প্রিন্সেস সিনড্রোম: নিজেকে রাজকন্যা ভাবার ‘অসুখ’

ছবি: সংগৃহীত

রাজকন্যার দেখা কি শুধু রূপকথার অলিতে-গলিতেই মেলে? না, আমাদের আশেপাশেও কিন্তু রাজকন্যার মতো মনোভাবের দেখা মেলে! কেউ তাদের রাজকন্যা মনে করুক আর না করুক, এই 'রাজকন্যারা' নিজেদের সবকিছুর মধ্যমণি মনে করেন। তারা যা চান তা সবাইকে দিতেই হবে- এমন অবাস্তব ধারণাও পোষণ করেন। অন্যরা তাকে মধ্যমণি না ভাবলেই তৈরি হয় সংকট। বিষয়টি একদমই মানতে পারেন না তারা।

মজার বিষয় হচ্ছে, নামে 'প্রিন্সেস' থাকলেও এ বিষয়টি যে শুধু নারীদের সঙ্গে ঘটে, তা কিন্তু নয়। পুরুষের জন্যও 'প্রিন্স সিনড্রোম' বলে একটি নাম আছে, কিন্তু সেটি নারীদের সিনড্রোমটির মতো বহুলচর্চিত নয়। জেন্ডার স্টেরিওটাইপ বা ছাঁচিকরণের কারণেই হয়তো এমনটা হয়।

প্রিন্সেস সিনড্রোম কী

প্রিন্সেস সিন্ড্রোমকে প্রিন্সেস সিকনেসও বলা হয়। নার্সিসিজম বা নিজেকে ভালোবাসার চূড়ান্ত রূপ এটি। এমনিতে নিজেকে ভালবাসা এবং নিজের ভালো চাওয়া এক জিনিস। কিন্তু কেউ যদি পুরোপুরিভাবে এটি বিশ্বাস করেন যে, সব ভালো কিছু শুধু তারই প্রাপ্য তবে সেটি স্বাভাবিক নয়। এই বিষয়টিই প্রিন্সেস সিন্ড্রোম। সবাইকে এখনই সবকিছু ছেড়ে দিয়ে শুধু তার দিকেই মনোযোগ দিতে হবে, এমনটাই মনে করেন এই সমস্যায় যারা ভোগেন তারা।

প্রিন্সেস সিনড্রোম ঠিক কোনো মানসিক ব্যাধি নয়। নার্সিসিজমের চূড়ান্ত রূপের ফলে এ ধরনের লক্ষণ দেখা দিতে পারে, যা নিজের ও অন্যের জন্য অস্বস্তির কারণ হয়ে উঠে। বলিউডের আগ্রহী দর্শক হয়ে থাকলে 'কাভি খুশি কাভি গাম' সিনেমায় কারিনা কাপুর অভিনীত 'পু' চরিত্রটির কথা মনে আছে নিশ্চয়ই!

এ ধরনের মানুষের মধ্যে যে সাধারণ বৈশিষ্ট্যগুলো থেকে থাকে তা হচ্ছে–

চূড়ান্ত আত্মকেন্দ্রিকতা

এই সিনড্রোমে থাকা ব্যক্তিরা সারাক্ষণ নিজেকে নিয়েই কথা বলতে পছন্দ করেন। অন্যের সম্পর্কে খুব একটা জানাশোনা বা বোঝার চাহিদা তাদের কম থাকে। নিজের ছোটখাটো সমস্যাও অন্যের বড় সমস্যার চেয়ে বড় বলে মনে করে থাকেন তারা। তার সমস্যার দিকেই সবাই গুরুত্ব দেবেন সেটাই থাকে প্রত্যাশা।

মনোযোগের কেন্দ্রবিন্দুতে থাকার তীব্র ইচ্ছা

যেকোনো সম্পর্ক বা সামাজিক পরিসরে নিজেকে সবার মনোযোগের কেন্দ্র হিসেবে না দেখতে পেলে তারা বেশ অস্থির হয়ে উঠেন। মনোযোগ আকর্ষণের জন্য এবং নিজেকে সবসময় প্রাসঙ্গিক রাখতে তারা অবিরত চেষ্টা চালিয়ে যান।

সন্তুষ্টি নেই কিছুতেই

এ ধরনের মানুষকে সন্তুষ্ট করা অত্যন্ত কঠিন কাজ। তাদের চাহিদার তালিকা যত দীর্ঘ, সন্তুষ্টি বা তৃপ্তির মাত্রা ততই সংক্ষিপ্ত। রবি ঠাকুর বহু বছর আগেই যে বলে গিয়েছিলেন, 'এ জগতে হায় সেই বেশি চায়, আছে যার ভুরি ভুরি', তা এ যুগের এই রাজকন্যাদের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। তাদেরকে খুশি করা খুব মুশকিল।

