মহাভোজ থালি: ঘোষ পরিবারের দুর্গাপূজার রেসিপি
উৎসবে-পার্বণে হিন্দু পরিবারে পরিবেশিত হওয়া একটি বিশেষ খাবার মহাভোজ থালি। নিরামিষ, মাছ ও মিষ্টি দিয়ে সাজিয়ে তোলা এ থালি বিভিন্ন সুস্বাদু বাঙালি খাবারের এক দুর্দান্ত সংমিশ্রণ।
রাজধানীর বারিধারায় লেখা ঘোষের বাড়িতে গিয়ে বিশেষ এ থালির স্বাদ নেওয়ার সুযোগ হয়। নারায়ণগঞ্জে বেড়ে ওঠা লেখা ঘোষের রক্তেই যেন খাবারের প্রতি বিশেষ ভালোবাসা রয়েছে। নারায়ণগঞ্জের বিখ্যাত বোস কেবিন প্রতিষ্ঠিত হয়েছে তার পরিবারের হাত ধরে। রান্নায় তার নিজের আগ্রহও অনেক। তার রান্না খেয়েছেন, এমন যে কেউ আরেকবার সেই রান্নার স্বাদ গ্রহণ করতে চাইবেন।
লেখা এমনিতে নতুন নতুন আইটেম নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করতে পছন্দ করেন। কিন্তু, দুর্গাপূজার সময় তিনি পুরোপুরি ঐতিহ্যের অনুসারী। এ সময়টা শুধু বাঙালি-হিন্দু পরিবারের বহু বছরের পুরনো ও ঐতিহ্যবাহী খাবার পরিবেশন করেন তিনি।
মেয়ে শ্রাবন্তী দত্তের সহায়তায় স্টার লাইফস্টাইলের জন্য মহাভোজ থালির রেসিপি দিয়েছেন লেখা ঘোষ।
এ থালিতে যা যা থাকছে-
ছোলার ডাল
উপকরণ
বুটের ডাল, ছোট কিউব করে কাটা নারিকেল, কিশমিশ, হলুদ গুঁড়ো, আদা বাটা, লবণ, চিনি, গরম মসলার গুঁড়ো, তেল, ঘি, তেজপাতা, শুকনো লাল মরিচ ও জিরা।
প্রণালি
লবণ দিয়ে বুটের ডাল সেদ্ধ করুন। ফুটন্ত ডালে এক চিমটি হলুদ গুঁড়ো, আদা বাটা, লবণ ও চিনি দিন। আলাদা প্যানে ঘি দিয়ে নারিকেল ও কিশমিশ ভাজুন।
একটি গভীর পাত্রে তেল গরম করুন। তেজপাতা, শুকনো লাল মরিচ ও জিরা দিন। সেদ্ধ ডাল দিয়ে নাড়ুন। ভাজা নারিকেল ও কিশমিশ যোগ করুন। লবণ ও চিনি ঠিক আছে কি না দেখুন। ১ চা চামচ খাঁটি ঘি, গরম মশলা গুঁড়ো ও কাঁচামরিচ যোগ করুন। ভালো করে নেড়ে চুলা থেকে নামিয়ে নিন।
মোচা ঘণ্ট
উপকরণ
কলা ফুল (চিকন করে কাটা কলার মোচা), ছোট কিউব করে কাটা আলু , সেদ্ধ ছোলা, ভাজা নারিকেল, কিশমিশ, কাঁচামরিচ, তেজপাতা, আস্ত জিরা, লবণ, চিনি, ঘি, গরম মসলা বাটা। হলুদ গুঁড়ো, মরিচ গুঁড়ো, জিরা গুঁড়ো, ধনে গুঁড়ো, আদা বাটা ও সামান্য পানি দিয়ে তৈরি মসলার পেস্ট।
প্রণালি
