাপ্ত হয়েছিল নবমীতে। পরাজিত হয়েছিল রাবণ। জয়ের উৎসব পালিত হয় বিজয়া দশমীতে।'

ঢাকেশ্বরী মন্দিরে মহাঅষ্টমীতে যজ্ঞ করা হয় জানান পুরোহিত বরুন চক্রবর্তী।

মহানবমী

মহানবমী ২৩ অক্টোবর। মহানবমীতে ভারাক্রান্ত হয়ে উঠতে শুরু করে ভক্তদের হৃদয়। এদিন সকালে তর্পণে মায়ের মহাস্নান হবে, ষোড়শ উপচারে পূজা করা হবে। পুষ্প, অর্ঘ্য নিবেদন শেষে মায়ের চরণে পুষ্পাঞ্জলি দেবেন ভক্তরা। কোনো কোনো মণ্ডপে নবমীতে যজ্ঞের আয়োজন হয় বলে জানান পুরোহিত বরুণ চক্রবর্তী।

মহাদশমী

২৪ অক্টোবর মহাদশমী। তিথির সকালে দশমী বিহিত পূজা। ৯টা ৪২ মিনিটের মধ্যে বিজিত পূজা শেষ করে দর্পণ বিসর্জন সমাপ্ত করতে হবে জানান পুরোহিত বরুণ চক্রবর্তী। এদিন 'আশ্বিনে রাঁধে কার্তিকে খায়' এর অংশ হিসেবে শাপলা, শালুক, কাঁচা হলুদ, বোরো চাল, চিড়াসহ নানা উপকরণে মাকে পূজা দেওয়া হয়।

মহাদশমীতে দধি, মিষ্টি, চিড়া, কলা দিয়ে অসুরের ভোগ দেওয়ার কথাও জানান পুরোহিত বরুণ চক্রবর্তী।

শাস্ত্রীয় আচার মেনে দশভূজার পূজা শেষে দর্পণ বিসর্জনের মধ্য দিয়েই শেষ হবে শারদীয় দুর্গোৎসব।

পরে আনুষ্ঠানিকভাবে শোভাযাত্রার মধ্য দিয়ে প্রতিমা বিসর্জন দেওয়া হবে বিজয়া দশমীতে। তবে ঢাকেশ্বরী জাতীয় মন্দিরসহ বেশকিছু মন্দিরের প্রতিমা বির্সজন দেওয়া হয় না, নিত্য পূজিত হন মা।

এদিন সধবা নারীরা সৌভাগ্য ও মঙ্গল কামনায় মায়ের কপালে সিঁদুর ছুঁইয়ে একে অপরকে সিঁদুর ছুঁইয়ে দেন। পরে সিঁদুর খেলায় মাতেন। শাঁখা-সিঁদুর চির অক্ষয় হোক এমন প্রার্থনা জানান দেবী দুর্গার কাছে।

বিজয়া দশমীতে একদিকে আনন্দময়ী মাকে বিদায় জানানোর পালা, আবার আসছে বছর মা আবার আসবেন সেই অপেক্ষার শুরু। সব বিভেদ ভুলে সেদিন উৎসবে মাতেন সনাতন ধর্মাবলম্বীরা।

 

Comments

The Daily Star  | English

Leading univs withdrawing from cluster system

Session delays, irregularities, and lack of central planning cited as reasons

10h ago