প্রতিটি সমালোচনাই ব্যক্তিগত আক্রমণ

প্রিন্সেস সিনড্রোমে ভোগা ব্যক্তিরা কোনো সমালোচনা নিতে পারেন না। যেকোনো সমালোচনাকেই তারা অন্য পক্ষ থেকে আসা আক্রমণ হিসেবে মনে করেন এবং সে অনুযায়ী প্রতিক্রিয়া দেখান। এ কারণে তাদেরকে প্রায়ই ঝগড়া-বিবাদে জড়িয়ে পড়তে দেখা যায়।

প্রিন্সেস সিন্ড্রোমের কারণ

ব্যক্তির আচার-আচরণের ডালপালা যতই দূরে ছড়িয়ে পড়ুক, মনে রাখতে হবে যে এর বীজ অধিকাংশ সময়ই বপন করা থাকে শৈশবে। বেড়ে উঠার প্রক্রিয়া থেকে মানুষ খুব একটা নিজেকে ছাড়িয়ে নিতে পারে না, সেটি ইতিবাচক বা নেতিবাচক যেভাবেই দেখা হোক না কেন। প্রিন্সেস সিনড্রোমে ভোগা ব্যক্তিদের ক্ষেত্রেও তাদের বড় হবার সময়টা এখানে গুরুত্বপূর্ণ।

২টি কারণে এমনটা হতে পারে। প্রথমটা হচ্ছে, বাবা-মায়েরা সন্তান লালন-পালনের সময় প্রয়োজনের চেয়ে বেশি ইচ্ছেপূরণ করলে, সব আবদার মেনে নিলে, জেদকে প্রশ্রয় দিলে সন্তান বড় হয়ে সবার কাছেই এটা প্রত্যাশা করতে শুরু করে। সবাই তাকে এভাবেই দেখবে, মেনে নেবে সেটিই আশা করতে থাকে সে।

বাবা-মা সন্তানকে ভালোবাসবেন, ইচ্ছেপূরণ করবেন, বিভিন্ন উপহার দেবেন– এটি অত্যন্ত স্বাভাবিক। কিন্তু প্রয়োজনের অতিরিক্ত যেকোনো কিছুই মানুষকে বিগড়ে দিতে পারে, সেটিও ভুলে যাওয়া চলবে না।

দ্বিতীয় সম্ভাব্য কারণটি আবার এর উল্টো। কোনো সন্তান পরিবারের মধ্যে যদি আবশ্যক যত্ন না পেয়ে থাকে, তখন সে নিজেকে রক্ষা করার জন্য এক ধরনের 'সেলফ বুস্টিং ডিফেন্স মেকানিজমের' জন্ম দেয়, যার পরিণতি হতে পারে প্রিন্সেস সিনড্রোমের মতো পরিস্থিতি।

সমাধান কী

যুক্তরাষ্ট্রের মনোবিদ ন্যান্সি আরভিন এক্ষেত্রে বাবা-মায়ের বিশেষ ভূমিকার দিকে আলোকপাত করেন। যেহেতু ব্যক্তির বেড়ে উঠার প্রক্রিয়ার মধ্যেই প্রিন্সেস সিনড্রোমের বীজ বপন করা থাকে, সেক্ষেত্রে বাবা-মায়েদের এদিকটাতে বেশি সচেতন থাকতে হবে।

সন্তানদের শুধু তাদের প্রতিভা বা বুদ্ধিমত্তা নয়, বরং পরিশ্রমের জন্য প্রশংসা করতে হবে। আর বাহ্যিক চেহারার অতি প্রশংসা যাতে কখনোই তাদের মধ্যে অহংকারের মতো অনুভূতি তৈরি না করতে পারে, সেদিকেও খেয়াল রাখতে হবে। সমবয়সীদের সঙ্গে অসুস্থ প্রতিযোগিতায় না ঠেলে দেওয়ার ব্যাপারটিও এখানে ইতিবাচক ভূমিকা রাখতে পারে।

সম্বোধনের দিকটাতেও একটু বাড়তি সতর্ক থাকা যায়। যেমন অযথাই 'প্রিন্সেস', 'গডেস', 'ডিভা' ইত্যাদি সম্বোধন না করাই ভালো। কারণ এতে বাচ্চাদের নিজেকে অন্যদের চেয়ে উঁচু স্তরের কিছু মনে হতে পারে এবং এর ফলে একসময় তাদের মধ্যে জন্ম নিতে পারে প্রিন্সেস সিনড্রোম। একজন ব্যক্তির বেড়ে উঠায় তার অভিভাবকরা অবশ্যই আত্মবিশ্বাসী হতে সাহায্য করবেন। কিন্তু এই আত্মবিশ্বাস যেন মাত্রা ছাড়িয়ে আত্মকেন্দ্রিকতা এবং অন্যদেরকে হেয় করার দিকে না চলে যায়– সেই ভারসাম্য বজায় রাখাটাও অত্যন্ত জরুরি।

Comments

The Daily Star  | English

PSC announces major changes to ease BCS recruitment process

The PSC chairman says they want to complete the entire process — from prelims to recruitment — in 12 months

6h ago