কাটা কলা ফুল লবণ দিয়ে ফুটিয়ে নিন। একটি প্যানে তেল গরম করুন। তেজপাতা ও জিরা দিন। এরপর ছোলা যোগ করুন এবং একটু ভাজুন। আলু দিয়ে ভাজুন। এরপর ভাজা নারিকেল ও কিশমিশ দিয়ে আবার ভাজুন। মসলার পেস্ট যোগ করুন এবং তেল আলাদা না হওয়া পর্যন্ত ভাজতে থাকুন।
এরপর সেদ্ধ কলা ফুল ও মশলা দিয়ে ভাজুন। লবণ ও চিনি দিন। আঁচ কমিয়ে ঢেকে দিন এবং সেদ্ধ করুন। শুকিয়ে যাওয়ার পর ঘি, গরম মসলা বাটা ও কাঁচামরিচ দিন। ভালো করে নেড়ে চুলা থেকে নামিয়ে নিন।
ছানাবড়ার তরকারি
উপকরণ
ছানাবড়ার জন্য দই পনির (ছানা), হলুদ গুঁড়ো, মরিচ গুঁড়ো, আদা বাটা, বেকিং সোডা, ময়দা, তেল, লবণ ও চিনি। তেলে দেওয়ার জন্য তেজপাতা, আস্ত এলাচ, দারুচিনি ও লবঙ্গ। সাদা তিল, পোস্ত বীজ, কাঁচামরিচ, ভাজা নারিকেল ও আদা বাটা দিয়ে তৈরি মসলার পেস্ট। এ ছাড়া, তেল, ঘি, লবণ ও চিনি লাগবে।
প্রণালি
ছানাবড়ার উপকরণগুলো মিহি করে ব্লেন্ড করুন এবং বল তৈরি করুন। বাদামী হওয়া পর্যন্ত বলগুলো ভাজুন। কড়াইয়ে তেল গরম করুন এবং তেজপাতা, আস্ত এলাচ, দারুচিনি ও লবঙ্গ দিন। এরপর মসলার পেস্ট যোগ করুন এবং তেল আলাদা না হওয়া পর্যন্ত ভাজুন। ফুটন্ত গরম পানি, লবণ ও চিনি যোগ করুন। কিছুটা ঘন হওয়া পর্যন্ত সেদ্ধ করুন।
ভাজা বল, আস্ত কাঁচামরিচ ও ঘি দিন। ১ মিনিট রেখে চুলা থেকে নামান।
সর্ষে-কাসুন্দি পাবদা
উপকরণ
হলুদ ও লবণ দিয়ে হালকা ভাজা পাবদা মাছ, সরিষা, কাঁচা মরিচ, সরিষার তেল ও লবণ। সরিষা বাটা, কাসুন্দি, কাঁচামরিচ বাটা, আদা বাটা ও হলুদ গুঁড়ো দিয়ে তৈরি মসলার পেস্ট।
প্রণালি
একটি প্যানে সরিষার তেল গরম করুন। কাঁচামরিচ ও সরিষা বীজ দিন। মসলার পেস্ট ও সামান্য পানি যোগ করুন। তেল আলাদা না হওয়া পর্যন্ত রান্না করুন। গরম পানি ও লবণ দিয়ে নাড়ুন। মাছের টুকরো দিন। ঢেকে ২ মিনিট জন্য রান্না করুন। আস্ত কাঁচামরিচ দিয়ে ১ টেবিল চামচ সরিষার তেল দিন। চুলা থেকে নামিয়ে নিন।
রুই কালিয়া
উপকরণ
রুই মাছ, হলুদ ও লবণ দিয়ে হালকা ভাজা আলু, তেজপাতা, কাঁচামরিচ, আস্ত জিরা, কিসমিস, লবণ, চিনি, তেল, ঘি ও গরম মসলার পেস্ট। কাজু বাটা, আদা বাটা, হলুদ গুঁড়ো, মরিচ গুঁড়ো, জিরা গুঁড়ো, ধনে গুঁড়ো, কিশমিশ, দই ও সামান্য পানি ব্লেন্ড করে তৈরি মসলার পেস্ট।
প্রণালি
কড়াইয়ে তেল গরম করে তেজপাতা, কাঁচামরিচ, আস্ত জিরা দিন। মসলার পেস্ট যোগ করুন এবং ভাজুন। কিশমিশ দিয়ে একটু ভাজুন। লবণ, চিনি ও গরম পানি দিন। ভাজা মাছের টুকরো ও আলু দিয়ে ঢেকে দিন। আলু হয়ে যাওয়ার পর আস্ত কাঁচামরিচ, ঘি ও গরম মসলার পেস্ট যোগ করুন। ১ মিনিট পর চুলা থেকে নামিয়ে নিন।
ইলিশ পাতুরি
উপকরণ
ইলিশ মাছ, করলা পাতা, কাঁচামরিচ, লবণ ও সরিষার তেল। সরিষাবাটা, নারিকেল বাটা, কাঁচামরিচ বাটা, হলুদ গুঁড়ো ও পরিমাণ মতো সরিষার তেল মিশিয়ে তৈরি মসলার পেস্ট।
প্রণালি
মাছের টুকরোগুলোতে ভালোভাবে মশলার পেস্ট মাখিয়ে নিন। একটি মাছের টুকরো ও একটি আস্ত কাঁচামরিচ একটি পাতা (প্রয়োজনে ২টি) দিয়ে সুন্দরভাবে মুড়িয়ে নিন। একটি টুথপিক দিয়ে গেঁথে দিন। সবগুলো এভাবে করুন। স্টিম বা মাইক্রোওয়েভ করুন এগুলো।
পরিবেশনের থালায় মাছের টুকরোগুলো রাখুন। একটি প্যানে সরিষার তেল গরম করুন। কাঁচামরিচ ও সরিষা বীজ দিয়ে গরম করুন। মাছের টুকরোর উপর গরম সুগন্ধি তেল ছড়িয়ে দিন।
বাসন্তী পোলাও
উপকরণ
২ কাপ চিনিগুঁড়া চাল, ৪ কাপ ফুটন্ত গরম পানি, ভাজা কাজু ও কিশমিশ, কাটা পেস্তা ও কাঠবাদাম, তেজপাতা, গোটা গরম মসলা, আদা বাটা, কাঁচামরিচ, হলুদ খাবারের রং। এ ছাড়া, জাফরানযুক্ত দুধ, জর্দার রং, লবণ, চিনি, তেল ও ঘি।
প্রণালি
একটি সসপ্যানে তেল ও ঘি গরম করুন। তেজপাতা ও গোটা গরম মসলা যোগ করুন। কাটা বাদাম যোগ করুন এবং একটু ভাজুন। চাল, আদাবাটা, খাবারের রং, হলুদ, লবণ ও চিনি দিয়ে ভালো করে নাড়ুন। গরম পানি দিয়ে ঢেকে রান্না করুন। পানি শুকিয়ে যাওয়ার পরে কাঁচামরিচ, কাজু ,কিশমিশ, জাফরানের মিশ্রণ ও সামান্য ঘি যোগ করুন। ভালোভাবে নেড়ে ঢেকে দিন এবং একটি তাওয়ার উপর দমে রাখুন। ১০ থেকে ১৫ মিনিট পর চুলা থেকে নামিয়ে নিন।
ঝিরঝিরি আলু ভাজা
উপকরণ
আলু, হলুদ গুঁড়ো, লবণ, কারি পাতা, চিনাবাদাম, চাট মসলা, তেল ও সরিষার তেল।
প্রণালি
ঠাণ্ডা পানিতে আলু ধুয়ে নিন। এক চিমটি হলুদ গুঁড়ো এবং লবণ দিয়ে ধুয়ে ফেলুন। একটি গভীর প্যানে তেল দিয়ে মচমচে হওয়া পর্যন্ত ভাজুন। আরেকটি প্যানে সরিষার তেল গরম করুন। কারি পাতা ও চিনাবাদাম দিন। একটু ভাজুন এবং ছেঁকে নিন। এই ভাজা মশলা ভাজা আলুর সঙ্গে মিশিয়ে তার উপর চাট মশলা দিন।
চাটনি
উপকরণ
সেদ্ধ চটকানো জলপাই, কাঁচা আমের টুকরো, পাঁচফোড়ন, সরিষা, শুকনো লাল মরিচ, হলুদ গুঁড়ো, কালো লবণ, লবণ, চিনি ও সরিষার তেল।
প্রণালি
কড়াইয়ে সরিষার তেল গরম করুন। পাঁচফোড়ন ও শুকনো লাল মরিচ দিন। জলপাই ও আম যোগ করুন। হলুদ গুঁড়ো এবং লবণ দিয়ে ভাজুন। গরম পানি দিয়ে সেদ্ধ করুন। চিনি ও কালো লবণ যোগ করুন। চিনি গলে চাটনি ঘন হওয়া পর্যন্ত রান্না করুন।
আরেকটি প্যানে সরিষার তেল গরম করুন। সরিষার বীজ ও শুকনো লাল মরিচ দিন। চাটনির উপর দিয়ে ভাল করে মিশিয়ে চুলা থেকে নামিয়ে নিন। এর উপর চাট মশলা ছিটিয়ে দিন।
নারিকেলের নাড়ু
উপকরণ
নারিকেল, চিনি, গুঁড়ো দুধ, এলাচ গুঁড়ো।
প্রণালি
ভাজা নারিকেল, গুঁড়ো দুধ ও চিনি একসঙ্গে ব্লেন্ড করুন। একটি ভারি তলাযুক্ত প্যানে নিয়ে ক্রমাগত নাড়তে থাকুন। আঁঠালো হয়ে তেল ছেড়ে দিলে প্যান থেকে মিশ্রণটি একটি থালায় নিন। হাতের তালু দিয়ে গোল বল তৈরি করুন।
পায়েস
উপকরণ
১ লিটার ফুল ক্রিম দুধ, ১০০ গ্রাম চিনিগুঁড়া চাল, ৪ টেবিল চামচ কনডেন্সড মিল্ক, ১ কাপ চিনি, এলাচ গুঁড়ো, কিশমিশ।
প্রণালি
একটি ভারী তলার সসপ্যানে দুধ ফুটিয়ে নিন। সব শুকনো উপাদান মিশিয়ে নিন (এলাচ গুঁড়া এবং কিশমিশ বাদে) এবং দুধে দিয়ে দিন। চাল সেদ্ধ না হওয়া পর্যন্ত রান্না করুন। মাঝে মাঝে নাড়তে থাকুন। চাল নরম হয়ে গেলে এলাচ গুঁড়ো ও কিশমিশ যোগ করুন। ভালো করে নেড়ে চুলা থেকে নামিয়ে নিন।
ক্ষীরের সন্দেশ
উপকরণ
ফুল ক্রিম দুধ, চিনি, ভাজা নারিকেল, এলাচ গুঁড়ো।
প্রণালি
দুধ ও চিনি একসঙ্গে কম আঁচে রান্না করুন এবং এটিকে ক্ষীর বানিয়ে নিন। ভাজা নারিকেল যোগ করুন এবং যতক্ষণ না এটি শক্ত হয়ে যায়, ততক্ষণ ক্রমাগত নাড়ুন। এরপর এলাচ গুঁড়ো যোগ করে প্যান থেকে নামান। এই মিশ্রণটিকে ছাঁচে দিয়ে সন্দেশের রূপ দিন। ঠান্ডা করার জন্য চ্যাপ্টা একটি থালায় রাখুন।
ছবি: সাজ্জাদ ইবনে সাইদ
রেসিপি ও খাবার: লেখা ঘোষ
বিশেষ ধন্যবাদ: শ্রাবন্তী দত্ত
Comments